Book Review

আয়নায় নৈতিক সংঘাতের মুখ

বইটির কাঠামো ব্যতিক্রমী। স্মৃতিচারণ, অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজবিজ্ঞান, সমাজমাধ্যম, মহামারিবিদ্যা— অনেক কিছুরই সংমিশ্রণ।

Advertisement

অতনু বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ২৯ মার্চ ২০২৫ ১০:৪৪
Share:

কানাডিয়ান লেখক নাওমি ক্লেইন-এর বইটির রসাস্বাদন করতে গিয়ে প্রথমেই বুঝতে চেষ্টা করি ‘ডপলগ্যাঙ্গার’ শব্দটির অন্তর্নিহিত অর্থ। এর আভিধানিক অর্থ অন্যের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ এক জন ব্যক্তি। মূল জার্মান ভাষায় ‘ডপলগ্যাঙ্গার’ মানে ‘ডাবল ওয়াকার’। সে যেন এক ছায়ারূপ, হয়তো বা অল্টার ইগো।

Advertisement

প্রাথমিক ভাবে ‘ডপলগ্যাঙ্গার’-এর সঙ্গে কারও সাদৃশ্য হয়তো মজার উদ্রেক করতে পারে খানিকটা। যেমনটা হয়েছিল নাওমি ক্লেইন-এরও। কিন্তু ভুক্তভোগীরা ক্লান্ত হন ক্রমে। হন হয়রান। বিখ্যাত মানুষের ক্ষেত্রে বিপরীত মতাদর্শের কোনও বিখ্যাত মানুষের সঙ্গে অসম সাদৃশ্যের সংঘাতের শিকার হতে হলে কী হতে পারে, তার এক দলিল এই বইটি।

বইটির কাঠামো ব্যতিক্রমী। স্মৃতিচারণ, অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজবিজ্ঞান, সমাজমাধ্যম, মহামারিবিদ্যা— অনেক কিছুরই সংমিশ্রণ। তবে এর ভরকেন্দ্রে অবশ্যই লেখকের ডপলগ্যাঙ্গার, ‘অন্য নাওমি’, যাকে ঘিরে আবর্তিত হয় বইটির কথামালা। এই অন্য নাওমি— অর্থাৎ নাওমি উল্ফ— ‘থার্ড ওয়েভ ফেমিনিস্ট’ আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা লেখক। দুই নাওমির মধ্যে বিস্তর মিল। দু’জনেই উত্তর আমেরিকার শ্বেতাঙ্গ ইহুদি লেখক। দু’জনেরই স্বামীর নাম আব্রাম। দু’জনেই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে বেস্টসেলার বই লিখেছেন ১৯৯০-এর দশকে। আমেরিকান লেখক উল্ফ ১৯৯১-তে লিখেছেন দ্য বিউটি মিথ: হাউ ইমেজেস অব বিউটি আর ইউজ়ড আগেনস্ট উইমেন-এর মতো বই। আর বামপন্থী লেখক ও কর্মী ক্লেইন-এর ১৯৯৯-এর বই নো লোগো নব্বইয়ের দশকের সক্রিয়তাকে বিশ্বায়নের রাজনৈতিক অর্থনীতির সঙ্গে সংযুক্ত করেছে।

Advertisement

ডপলগ্যাঙ্গার: আ ট্রিপ ইনটু দ্য মিরর ওয়ার্ল্ড

নাওমি ক্লেইন

৫৯৯.০০ পেঙ্গুইন বুকস

উল্ফের নারীবাদ মূলধারার ডেমোক্র্যাট রাজনীতির পক্ষে মানানসই-ই ছিল, এমনকি বিল ক্লিনটনের প্রচার-উপদেষ্টা হওয়া পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে তার পরিধি। অল্প বয়সে ক্লেইন নিজেও প্রশংসা করতেন উল্ফের, এমনকি তাঁর সাক্ষাৎকারও নিয়েছিলেন তিনি। এবং বহু দিন ধরেই দু’জনকে গুলিয়ে ফেলছে জনগণ। সেটা তখন হয়তো এতটা সমস্যার ছিল না। অভিঘাতটা প্রকট হয়েছে হালে, যখন দু’জনের মতাদর্শ ভিন্ন মেরুর। সময়ের সঙ্গে এক নারীবাদী বুদ্ধিজীবী থেকে উল্ফ পালটে যান তীব্র ভ্যাকসিন ও লকডাউন-বিরোধীতে। অতিমারির সময় অনলাইনে এবং বই লিখে উল্ফ তীব্র ভাবে প্রকাশ করতে থাকেন তাঁর ভ্যাকসিন-বিরোধিতা এবং ভ্যাকসিন নিয়ে চক্রান্তের তত্ত্ব। সোশ্যাল মিডিয়ার আবর্তে নাওমি ক্লেইনের সঙ্গে আরও যেন গুলিয়ে যায় নাওমি উল্ফ-এর নাম, যাকে ক্লেইন বলেছেন তাঁর বড়-চুলযুক্ত ডপলগ্যাঙ্গার।

বইটির উপশিরোনামে আছে ‘আ মিরর ওয়ার্ল্ড’ শব্দগুচ্ছ। প্রতিরূপ এখানে দর্পণে প্রতিবিম্বিত। সুপ্রযুক্ত রূপক। প্রগতিশীল নাওমির বামপন্থী ভাবধারার বিপ্রতীপে প্রতিবিম্বিত নাওমি উল্ফ এখন বড়ই রক্ষণশীল। এ তাই প্রতিচ্ছবি, কিন্তু পুরোটাই যেন উল্টো করে নির্মিত। বইটিতে এই অস্তিত্বের দ্বন্দ্ব বোঝাতে একটা টুইটার-লিমেরিকও জুড়ে দিয়েছেন ক্লেইন: “ইফ দ্য নাওমি বি ক্লেইন/ ইউ আর ডুয়িং জাস্ট ফাইন/ ইফ দ্য নাওমি বি উল্ফ,/ ওহ্‌ বাডি। উউউফ।”

‘অন্য নাওমি’র সঙ্গে তাঁকে গুলিয়ে ফেলার বিষয়টাকে প্রথমে অতটা গুরুত্ব দেননি নাওমি ক্লেইন। কিন্তু তিনি ক্রমেই আবিষ্ট হন উল্ফ-এর কার্যপ্রণালীর হদিস রাখায়। অতিমারির সময় স্টিভ ব্যাননের পডকাস্টে উল্ফের বক্তব্য শোনেন তিনি। ট্রাম্পের প্রাক্তন প্রচার-ম্যানেজার এই ব্যানন, ক্লেইন যাকে বলছেন ইটালি থেকে ব্রাজিলে স্বৈরাচারী এবং নব্য ফ্যাসিবাদী আন্দোলনের এক পূর্ণসময়ের প্রচারক। মোট কথা, এড়িয়ে না গিয়ে, অনলাইন সংস্কৃতি এবং রাজনৈতিক মতাদর্শের এক মানদণ্ডে ক্লেইন বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেন তাঁর ডপলগ্যাঙ্গার-এর। এবং বৃহত্তর অর্থে তাঁর ‘মিরর ওয়ার্ল্ড’-এর অন্যান্য বাসিন্দাদেরও। বোঝার চেষ্টা করেন তাঁদের ব্যস্ততা ও জনপ্রিয়তার রসায়নটুকু।

সেই সঙ্গে এই বইয়ে নাওমি ক্লেইন বুঝতে চান ষড়যন্ত্র এবং ভুল তথ্যের এক অন্তঃসলিলা, বিমূর্ত অনলাইন-দুনিয়ার রহস্যও। রাজনৈতিক প্রগতিশীলদের অসাবধানতায় ইন্ধন পেয়ে কী ভাবে এর উত্থান হয়েছে, তার বিশ্লেষণ করেন তিনি। বইটিতে একটা সমীকরণ দিয়েছেন ক্লেইন। ‘নার্সিসিজ়ম (মহানুভবতা) + সোশ্যাল মিডিয়ায় আসক্তি + মধ্যজীবনের সঙ্কট + জনগণের সামনে মাথা নিচু করা = দক্ষিণপন্থার বাড়বাড়ন্ত।’ কিন্তু অতিমারি চলাকালীন ‘মিরর ওয়ার্ল্ড’ থেকে উদ্ভূত ষড়যন্ত্রকে রুখতে বামপন্থীদের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন ক্লেইন। বলেছেন এক বিভক্ত দুনিয়ার কথা। ষড়যন্ত্র তত্ত্বের প্রবক্তারা তথ্যকে ভুল বলে দাগিয়ে দেন, কিন্তু প্রায়শই অনুভূতির বর্ণনায় তাঁরা সঠিক— এমনটাই কিন্তু বলেছেন ক্লেইন। সেই সঙ্গে ক্লেইন কিন্তু নিরন্তর প্রশ্ন করে চলেন নিজের বিশ্বাসকেও।

প্রতিরূপ-জনিত বিড়ম্বনার সঙ্গে ওতপ্রোত জড়িয়ে থাকায় অতি-গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গগুলি কি হালকা হয়ে গিয়েছে বইটির চৌহদ্দিতে, না কি তা পেয়েছে এক ফিকশনের আকর্ষণ? কী জানি! বইটিতে সাহিত্য-সংস্কৃতি থেকে উদাহরণ রয়েছে অনেক ডপলগ্যাঙ্গার-এর। দ্য স্ট্রেঞ্জ কেস অব ডক্টর জেকিল অ্যান্ড মিস্টার হাইড, দ্য গ্রেট ডিক্টেটর, গ্রাহাম গ্রিনের ওয়েজ় অব এসকেপ, ফিলিপ রথের অপারেশন শাইলক। আসলে সমাজ-ধর্ম-জাতি-দেশ ভেদে আমরা সবাই বোধ করি কোনও না কোনও ডপলগ্যাঙ্গার-সংস্কৃতির বাসিন্দা। বহুত্ববাদী সমাজের থাকে ফ্যাসিবাদী ডপলগ্যাঙ্গার। ইহুদি ও খ্রিস্টানরা পরস্পরের ডপলগ্যাঙ্গার। নিউ সাউথ ওয়েলস আবার সাউথ ওয়েলসের ডপেলগ্যাঙ্গার। বইটি প্রকাশিত হয়েছে পশ্চিম এশিয়ার বর্তমান তাণ্ডবের আগে। বইটিতে ইজ়রায়েলকে ‘ঔপনিবেশিক প্রকল্পের— বিশেষ করে বসতি স্থাপনকারী উপনিবেশবাদের— ডপলগ্যাঙ্গার’ হিসাবেই কিন্তু বর্ণনা করেছেন ইহুদি লেখক নাওমি ক্লেইন।

আশ্চর্যজনক ভাবে, সাম্প্রতিক কালে লেখা হলেও, এই বইটিতেও ক্লেইন কিন্তু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ডিপফেক ইত্যাদির মাধ্যমে নির্মিত আজকের দুনিয়ার ডপলগ্যাঙ্গার-এর বিপদ সম্পর্কে নীরব। বরং কী ভাবে ডিজিটাল জীবন, সমসাময়িক পুঁজিবাদ, একবিংশ শতাব্দীর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়গুলি আমাদের আহত করে, তার আংশিক বর্ণনা দেয় বইটি। আজ যখন পুনর্নির্বাচিত ডোনাল্ড ট্রাম্প ওভাল অফিসের দায়িত্ব নিয়ে বসেছেন নতুন উদ্যমে, নাওমি ক্লেইনের বামপন্থী মতাদর্শের ‘মিরর ওয়ার্ল্ড’টা তার ডানা ছড়াবে, এটাই প্রত্যাশিত।

ক্লেইন তাঁর বিষয়বস্তুকে আবদ্ধ রাখেন না কোনও বাইনারির মধ্যে। ডপলগ্যাঙ্গার যেন খরগোশের গর্ত গলে ঢুকে পড়ে এক আশ্চর্য দুনিয়ায়, যার মধ্য দিয়ে ক্লেইন বিচরণ করেন বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে। যেন কোনও এক ‘লুকিং গ্লাস’-এর মাধ্যমেই তিনি সংশ্লেষ করে চলেন আজকের বিভ্রান্তিকর ও অস্থির রাজনৈতিক পরিমণ্ডলকে। বোঝার চেষ্টা করেন আমাদের রাজনৈতিক অস্থিরতার অযৌক্তিকতা আর বিড়ম্বনাকে। চেষ্টা করেন পাঠককে বোঝানোর। ‘মিরর ওয়ার্ল্ড’ থেকে উদ্ভূত যন্ত্রণাদায়ক প্রতারণা এবং ভয়ের কোনও সহজ প্রতিষেধক নেই। তবে ক্লেইন যুক্তি দেন, “জাতি, জাতি, লিঙ্গ বা ধর্মনির্বিশেষে শ্রমিক শ্রেণির সদস্যদের মধ্যে ঐক্যই একমাত্র দিতে পারে একটি সুন্দর পৃথিবী জয়ের সুযোগ।”

পড়তে পড়তে একটা কথা মনে হচ্ছিল বার বার। বইটির অভিঘাত অন্য নাওমির পক্ষে কেমন? নাওমি উল্ফকেও নির্ঘাত বিব্রত হতে হয়েছে তাঁর ডপলগ্যাঙ্গার নাওমি ক্লেইন-এর জন্য, এবং এই বইটির জন্য। এ জন্য কি ক্লান্ত হননি উল্ফ? নাওমি উল্ফের উইকিপিডিয়া পেজে বলা আছে, নাওমি ক্লেইন-এর সঙ্গে গুলিয়ে না ফেলতে। ভিন্ন মতের শরিক হলেও এক ‘সিনিয়র’ লেখককে ব্যক্তিগত পর্যায়ে বিড়ম্বনায় ফেলার মতো প্রসঙ্গের অবতারণা কতটা স্বস্তিকর? ক্লেইন কি উপেক্ষা করতে পারতেন না এই অন্য নাওমিকে? ব্যক্তির প্রসঙ্গ না এনেও তাঁর কলম কি চেষ্টা করতে পারত না তাঁর ডপলগ্যাঙ্গার-এর মতবাদ ছাপিয়ে উঠতে?

কেমন হয়, যদি নাওমি উল্ফও লেখেন আর একটা ডপলগ্যাঙ্গার, ‘ফ্রম ইনসাইড দ্য মিরর’? চক্রান্ত তত্ত্বে বিশ্বাসী, ভ্যাকসিন-বিরোধী মানসিকতার প্রগতিশীল এক জন লেখক থেকে পরিবর্তিত রক্ষণশীল দক্ষিণপন্থীর চোখে এক বামপন্থী লেখকের সঙ্গে তাঁর অনভিপ্রেত সাদৃশ্যের সংঘাতের চিত্ররূপ!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement