চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১

স্বাভাবিকতার ভিতরেই কল্পরূপের আগমন

সম্প্রতি আইসিসিআর-এ অনুষ্ঠিত আলোকচিত্র ও চিত্রকলার প্রদর্শনীটি দেখলেন মৃণাল ঘোষআলোকচিত্র ও চিত্রকলা— এখন পরস্পরের পরিপূরক হয়ে গেছে প্রায়। দুটি মাধ্যম এখন একে অন্যের সহযোগী। শুধু মাত্র স্বাভাবিকতাকে পঞ্জীকরণের দায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে আলোকচিত্র এখন চিত্রের নানা রহস্যময় পরিসরকে আত্মস্থ করে আরও প্রাণবন্ত হয়ে ওঠার চেষ্টা করছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৬ অগস্ট ২০১৬ ০০:০০
Share:

আলোকচিত্র ও চিত্রকলা— এখন পরস্পরের পরিপূরক হয়ে গেছে প্রায়। দুটি মাধ্যম এখন একে অন্যের সহযোগী। শুধু মাত্র স্বাভাবিকতাকে পঞ্জীকরণের দায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে আলোকচিত্র এখন চিত্রের নানা রহস্যময় পরিসরকে আত্মস্থ করে আরও প্রাণবন্ত হয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। উত্তর-আধুনিকতা আলোকচিত্রকে অনেক মর্যাদাময় শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে। পাশ্চাত্যে এটা ঘটেছে ১৯৬০-এর দশক থেকে। আমাদের দেশে সেই ঢেউ এসে পৌঁছেছে ১৯৯০-এর দশকে। আলোকচিত্র ও চিত্রকলার যুগলবন্দি প্রদর্শনী এখন প্রায়ই ঘটে থাকে।

Advertisement

সে রকমই একটি প্রদর্শনী হল সম্প্রতি আইসিসিআর-এর যামিনী রায় গ্যালারিতে ‘আকার’ নামে একটি শিল্প-সংস্থার উদ্যোগে। একজন আলোকচিত্রী ও একজন চিত্রকরের কাজ দেখানো হল একসঙ্গে। মধু সরকার প্রখ্যাত আলোকচিত্রী। ‘ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অব ফোটোগ্রাফি’ নামে একটি কলকাতা-ভিত্তিক আলোকচিত্র গবেষণা ও অনুশীলন কেন্দ্রের কর্ণধার তিনি। সৃজনময় আলোকচিত্র নিয়ে তাঁর গবেষণা দীর্ঘ দিনের। প্রখ্যাত প্রবীণ শিল্পী মিলন মুখোপাধ্যায়। মুম্বইতে তিনি আছেন দীর্ঘদিন। এক সময় ‘দেশ’ সাপ্তাহিকে তাঁর ‘মুখ চাই মুখ’ নামে একটি ধারাবাহিক লেখা খুব সাড়া জাগিয়েছিল। এই দুই শিল্পীর নামকে মিলিয়ে প্রদর্শনীর শিরোনাম দেওয়া হয়েছে ‘মিলন-মধু’।

শিল্পী: মধু সরকার।

Advertisement

এ রকম একটি প্রদর্শনীতে একটি অসম্পূর্ণতার জায়গা থেকে গেছে। তা হল এই— শিল্পীদ্বয় ও তাঁদের কাজ সম্পর্কিত তথ্য-পঞ্জীকরণের উপর একেবারেই গুরুত্ব দেননি আয়োজক সংস্থা। শিল্পীদের কোনও জীবনপঞ্জি নেই। ছবিতে কোনও ক্যাপশনও ছিল না। একটি স্মারক-পত্র অবশ্য করা হয়েছে। সেটি সুপরিকল্পিত হলে প্রদর্শনীটি আরও সমৃদ্ধ হত।

মধু সরকারের আলোকচিত্রের বৈশিষ্ট্য, তিনি স্বাভাবিকতার ভিতরই কল্পরূপের অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছেন। এই সমন্বয়ের মধ্য দিয়ে যে রহস্যের বাতাবরণ তৈরি করেছেন, তা সুররিয়ালিস্টধর্মী। তিনি প্রকৃতির বিভিন্ন বাস্তব বস্তুর আলোক-চিত্র নিয়ে, তাকে এমনভাবে উপস্থাপিত করেছেন যে সেই বাস্তব তার নিজের সীমাকে প্রসারিত করে গভীর অর্থে অর্থান্বিত হতে চেয়েছে। বেহালা সুরযন্ত্রটি নিয়ে তিনি অনেকগুলি ছবি করেছেন। যার সঙ্গে মানবী-শরীরের সমন্বয় ঘটিয়েছেন অনেক ছবিতে। সত্তা সুরে স্পন্দিত হয়েছে। ‘ড্রায়েড আউট’ শিরোনামের রচনাটিতে কাঁটা তারের উপর পড়ে আছে একটি শুকনো পাতা। পশ্চাৎপটে সূর্যাস্তের সপ্রতিভ আলো। ‘সেভ গ্রিনস’ রচনাটিতে বর্গাকার তমসাময় পরিসরে একটি গ্লোব স্থাপিত হয়েছে। তা থেকে অজস্র পাতা যেন পদব্রজে চলতে চলতে বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে বিস্তৃত হয়েছে। ছবিতে চড়া রঙের ব্যবহার একটু কমিয়ে আনলে তাঁর উপস্থাপনা আরও সুচারু হত। একটু সংবৃতির প্রয়োজন ছিল হয়তো।

মিলন মুখোপাধ্যায়ের তেলরং ও অ্যাক্রিলিকের ক্যানভাসে ১৯৬০-এর দশকের আধুনিকতাবাদী প্রকল্পের নানা অনুষঙ্গ রয়েছে। স্বাভাবিকতাকে বিশ্লিষ্ট করে ও সরলীকৃত করে তিনিও অভিব্যক্তিবাদী পরিমণ্ডল আনতে চেয়েছেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রাখতে চেয়েছেন সুষমার বার্তা। কোথাও কোথাও মূর্ততা প্রায়-বিমূর্তের দিকে গেছে। যেমন ‘দ্য ট্রি’ নামে একটি ছবিতে তিনি বৃক্ষের অবয়বকে এমন ভাবে বিশ্লিষ্ট করেছেন যে তা বৃক্ষের বেড়ে ওঠার ছন্দটিকে উন্মীলিত করে তাকে একটি মানুষের শরীরের আদলের সঙ্গে সমীকৃত করেছে। তা একই সঙ্গে একটি প্রজ্জ্বলিত অগ্নিশিখারও রূপ পেয়েছে। একই রূপকে ভেঙে এতগুলো রূপের আভাস নিয়ে আসা, এটা শিল্পীর রূপায়ণ পদ্ধতির একটি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ দিক। ‘ক্যাকটাস’ শীর্ষক ছবিটিতেও এই বিশ্লেষণাত্মক ছন্দ লক্ষ করি। অনেক ছবিতে অবয়বকে সামান্য সরলীকৃত করেও তিনি সুষমার বার্তা এনেছেন। যেমন ‘সানাই’। একজন মানুষ সানাই বাজাচ্ছে। সুর যেন ফুলের মতো প্রস্ফুটিত হচ্ছে। কিন্তু অনেক ছবিতে শিল্পী এই বিশ্লেষণ পদ্ধতিতে যথেষ্ট ছন্দিত সুষমা সঞ্চার করতে পারেননি। তাতে রূপকল্প ভারাক্রান্ত হয়েছে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement