শিল্পী: শুধু নামী সঙ্গীতকারই নন, দক্ষ গল্পকার, কবি, রাজনীতি-সচেতন কর্মীও ছিলেন সলিল চৌধুরী
দূর আকাশের আখরে উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র সঙ্গীতকার সলিল চৌধুরী। না, তাঁর সামগ্রিক জীবন নয়, এই উপন্যাসের মধ্যে ধরা পড়েছে সলিল চৌধুরীর জীবনের প্রথম পর্বের এক বিরাট অংশ। ১৯২০ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত বিস্তৃত সময়কাল এই উপন্যাসের পটভূমি। এই পটভূমি তৈরি করতে স্বাভাবিক ভাবেই ব্যক্তি সলিল ও তাঁর পরিবার-পরিজনদের পাশাপাশি গোটা একটা যুগের সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষিতটি তৈরি করতে হয়েছে লেখক তৃণাঞ্জন চক্রবর্তীকে। সময়, রাজনীতি, সঙ্গীত, সাহিত্য অর্কেস্ট্রার মতো বেজেছে এই উপন্যাসে।
এ বছর ১৯ নভেম্বর শতবর্ষে পদার্পণ করছেন সলিল চৌধুরী। তিনি এমন এক যুগান্তকারী সঙ্গীতকার, যিনি শুধু তাঁর সময়ের থেকে অনেকটা এগিয়ে ছিলেন না, ছিলেন এক জন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কবি ও গল্পকার। পাশাপাশি তিনি ছিলেন চল্লিশের দশকের এক জন নিবেদিতপ্রাণ কমিউনিস্ট কর্মী। স্বভাবতই তাঁর জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে সম্পূর্ণ একটা যুগের আবেগ, আশা, স্বপ্ন এবং স্বপ্নভঙ্গের ইতিহাস। এই ধরনের চরিত্র নিয়ে উপন্যাস প্রথম নয়। আরভিং স্টোন মিকেলাঞ্জেলোর জীবন কেন্দ্র করে লিখেছিলেন দি অ্যাগনি অ্যান্ড দি এক্সট্যাসি এবং তাঁর আর একটি উল্লেখযোগ্য লেখা ভ্যান গঘের জীবনভিত্তিক উপন্যাস লাস্ট ফর লাইফ। এ দেশেও বিখ্যাত সাহিত্যিকদের হাতে সৃষ্টি হয়েছে সমগোত্রের অপূর্ব সব আখ্যান। উপন্যাসের সেই ঐতিহ্যকে লেখক আত্মস্থ করতে পেরেছেন।
পড়তে গিয়ে এই ধরনের তুলনা স্বাভাবিক ভাবেই মনে এসে যায়, আসলে কোনও জগৎ-বন্দিত শিল্পীর জীবনভিত্তিক উপন্যাসের রচনাশৈলীর একটা নির্দিষ্ট ধারা আছে, হয়তো সেই কারণেই মনে এসে যায়। যদিও এই বই উপরোক্ত উপন্যাস দু’টির সঙ্গে কোনও রকম তুলনার আওতার বাইরে দাঁড়িয়ে নিজের স্বাতন্ত্র্যেই অভিনব, বিষয় নির্বাচন এবং লেখার মুনশিয়ানার গুণে বইটি হয়ে উঠেছে মহত্তর। ব্যক্তিগত ভাবে আমার নিজের যে-হেতু এই বিরাট, অসামান্য জীবনকে বেশ কিছুটা সময় খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে, তাই আমি বুঝতে পারি যে, সেই জীবনের কথা এই ভাবে সহজ ছন্দে বইয়ে প্রকাশ করতে পারা ঠিক কতটা কঠিন। এ কথা ভাবতে ভাল লাগে যে, এই সময়ে দাঁড়িয়ে সলিল চৌধুরীর মতো এমন এক উজ্জ্বল, বর্ণময় ও জটিল জীবনপ্রবাহকে উপন্যাসের আকারে মেলে ধরার সফল চেষ্টা করা গিয়েছে। উল্লেখ্য, বইটির প্রচ্ছদ পাঠকের সামনে অনেক দূর বিস্তৃত এক দিগন্ত খুলে দেবে, পার্থপ্রতিম দাস এমনই অদ্ভুত সুন্দর এক প্রচ্ছদ উপহার দিয়েছেন। যে ছবির মধ্য থেকে দেশভাগ, যাযাবর জীবন, সঙ্গীত, রাজনৈতিক টানাপড়েন, সবটুকু উঠে এসেছে বলা যেতে পারে।
উপন্যাসের প্রথম পর্বে আছে সলিল চৌধুরীর জীবনের প্রস্তুতিপর্ব। এই প্রস্তুতিপর্বে দেখতে পাব পিতা জ্ঞানেন্দ্রনাথ চৌধুরীর সাহচর্যে পশ্চিমি সিম্ফনির গান শুনতে শুনতে কী ভাবে সলিল চৌধুরীর সঙ্গীতের কান তৈরি হচ্ছে তার বর্ণনা। বালক সলিল বৃষ্টিধারা, ব্যাঙের ডাক, ঝিঁঝির শব্দের মধ্যে শুনতে পান প্রকৃতির সিম্ফনি। প্রথমে তাঁর বাবার সান্নিধ্যে, পরে কলকাতায় এসে ছোড়দার সান্নিধ্যে তাঁর বালকবয়সের সঙ্গীতশিক্ষার সূচনাপর্বটি অত্যন্ত দক্ষতা ও যত্নের সঙ্গে বুনে তোলা হয়েছে। সঙ্গীতকার সলিল চৌধুরীর বিকাশে এই পর্বটির গুরুত্ব অপরিসীম। পাশাপাশি তাঁর প্রস্তুতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে তাঁর সমকালেরও। সেই যুগের আবহটিও এই উপন্যাসের আকর্ষণের মাত্রাকে অনেকটা বাড়িয়ে তুলেছে। তখনও রবীন্দ্রনাথ জীবিত। সবে আত্মপ্রকাশ ঘটেছে নজরুলের। পাশাপাশি আছেন নজরুলের সুহৃদ ও শুভানুধ্যায়ী মুজফ্ফর আহমেদ, কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা।
দূর আকাশের আখরে
তৃণাঞ্জন চক্রবর্তী
৪৯৯.০০
সৃষ্টিসুখ
সবে তখন তৈরি হচ্ছে কমিউনিস্ট পার্টি। কিছু পরেই সাহিত্যে আসছে কল্লোল যুগ। সেই সূত্রেই উপন্যাসে এসেছে বুদ্ধদেব বসু, প্রেমেন্দ্র মিত্র, অচিন্ত্য সেনগুপ্তদের প্রসঙ্গ। এসেছে পরাধীন ভারতে ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের কথা। এ ভাবে তৈরি হচ্ছিল সলিল চৌধুরীর আবির্ভাবের সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতটি।
উপন্যাসের প্রথম অংশে সমান্তরাল ভাবে দুটো ধারা বয়ে গেছে। এক দিকে পারিবারিক আবহে সলিল চৌধুরীর শিশুকাল থেকে বড় হয়ে ওঠা। অন্য দিকে সমকালের সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষিতের আখ্যান। তার পর সলিল যখন নিজেই সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রের প্রধান কুশীলবদের এক জন হয়ে উঠেছেন, তখন এই দুটো ধারা এক সঙ্গে মিশে গেছে। কখনও পড়তে পড়তে মনে হয়নি এর ফলে উপন্যাসের রচনাপ্রবাহ কোথাও বিঘ্নিত হয়েছে।
বাল্যে সঙ্গীতপ্রেমী পিতা জ্ঞানেন্দ্রনাথের সান্নিধ্য, সঙ্গীতশিল্পী ছোড়দার অনুপ্রেরণা, যৌবনে জ্যোতির সঙ্গে প্রেম এই উপন্যাসে অত্যন্ত জীবন্ত হয়ে উঠেছে। ব্যক্তিজীবনের পাশাপাশি তাঁর রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের আখ্যানভাগটিও একই ভাবে চিত্তাকর্ষক ও আকর্ষণীয়। ভারতীয় গণনাট্যের স্বর্ণযুগের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছে সলিল চৌধুরীর জীবন ও সৃষ্টির এক বড় অংশ। এই পর্বে এসেছেন জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, দেবব্রত বিশ্বাস, ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন, সুকান্ত ভট্টাচার্যের মতো বিরল ও উজ্জ্বল চরিত্র। আছে আরও অনেক চরিত্রের মিছিল। সেই মিছিলে এসেছে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কথা। এক-একটা যুগান্তকারী গান তৈরির নেপথ্য-কাহিনিগুলো এই উপন্যাসে বিশেষ ভাবে আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। এক জন শিল্পী ও স্রষ্টার সঙ্গে সুরের মাধ্যমে সময়ের সঙ্গে কথোপকথনের বিবরণ এই আখ্যানের ফাঁকে ফাঁকে এসে আখ্যানকে আরও স্বাদু করে তুলেছে।
উপন্যাসের ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, স্বপ্নভঙ্গ, স্বাধীনতা, দেশভাগের পাশাপাশি উপন্যাসে এসেছে কমিউনিস্ট আন্দোলনে হঠকারী রণদিভে পর্ব। সেই সঙ্গে এসেছে আন্ডারগ্রাউন্ড জীবনের বর্ণনা। এক জন সৃষ্টিশীল সঙ্গীতকারের সঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টির পারস্পরিক সম্পর্কের বিবরণ এই উপন্যাসে একটি আলাদা প্রাপ্তি। কমিউনিস্ট পার্টি সঙ্গীতকারের কাছে দাবি করছে তাৎক্ষণিক রাজনৈতিক চাহিদা পূরণের উপযুক্ত গান। অর্থাৎ, খোলা মঞ্চে সেই গান বেঁধে গেয়ে ফেলার নির্দেশ। কিন্তু এক জন প্রকৃত সঙ্গীতকার ধরতে চান তাৎক্ষণিকতার ঊর্ধ্বে থাকা এক দীর্ঘ সময়কালকে। ফলে কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে তৈরি হচ্ছে বিচ্ছিন্নতা। এই সূত্রেই ‘কোনও এক গাঁয়ের বধূ’ গানটি সম্পর্কে কমিউনিস্ট পার্টির যান্ত্রিক প্রতিক্রিয়ার কথাও উপন্যাসের আখ্যানে এসে পড়েছে। তার পর এসেছে সলিল চৌধুরীর বম্বে-যাত্রার পর্ব। বম্বে-জীবনের প্রথম পর্বে এসে উপন্যাস শেষ হয়েছে।
ইতিহাসকে কেন্দ্র করে লেখা সার্থক উপন্যাসকে ইতিহাস অতিক্রম করে ধরতে হয় সমসময়ের আত্মাকে। কোনও না কোনও ভাবে সমসময়ের সঙ্গে এক ধরনের কথোপকথনে লিপ্ত হতে হয়। তা ছাড়া তা ইতিহাসের দলিলমাত্র হয়ে রয়ে যায়, সার্থক উপন্যাস হয়ে উঠতে পারে না। এই উপন্যাসে কমিউনিস্ট আন্দোলনের স্বপ্নভঙ্গের যে ইতিবৃত্ত রচিত হয়েছে তা আমাদের কালেও প্রাসঙ্গিক। কমিউনিস্ট আন্দোলনের স্বপ্নভঙ্গের যে বেদনা গায়ে মেখে সলিল চৌধুরীর বম্বে যাত্রা, সেই স্বপ্নভঙ্গের মধ্যে আছে সমসময়ের ব্যঞ্জনা। বস্তুত কমিউনিস্ট আন্দোলনের এক বিপুল মাত্রার ব্যর্থতার যুগে আমরা আমাদের জীবন অতিবাহিত করছি। ফলে এই উপন্যাসের মধ্যে এসে পড়েছে সমসাময়িকতার ব্যঞ্জনা।
এই উপন্যাস সঙ্গীতরসিক বাঙালি পাঠকের অবশ্যপাঠ্য। বাংলার এক মহান শিল্পসাধক তথা সঙ্গীতকারের ধীরে ধীরে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠার আখ্যান এই উপন্যাস। এক বিশেষ সময়ের এক মহৎ জীবনের কথামালা হিসাবে উপন্যাসটি দীর্ঘায়ু হবে।
দেবজ্যোতি মিশ্র