পপুলার সায়েন্স-এর একটি বিশেষ ধারায় লেখালিখির ক্ষেত্রে সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায় এ পর্যন্ত তিনটি বই লিখেছেন, প্রতিটিই অনবদ্য। ক্যানসার ও তার চিকিৎসার ইতিহাস নিয়ে এম্পারার অব অল ম্যালাডিজ়, জিন ও জিনতত্ত্বের ইতিহাস নিয়ে দ্য জিন; আর কোষ-জীববিদ্যার ক্রমবিবর্তন নিয়ে বর্তমান বইটি— দ্য সং অব দ্য সেল। এ ছাড়া চিকিৎসার দর্শন বিষয়ে সিদ্ধার্থবাবু একটি ‘টেড-টক’ দিয়েছিলেন, যা পরে দ্য লজ় অব মেডিসিন নামে প্রকাশিত হয়। বইটি আকারে ছোট হলেও গুরুত্বে কিছু কম নয়, আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের ছাত্রছাত্রীদের বইটা পড়ে দেখা উচিত।
তিনটি বড় বই ট্রিলজি হিসাবেও পড়া যেতে পারে। লেখক জানিয়েছেন, তিনি শুরু করেছিলেন ইমিউনোলজিস্ট হিসাবে, পরবর্তী কালে যান স্টেম সেল গবেষণায়, তার পরে ক্যানসার বায়োলজি গবেষণায়, সব শেষে হলেন ক্যানসার চিকিৎসক, মেডিক্যাল অঙ্কোলজিস্ট। বই তিনটিকে ট্রিলজি হিসাবে দেখলে বিষয়ের যাত্রাপথ অবশ্য গবেষক-চিকিৎসক-লেখকের যাত্রাপথের উল্টো।
শেষে পেশায় তিনি অঙ্কোলজিস্ট, প্রথম বইটির উৎসটুকু অনুমান করা যায়। ক্যানসারের কারণ বুঝতে জিন-এর গভীরে যাওয়া, সে প্রয়াসও বেশ কয়েক দশকের। জিন-এর রহস্য সম্পূর্ণ রূপে জানা গেলেই যাবতীয় অসুখবিসুখের উৎসরহস্য জানা হয়ে যাবে, বিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে এমন ভাবনাই ছিল চিকিৎসা-গবেষণার পরিচালক। দুই শতাব্দীর সন্ধিক্ষণে প্রকাশ পেল হিউম্যান জিনোম, মানবদেহের জিনের বিন্যাসের সম্পূর্ণ মানচিত্র। ক্যানসারের গভীরে যেতে যেতে লেখকের দ্য জিন-ও প্রত্যাশিতই৷ কিন্তু জিনের রহস্য জেনে ফেলেও তো সব জানা গেল না। অতএব, আরও গভীরে যাওয়া। মানবদেহ অজস্র কোষের সমষ্টি, যে কোষের গভীরেই রয়ে গিয়েছে ব্যাধির রহস্য, ক্যানসারের চাবিকাঠি। এই দফায় সিদ্ধার্থবাবু পৌঁছেছেন কোষের গভীরে। আগের দু’টি বইয়ের মতো এই বইটিও তথ্যবহুল; এতখানিই তথ্যবহুল যে, পরবর্তী লেখকরা বইগুলো রেফারেন্স হিসাবে অনায়াসে ব্যবহার করতে পারেন, কিন্তু কোনওটিই তথ্যের ভারে ন্যুব্জ নয়। লেখার গুণে, সমকালীন ইতিহাসের যথাযথ প্রয়োগে, কিংবদন্তি বিজ্ঞানীদের জীবনের জানা-অজানা ঘটনার উপস্থিতিতে, লেখকের জীবনের টুকরো গল্পে বইগুলো— এবং আলোচ্য বইটিও— জমজমাট।
দ্য সং অব দ্য সেল: অ্যান এক্সপ্লোরেশন অব মেডিসিন অ্যান্ড দ্য নিউ হিউম্যান
সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়
৭৯৯.০০
পেঙ্গুইন, অ্যালেন লেন
বর্তমান বই কোষ-জীববিদ্যার ক্রমবিবর্তনের ইতিহাস। বইয়ের শুরু রুডলফ ভির্খ-কে দিয়ে, যদিও জীবদেহে কোষের উপস্থিতি বা জীবদেহ মাত্রেই যে অজস্র কোষের সমষ্টি, দুইয়ের কোনওটিই তাঁর আবিষ্কার নয়। সে কৃতিত্ব সপ্তদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে লিউয়েনহুক ও রবার্ট হুক-এর। ভির্খের জন্মই ঊনবিংশ শতকের তৃতীয় দশকে, অর্থাৎ কোষ ‘আবিষ্কার’-এর অন্তত দেড়শো বছর বাদে। তবু বইয়ের শুরু ভির্খ দিয়েই কেন? কেননা, আধুনিক কোষ-জীববিদ্যার সূচনা হয় এই ব্যতিক্রমী চিকিৎসক-গবেষকের হাত ধরে। সেই ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ভির্খ-র যে পর্যবেক্ষণ— কোষ স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে গজিয়ে উঠতে পারে না, একটি কোষ থেকেই আর একটি কোষ জন্মায়— জীবদেহ বলতে আদতে কোষরাষ্ট্র এবং প্রতিটি কোষ সেই রাষ্ট্রের নাগরিক, অসুখের অর্থ বাইরের কোনও শক্তির কারণে নাগরিক-কোষের সঙ্গে কোষ-রাষ্ট্রের সংঘাত— গত পৌনে দুই শতাব্দী ধরে আধুনিক চিকিৎসা-গবেষণা এমন দর্শন আত্মস্থ করেই অগ্রসর হয়েছে।
এই বই, সেই যাত্রারই ইতিহাস। বই যেখানে শেষ হয়, সেখানেও ভির্খ-র উপস্থিতি। কেননা, ভির্খের হাতে কোষ-জীববিদ্যার যে মূল সূত্রগুলোর শুরু, তাঁর মৃত্যুর পরের সওয়া শতাব্দীর গবেষণায় সূত্রগুলো হয়েছে আরও শাণিত, নতুন সূত্র যোগও হয়েছে— কিন্তু ভির্খ-র কথাগুলো বাতিল হয়নি। বইয়ে এরই মাঝে এসেছে অজস্র বিজ্ঞানীর গবেষণার কথা, আবিষ্কারের ঘটনা, বিজ্ঞানীদের জীবনের গল্প এবং তারই সঙ্গে মিলেমিশে গিয়েছে লেখকের নিজের অভিজ্ঞতা। নিত্যনতুন চিকিৎসা, হালের ইমিউনোথেরাপি, স্টেম সেল গবেষণা, ক্যানসার তো বটেই, আরও অনেক দুরারোগ্য অসুখ সারানোর সম্ভাবনার কাহিনি, জিন থেরাপি থেকে জিন এডিটিং এবং তৎসংলগ্ন বিতর্ক ও সংশয়— এসেছে সবই। এসেছে ইন-ভিট্রো ফার্টিলাইজ়েশন, ওরফে টেস্টটিউব বেবি-র সূচনাপর্বের গল্পও। দু’টি কোষের মিলনে জ়াইগোট তৈরি হওয়া এবং সেখান থেকে সম্পূর্ণ মানুষ তৈরি হতে পারা— ক্রমবিভাজনের সঙ্গে সঙ্গে একটি কোষ থেকে বিভিন্ন ধরনের কোষের জন্ম হওয়া, নির্দিষ্ট কাজের জন্য সুনির্দিষ্ট কোষ তৈরি হতে পারা— এমন বিস্ময়ের বিষয় কোষ-জীববিদ্যায় আর কী-ই বা হতে পারে! এমন কাণ্ডখানা যখন গবেষণাগারে ঘটিয়ে ফেলা সম্ভব হয়, সে এক যুগান্তকারী ঘটনা বইকি! ইন-ভিট্রো ফার্টিলাইজ়েশন, সংক্ষেপে আইভিএফ— দেহের বাইরে কৃত্রিম পরিবেশে নিষেক— চিকিৎসাবিজ্ঞানের সবচেয়ে চমকপ্রদ আবিষ্কারগুলোর অন্যতম।
এই আবিষ্কারের গল্প যখন লেখক শোনালেনই, তখন বাঙালির তরফে একটু অনুযোগ রইল। বিশেষত, লেখক যখন বাঙালি, তখন অনুযোগটা সম্ভবত অনুচিত নয়। লেখক ল্যান্ড্রাম শেটলস-এর কথা উল্লেখ করেছেন, বিজ্ঞানের বাইরের বিভিন্ন কারণ গবেষণার পথে বাধা হয়ে না দাঁড়ালে হয়তো তিনিই আইভিএফ-এর আবিষ্কর্তা হিসাবে স্বীকৃতি পেতেন। কিন্তু আমাদের অভাগা গবেষক সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের নামটুকু অন্তত বললেন না! আইভিএফ-এর দৌড়ে তিনি সেকেন্ড বয় হলেও পরবর্তী কালে তাঁর আবিষ্কৃত পথই তো সারা বিশ্ব অনুসরণ করেছে। এই বইয়ে আইভিএফ আবিষ্কারের গল্পে একটি তথ্যগত প্রমাদের উল্লেখও এখানে করে রাখি। রবার্ট এডওয়ার্ডস নোবেল পুরস্কার পান ২০১০ সালে, আইভিএফ আবিষ্কারের তিন দশক বাদে। সিদ্ধার্থবাবু লিখেছেন, দুর্ভাগ্যক্রমে এডওয়ার্ডস মারা যান অনুষ্ঠানের ঠিক আগেই, তাই তিনি হাতে করে পুরস্কার নিতে পারেননি। কিন্তু এডওয়ার্ডস মারা যান ২০১৩ সালে। অসুস্থতার জন্য তিনি সশরীরে উপস্থিত হয়ে নিজের হাতে পুরস্কার নিতে পারেননি, তাঁর তরফে পুরস্কার নেন তাঁর স্ত্রী বিজ্ঞানী রুথ এডওয়ার্ডস। এডওয়ার্ডস-এর হয়ে নোবেল বক্তৃতা দেন তাঁরই পরবর্তী সময়ের সহ-গবেষক মার্টিন জনসন। আশা করি, এটুকু খুঁত লেখক পরবর্তী সংস্করণে শুধরে নেবেন।
আর একটি অনুযোগ, ভির্খ বার বার বলতেন সাধারণ মানুষের প্রতি, বিশেষত গরিব মানুষদের প্রতি, চিকিৎসক ও চিকিৎসাবিজ্ঞানের দায়ের কথা। চিকিৎসা যতই ব্যক্তিমুখী হয়ে উঠছে, চিকিৎসাবিজ্ঞান যেন সে দায় ততই বিস্মৃত হচ্ছে। কোষ-জীববিদ্যা গবেষণার অগ্রগতি এবং সমাজমুখী ভাবনার অন্তর্ধান— ভির্খ-র কথা এত বার বলেও লেখক এই বৈপরীত্য ও সংঘাতের জায়গাটা সে ভাবে গুরুত্ব সহকারে ধরলেন না কেন?
ট্রিলজি উত্তরোত্তর যত এগিয়েছে, পাঠকের প্রতি লেখকের প্রত্যাশাও বেড়েছে। প্রথম বইটি যে কোনও প্রাপ্তমনস্ক পাঠককেই আকর্ষণ করতে সক্ষম, দ্বিতীয়টি পড়ার সময় জিন ও আনুষঙ্গিক বিষয়ে পাঠকের অন্তত প্রাথমিক ধারণা থাকলে ভাল হয়, আর এই বইটি পড়ার আগে বিষয় সম্পর্কে বেশ খানিকটা জ্ঞান না থাকলে সম্পূর্ণ রসাস্বাদন সম্ভব নয় বলেই মনে হয়। এই আপেক্ষিক দুরূহতার কারণ লেখকের ব্যর্থতা নয়, কারণ বিষয়টির ক্রমশ জটিল থেকে জটিলতর হয়ে ওঠা এবং সেই জটিলতাকে পাশ কাটাতে বিষয়ের লঘুকরণে লেখকের অনীহা, যাকে লেখকের গুণই বলা যায়।
আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের ক্রমবিবর্তন বুঝতে হলে তিনটি বই-ই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সীমাবদ্ধতা বলতে, এ শুধুই বিজ্ঞানীর দৃষ্টিতে দেখা ইতিহাস। কোনও এক দিন সমাজবিজ্ঞানী-ইতিহাসবিদরাও এগিয়ে এসে বাকি গল্পটা সম্পূর্ণ করবেন নিশ্চয়ই।