প্রত্যক্ষদর্শী: যুদ্ধের পরে, ঢাকায়। ১৯৭১ সালের ছবি
১৯৭১-এর মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছিল। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে গণবিদ্রোহ দমনে পাক সেনাবাহিনী যে নারকীয় অত্যাচার চালিয়েছিল, ইতিহাসে তা নজিরবিহীন। ত্রিশ লক্ষ মানুষ শহিদ, চার লক্ষ নারী ধর্ষিতা হয়েছিলেন। লক্ষ লক্ষ শরণার্থী ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ১৯৭১-এর ৩ ডিসেম্বর দুপুরে পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করায় ওই দিন মধ্যরাতে তা প্রতিহত করতে ভারত যুদ্ধে নামে। তেরো দিনের মাথায় ঢাকায় মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় সেনার যৌথবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে পাক বাহিনী, জন্ম নেয় স্বাধীন বাংলাদেশ।
স্বাধীনতার পর গত পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অসংখ্য বই প্রকাশিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক দলিলও গ্রন্থাকারে সরকারি ভাবে প্রকাশিত হয়েছে। আলোচ্য বইটি প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ নয়, বরং বলা যায় ইতিহাস, যে ইতিহাস জনতা লিখেছেন। ১৯৭১-এর ওই নয় মাসে প্রাণভয়ে ভীত, স্বজন হারানো শোকে আকুল, কেউ গৃহহীন, কেউ চোখের সামনে নিহত হতে দেখেছেন আপনজনকে, পূর্ববাংলার এমন সাধারণ মানুষ আপন ভাষায় সে ইতিহাস লিখেছেন। মহাবিপদের দিনগুলিতে অত্যাচারিত আতঙ্কিত মানুষ কী করে বেঁচেছেন, জানিয়েছেন। তাঁদের আপন ভাষায় বর্ণিত বা লিখিত বিবরণের তিন খণ্ডের সঙ্কলন এই গ্রন্থ। এই জন্যই তা মুক্তিযুদ্ধের অসংখ্য বইয়ের একটি হয়েও, আলাদা।
সে কালে ঝুঁকিপূর্ণ তৎপরতা চালিয়ে সাংবাদিকরা কেউ কেউ প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে এমন বিবরণ বা খবর দিয়েছিলেন, যা ইতিহাসের উচ্চতা স্পর্শ করেছে। ’৭১-এর মার্চে যুদ্ধের সূচনাকালে পাক সেনা প্রশাসন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থাদি দেখাতে তখনকার পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সাত সাংবাদিককে ঢাকায় নিয়ে আসে। সে-দলেই ছিলেন করাচির দ্য মর্নিং নিউজ়-এর সাংবাদিক অ্যান্টনি মাসকারেনহাস। গোয়ায় ১৯২৮-এ জন্ম তাঁর, দেশভাগে খ্রিস্টান পরিবারটি চলে গিয়েছিল করাচি। ঢাকায় পৌঁছনোর পর ওই সাংবাদিকদের জেলায় জেলায় পাক সেনাবাহিনীর অভিযানের সময় ঘোরানো হয়। বাকি সাংবাদিকেরা পাক সামরিক অভিযানগুলির সমর্থনে লিখলেও, মাসকারেনহাস করাচিতে নিজেদের সংবাদপত্রে না লিখে লন্ডনের সানডে টাইমস-এ পাঠিয়ে দেন তাঁর লেখা, ‘জেনোসাইড’। ১৯৭১-এর ১৩ এপ্রিল সেই লেখা প্রকাশিত হতেই আন্তর্জাতিক স্তরে হইহই পড়ে যায়। তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেছিলেন, লেখাটি তাঁকে আলোড়িত করেছিল। এ লেখা তাঁকে ইউরোপের দেশগুলি ও মস্কোয় কূটনৈতিক প্রয়াসে সহায়তা করেছিল, যাতে তিনি সামরিক পদক্ষেপ করতে পারেন। এ লেখার পর মাসকারেনহাস আর পাকিস্তানে থাকতে পারেননি, লন্ডনে চলে যান। ১৯৮৬-তে সেখানেই প্রয়াত তিনি। জনগল্প ’৭১ গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ডে ফ. র. মাহমুদ হাসানের ‘লন্ডনে একাত্তর’ লেখাটিতে মাসকারেনহাসের লেখাটির উল্লেখ আছে। মাহমুদ হাসান এখন ঢাকায় থাকেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় যাঁরা বাংলাদেশের বাইরে ছিলেন, বিদেশ থেকে বাংলাদেশে মুক্তির জন্য নানা প্রয়াস করেছিলেন, দ্বিতীয় খণ্ডে আছে তাঁদের কথা। কলকাতার মীরাতুন নাহারের লেখাও রয়েছে।
জনগল্প ’৭১ (তিন খণ্ড)
সম্পা: নিশাত জাহান রানা
১০৬০.০০ বাংলাদেশি টাকা (তিন খণ্ড একত্রে)
যুক্ত
অতিমারির ফলে এই বইয়ের পরিকল্পিত নির্ঘণ্ট সংক্ষিপ্ত হয়েছে। নিশাত জাহান রানার এই তিন খণ্ডের গ্রন্থের প্রস্তুতির কাজও করোনায় বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে। জনগল্প ’৭১-এর সম্পাদনা পর্ষদের প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন আনিসুজ্জামান, ২০১৯-এর ফেব্রুয়ারিতে বইটির প্রথম খণ্ড প্রকাশের পর তিনি প্রয়াত হয়েছেন। সম্পাদনা পর্ষদের অন্যতম সদস্য কামাল লোহানীও প্রয়াত। সম্পাদক বইটির প্রেক্ষাপটে জানিয়েছেন, ১৯৯২-এ তিনি জার্মানিতে ডাকাউ কনসেনট্রেশন ক্যাম্প দেখতে গিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অত্যাচারিত বন্দিদের লেখা আত্মকথামূলক কয়েকটি বই দেখেছিলেন। তা থেকেই তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সাধারণ মানুষের আত্মকথা-সম্বলিত এ বইটির পরিকল্পনা করেন। ২০১৫-তে ফেসবুকে একটি পোস্ট দিয়ে যোগাযোগ প্রার্থনা করে এর সূচনা। পরে বন্ধুদের নিয়ে কয়েকটি দল গড়ে, জেলায় জেলায় কাজে নেমে পড়েন তাঁরা। প্রথম ও তৃতীয় খণ্ডে রয়েছে ১৯৭১-এর ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত অশ্রু রক্ত আগুনের ঢেউ পেরোনো গণমানুষের বিজয় অর্জনের আত্মকাহিনি। সত্য ও সাবুদবাহী এই গ্রন্থে গ্রামবাসীরা অকপটে জানিয়েছেন, খানসেনা ও রাজাকাররা কী ভাবে প্রথমে ধর্মভিত্তিক বাছাই করে হামলা চালিয়েছিল, বিশেষ বিশেষ পাড়ায় আগুন দিয়েছিল। কিছু দিন পর সকলেই আক্রান্ত হন।
তৃতীয় খণ্ডে খুলনার শাখারিকাঠি গ্রামের অলোকা রানী দাস জানিয়েছেন তাঁর পিতৃহত্যার বিভীষিকাময় ঘটনা, তাঁর চোখের সামনে ঘটেছিল। ফরিদপুরের রাজবাড়ির দেবাহুতি চক্রবর্তীর লেখায় রয়েছে বিপদের পর বিপদ টপকিয়ে সপরিবার কলকাতায় বেলেঘাটায় খালপাড়ে মামার বাড়িতে পৌঁছনোর বিবরণ। দেবাহুতি এখন থাকেন রাজশাহির চারঘাটে। পাবনার শালগাড়িয়ার সাজেদা খাতুন তাঁর কিশোরীবেলার ‘আশ্রয়’ মাসিমার দেশ ছাড়ার ব্যথাবিধুর বয়ান দিয়েছেন। প্রথম খণ্ডে রংপুরের নিউ সেনপাড়ার আনোয়ারা বেগম লিখেছেন ‘আমরা কেবল পালিয়ে বেড়িয়েছি’। মুক্তিযুদ্ধের ঠিক আগে মায়ের সঙ্গে সীমান্তের এ পারে পশ্চিম দিনাজপুরের মির্জাপুরে মামাবাড়িতে এসেছিল বালক আহম্মদ হোসেন বাবু। বাবা থেকে যান নওগাঁর মামুদপুরে। যুদ্ধ বেধে যাওয়ায় বালক বাবুকে নিয়ে উদ্বিগ্ন মা ফিরেছিলেন মামুদপুরে বিধ্বস্ত বাড়িতে, মা ফিরেছিলেন বাবার কাছে— প্রথম খণ্ডে উল্লসিত সেই লেখা লিখেছেন বাবু, এখন কানাডাবাসী যিনি।
সম্পাদক ও তাঁর সহযোগীরা জনসাধারণের বয়ানগুলিতে মনে হয় কলম চালাননি। পূর্ববঙ্গীয় কথ্যভাষার জেলায় জেলায় যে বৈচিত্র, তা ঝলমল করছে এখানে। প্রমিত ও কথ্য ভাষা নিয়ে বিতর্ক আছে বাংলাদেশে। এই গ্রন্থের প্রণেতারা আপন ভাষায় পাঠকের সামনে হাজির হয়েছেন। লেখায় তাঁদের দেখতে পাওয়া যায়।
লন্ডনে বসবাসকারী সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন। বিবিসি-র সাংবাদিক গাফফার ঢাকার সংবাদপত্রগুলিতে নিয়মিত কলাম লিখতেন। বাংলাদেশে জাতীয় সঙ্গীতের পরেই যে গানটি মর্যাদায় সুউচ্চ, সেই ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’-র রচয়িতা তিনি। এ গ্রন্থের প্রস্তুতিকালে জীবিত ছিলেন তিনি, তাঁর লেখা থাকলে গ্রন্থটি আরও সমৃদ্ধ হত।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পরেই ’৭১-এর এপ্রিলে যশোরে ঢুকে পড়েছিলেন অমৃতবাজার পত্রিকা-র সাংবাদিক দীপক বন্দ্যোপাধ্যায়, সঙ্গে আলোকচিত্রী সুরজিৎ ঘোষাল। তাঁদের আর কোনও খবর পাওয়া যায়নি। বিএসএফ অতি গোপনীয়তায় ’৭১-এর ১৮ এপ্রিল কলকাতার সংবাদপত্রগুলির এক দল সাংবাদিককে নিয়ে গিয়েছিল সীমান্ত সংলগ্ন কুষ্টিয়ার মেহেরপুরের ভেড়ামারায়। সদ্যমুক্ত ওই অঞ্চলে, ঘোষিত মুজিবনগরে সে দিন শপথ নেয় স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার। পাকিস্তানে জেলবন্দি শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী পদে শপথ নিয়েছিলেন তাজুদ্দিন আহমেদ। কয়েক হাজার উল্লসিত গ্রামবাসী স্বাধীন জয় বাংলা সরকারের সেই শপথগ্রহণ প্রত্যক্ষ করেছিলেন, এখনও সেই মানুষের অনেকেই নিশ্চয়ই রয়েছেন। গ্রন্থটিতে তাঁদের লেখার প্রয়োজন ছিল।
এ বই পড়তে পড়তে অর্ধশতাধিক বছর পরেও দু’চোখ সজল হয়। কখনও শরীরে উত্তেজিত ভাবে উপস্থিত হয় সে কালের ষোলো-সতেরোর সদ্যতরুণ। এ বইয়ে যে অনেক ক্রন্দনধ্বনি, আর্তনাদ, হাহাকার, জয়োল্লাস!