‘‘বড়োমাসি বলেছিল, ‘ঠিক নিবেদনটি দিতে পারব তো? দিলাম কি ঠিক করে? আমার পুজোয়?’ বলেছিল, ‘গান গাওয়া, ছবি আঁকা তো শ্রেষ্ঠ পূজার নিবেদন। তা নিজেকে যেন সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করা। আর এই আত্মসমর্পণ কি কখনও শেষ হয়? এ চলতেই থাকে।’’... লেখিকার এমন অজস্র ব্যক্তিগত স্মৃতিই তাঁর এ-বইয়ের বিষয় হয়ে উঠেছে, আর সে বিষয় এত যে বর্ণময় তার কারণ কেন্দ্রে আছে শান্তিনিকেতন। পঞ্চাশ থেকে সত্তর— এই তিন দশকের শান্তিনিকেতন। অতএব বইটিকে স্মৃতির কোলাজ বললেও অত্যুক্তি হয় না। লেখিকার বড়মাসি কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, তাঁর সঙ্গে শ্যামশ্রীর এমন আরও কত নিভৃত কথোপকথন, যেমন একবার বলেছিলেন, ‘‘কোনও ব্যাপারে মন খারাপ করবি না। সব কিছু থেকেই আনন্দটুকুই খুঁজে নিবি।... মন যদি খারাপ হয় কখনও, গান গাইবি, গাইতে ইচ্ছা না করলে ‘গীতবিতান’ পড়বি। আর-একটা কথা, গান গাইবি নিজের জন্য। মনের আনন্দের জন্য।’’ একবার শ্যামশ্রীর মেয়ে প্লেন-প্লেন খেলতে খেলতে তার বড়মাসিদিদাকে জিজ্ঞেস করেছিল ‘‘আমরা প্লেনে করে অনেক উঁচুতে উড়ে যাব, তোমার জন্য ওখান থেকে কী আনব গো?’’ কণিকা বলেছিলেন ‘‘এক মুঠো মেঘ আনিস।’’
সেই শান্তিনিকেতন/ আমার ঘর-বসত...
শ্যামশ্রী টুটু বন্দ্যোপাধ্যায়
৩০০.০০, ঋত প্রকাশন
শান্তিনিকেতনে জন্মানোর সুবাদে লেখিকার পড়াশোনা বা বড় হওয়া সেখানেই, দীর্ঘকালের যোগ। কণিকার অন্যতম বোন সবিতার কন্যা তিনি, বাবা ছিলেন বিশ্বভারতীর চিকিৎসক ডা. বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায়। লেখিকার ব্যক্তিগত জীবনের স্মৃতিবর্ণনার সঙ্গে মিশে গিয়েছে সে সময়কার শান্তিনিকেতনের সুন্দর সহজ ছবি। আশ্রমিক আলপনা রায় তাঁর সম্পর্কে লিখেছেন, ‘শান্তস্বভাব, কৃতী ছাত্রী, ভাল চিত্রী... ’, আরও লিখেছেন ‘অবাক হয়েছি ওর পরিচ্ছন্ন গান শুনে আর চমৎকার লেখালিখি পড়ে।’ শান্তিনিকেতনের নিসর্গও ধরা পড়েছে শ্যামশ্রীর লেখনীতে: ‘‘শীতের শিরশিরানি হাওয়া কমলে, শুকনো পাতা ঝরতে দেখলে, দখিনা বাতাসে মন উচাটন হলেই বুঝতাম, বসন্ত এসেছে। তখন একদিকে যেমন পাতা ঝরা, অন্য দিকে শিশু পাতা গজানো... আশ্রমে যেতে-আসতে আমরা গেয়ে উঠতাম হয়তো বা— ‘দখিন হাওয়া জাগো জাগো...’, ‘নীল দিগন্তে ওই ফুলের আগুন লাগল... ’।’’ মুদ্রণে পরিপাটি এ-বইয়ে লেখার পাশাপাশি স্কেচ-সহ নানাবিধ স্থিরচিত্র, তাতে ফেলে-আসা কালের বিশিষ্ট মানুষজনের ছবি দেখতে দেখতে মনে হতেই পারে— এ যেন শান্তিনিকেতনের বিলীয়মান রূপকথার ছবি।