সত্যজিৎ রায়। — ফাইল চিত্র।
তিনি নিজেই বলেছেন, চিত্রপরিচালক না হলে শুধুই সঙ্গীতস্রষ্টা হতেন। সত্যজিৎ রায় যদিও তাঁর সৃষ্ট চলচ্চিত্রের জন্যই সঙ্গীত সৃষ্টি করতেন, তা তাঁর চলচ্ছবির অবিভাজ্য উপাদানও, এবং শুধুমাত্র সঙ্গীত হিসাবেও সাধারণ ও দীক্ষিত, দুই শ্রেণির শ্রোতার কাছেই তা সমাদৃত। সত্যজিৎ-শতবর্ষে তাঁর সঙ্গীত বিষয়ে আলোচ্য বইটির কথা এই প্রসঙ্গে চলে আসে। এ বিষয়ে আমরা ইতিমধ্যেই পড়েছি সুধীর চক্রবর্তীর বাংলা ফিল্মের গান ও সত্যজিৎ রায় (১৯৯৪) এবং অতনু চক্রবর্তীর সিনেমাসঙ্গীত ও সত্যজিৎ (২০০৩)। সুধীরবাবু যদিও সত্যজিতের ছবিতে কেবল গানের ব্যবহার বিষয়ে তাঁর আলোচনা সীমায়িত রেখেছেন, শিল্পীর জীবন-বিশ্বাস-শিক্ষা-শিল্পকৌশল-ইতিহাসচেতনা ইত্যাদির পুঙ্খানুপুঙ্খ বিস্তার ও বিশ্লেষণে সেই আলোচনা এ বিষয়ে লেখা অবশ্যপাঠ্য গ্রন্থের মর্যাদা পায়। অতনুবাবুর বইটিতে গান এবং আবহসঙ্গীত দুই নিয়েই আলোচনা রয়েছে। সত্যজিৎ-সৃষ্ট চলচ্চিত্রের গঠন ও মুভমেন্ট বা চলনের সঙ্গে সঙ্গীতের চলন ও গঠনের সাযুজ্য নির্ণয় করে রেখাচিত্র-সহ সেই আলোচনা বিস্তৃত প্রতিটি ছবি প্রসঙ্গে। এমনকি অনির্মিত কিন্তু পরিকল্পিত ছবি দি এলিয়েন-এর সম্ভাব্য গানের প্রসঙ্গও আলোচিত হয়েছে। বাদ পড়েনি সত্যজিতের ছবির অন্য সঙ্গীত পরিচালকদের কথাও।
আলোচ্য বইটিতেও লেখক এক-একটি ছবির সঙ্গীতমুহূর্ত আলোচনা করতে করতে এগিয়েছেন। এই আলোচনা অবশ্যই এক জন বাদ্যযন্ত্রীর দৃষ্টিকোণ থেকে। তিনি নিজে এক জন সঙ্গীত পরিচালকও বটে। সত্যজিতের ঘরে বাইরে ছবির সঙ্গীত গ্রহণের সময়ে ভায়োলিন বাজানোর বিরল সৌভাগ্য তাঁর। সেই সময় থেকেই সত্যজিতের লেখা স্কোর এবং তাঁর সমগ্র সঙ্গীত নিয়ে লেখকের আগ্রহ জন্মায়। নতুন করে প্রতিটি ছবি তিনি দেখতে ও শুনতে থাকেন। এই বইটিতে তাঁর আরব্ধ পর্যবেক্ষণ স্থান পেয়েছে। এক জন চর্চারত সঙ্গীতশিল্পীর সত্যজিৎ-সঙ্গীত সম্পর্কে নিজস্ব অনুভূতি ও উপলব্ধির একটা আলাদা মূল্য আছে। বার বার লেখক ফিরে যান সত্যজিতের সৃষ্টির কাছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, সাম্প্রতিক কালে সত্যজিতের জীবনভিত্তিক কাহিনিচিত্র অনীক দত্ত পরিচালিত অপরাজিত-র সঙ্গীতস্রষ্টাও তিনি।
কম্পোজ়ার সত্যজিৎ: স্বর সুর ও চিত্রভাষ
দেবজ্যোতি মিশ্র
৩৫০.০০
দে’জ় পাবলিশিং
তাঁর আলোচনা শুধুই সঙ্গীতে আটকে থাকে না। ছবিগুলির বিভিন্ন মুহূর্ত তিনি আবিষ্কার করেন, বর্ণনা করেন নিজের বোধে জারিত করে। পাঠক সেই সব বক্তব্যের সঙ্গে একমত না-ই হতে পারেন, কিন্তু ভাষার গুণে সুখপাঠ্য এই পুনঃকথন। তবে এই বর্ণন আগাগোড়া ‘সাবজেক্টিভ’, এবং এখানেই উল্লিখিত বইগুলির সঙ্গে এর অমিল। সুধীরবাবুরা আদ্যোপান্ত ‘অবজেক্টিভ’। স্বরলিপি পড়তে পারেন এমন পাঠকদের জন্য এই বইটিতে রয়েছে সত্যজিতের করা বেশ কিছু সঙ্গীতের স্বরলিপি, যার আর্কাইভ্যাল মূল্য অপরিসীম। কিছু আলোকচিত্রও বইটিকে সমৃদ্ধ করেছে। বইটির অলঙ্করণ স্বয়ং লেখকের, অঙ্কনশিল্পী হিসাবেও তাঁর মুনশিয়ানা প্রকাশ পায়।
দু’-একটি তথ্যের ভুল হয়তো এড়ানো যেত। যেমন রবীন্দ্রনাথ তথ্যচিত্রে সমবেত কণ্ঠে গাওয়া গানগুলি আইপিটিএ-র শিল্পীদের নয়, ‘গীতবিতান’-এর শিল্পীদের গাওয়া। ছবির টাইটল কার্ডেই তার উল্লেখ আছে। জয় বাবা ফেলুনাথ ছবিতে শেষ ব্যবহৃত ভজনটি ‘পাগ ঘুঙরু বাঁধ মীরা’, তার একটি লাইন ‘ম্যায় তো মেরি নারায়ণ কী’।শতরঞ্জ কে খিলাড়ি আর আগন্তুক-এর মতো দু’টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছবির আলোচনা কেন এই বইয়ে স্থান পায়নি, বিশেষত ছবি দু’টি গানের ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিশিষ্ট বলে, সেটিও ভাবায়।