পুস্তক পরিচয় ১

অবদমনের যোগ্য উত্তর

লেখকের ভাষায়, তথাকথিত ‘লো-কালচার’-এর দ্বারস্থ হয়ে তিনি নানান প্রহসন, নাটক ও পুস্তিকার সন্ধান দিয়েছেন, বিশেষত প্রথম লেখাটিতে। ব্যঙ্গ হোক বা সোজাসাপটা, যৌনতার ধরন ও প্রকাশ বুঝতে, এই সব নথি খুব সাহায্য করে।

Advertisement

সঞ্চারী মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৮ অক্টোবর ২০১৭ ০১:১১
Share:

ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

উনিশ শতক/ বাঙালি মেয়ের যৌনতা
লেখক: অর্ণব সাহা
মূল্য:
২৫০.০০
প্রতিভাস

Advertisement

অকপটে যৌনতার কথা বলার সময় এখনও আসেনি, এই দেশে, এই একবিংশ শতকেও। পুরুষই খোলাখুলি সে কথা বলতে পারে না তো নারী! যৌনতা নিয়ে কথা বা আলোচনা এত দিনেও প্রাত্যহিক হয়ে ওঠেনি, আর তাই যৌনতা চাওয়া, আকাঙ্ক্ষাও অন্তরালে রয়ে গিয়েছে— সমাজের অধিকাংশ মানুষের কাছে। এখনও, এ কালেও।

Advertisement

সে কালে যে মেয়েদের যৌনতা দমিত থাকবে, এতে আর আশ্চর্য কী? কিন্তু কেমন ছিল তার অন্দরের লাভা, প্রবল অবদমনের মধ্যে দিয়েও তার প্রকাশ কেমন ছিল, তার তথ্যসমৃদ্ধ বিবরণ লিখেছেন অর্ণব সাহা।

তিনটি লেখার সংকলন এ বইয়ের পাতা উলটে গেলেই বোঝা যায়, সেই উনিশ শতক থেকেই বাঙালি সমাজ যৌনতাকে কতটা অশ্লীল, গোপনীয়, অপ্রাসঙ্গিক মনে করে এসেছে, তা না হলে সমাজজীবনে যৌনতার ধারা বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে কেবল এক দিকে ইংরেজি এবং অন্য দিকে তথাকথিত বটতলার বই, এই দুই ধরনের উৎসের উপর ভরসা করতে হত না। বোঝা যায়, সাধারণ শিক্ষিত মানুষ যৌনতার আলোচনা কতখানি পরিহার করে এসেছেন জীবন থেকে। ফলে সে সব সম্পর্কে বই লেখা নিতান্তই অশালীন ঠেকেছে। এটাই অবদমনকে প্রমাণ করে।

তবে কিনা, লেখকের ভাষায়, তথাকথিত ‘লো-কালচার’-এর দ্বারস্থ হয়ে তিনি নানান প্রহসন, নাটক ও পুস্তিকার সন্ধান দিয়েছেন, বিশেষত প্রথম লেখাটিতে। ব্যঙ্গ হোক বা সোজাসাপটা, যৌনতার ধরন ও প্রকাশ বুঝতে, এই সব নথি খুব সাহায্য করে। আঠারো-উনিশ শতকে ভিক্টোরীয় ভাবধারায়, বাঙালি সমাজের মেয়েদের যৌনতা চাওয়া বা তার প্রকাশ ইংরেজি লেখক-লেখিকাদের কাছে কিংবা তৎকালীন বাঙালি লেখকদের কাছেও অশালীন ঠেকেছে, কিন্তু সেই পাঠকেই উল্টো করে পড়লে বোঝা যায়, অন্দরমহলের মেয়েরা কতটা যৌনতার অপ্রাপ্তিতে ভুগতেন। এবং বাসরঘরে অশ্লীল গান কিংবা নিজেদের মধ্যে ‘রসের কথা’ কিংবা গালাগালি দিয়ে সেই অপূর্ণ যৌনতার দাবি প্রশমিত করার চেষ্টা করতেন। আরও একটি জরুরি তথ্য পাওয়া যায় উনিশ শতকের বিধবাদের যৌনতার প্রেক্ষিতে বিচার করলে। বহু পূর্ণযুবতী বিধবা সমাজের চোখে ‘বিপথে’ যান, সেই যাওয়া জানিয়ে দেয়, যৌনতা না পাওয়ার কষ্ট নাম-কুল-গোত্র ও সমাজের বিধিনিষেধের চেয়ে জরুরি হয়ে ওঠে তাঁদের অনেকের কাছে।

দ্বিতীয় লেখায় মেয়েদের পোশাক ভাবনা কী ভাবে রূপান্তরিত হল, তার একটি ব্যাখ্যা রয়েছে। যৌনতার প্রকাশ নিয়ন্ত্রিত রাখতেই পোশাকের ওপর এতটা বিধিনিষেধ। তৃতীয় লেখাটি সন্ধান করে, কী ভাবে যৌনতার অবদমন সেই আঠারো, উনিশ শতক থেকে গড়িয়ে বিশ শতকেও পৌঁছে গেল। তবে এই লেখাটি সামগ্রিক ভাবে সামাজিক যৌনতা বিষয়ক একটি লেখা হয়ে দাঁড়াল, আলাদা করে মেয়েদের যৌনতার বিষয়টিকে যথেষ্ট প্রাধান্য দেওয়া হল না। বস্তুত, শিরোনাম যা-ই বলুক, বইটি শেষ পর্যন্ত তিনটি আলাদা লেখার সংকলন হয়েই থাকল। সংকলন থেকে পূর্ণাঙ্গ বইয়ে পৌঁছতে হলে একটা সংহতির দরকার হয়। তবুও, যৌনতার প্রতি চিরকালীন অশ্রদ্ধা এবং না জানতে চাওয়ার ঐতিহ্যের প্রতি এই বই একটি যোগ্য উত্তর।

লেখক ভূমিকায় বলেছেন, এই বই একেবারে সাধারণ পাঠকের জন্য, অথচ ভাষার সরলতা তেমন করে কোথাও চোখে পড়ল না। দ্বিতীয় লেখার একটি বাক্য উদাহরণ হিসেবে পড়া যাক: ‘এ ভাবেই শরীর হয়ে উঠল এক ধরনের ‘নেগেটিভ সিগনিফায়ার’ যার মাধ্যমে দেশীয় নব্য পুরুষতন্ত্র ‘সভ্যতার’ মোড়কে আর এক রকম ‘এনক্লোজার’ তৈরি করল মেয়েদের শরীরের উপর।’ এই বাক্য ‘একেবারে সাধারণ পাঠকের জন্য’? আর, ভাষা এবং ছাপার ভুল এ-ধরনের বইয়ে পীড়া দেয়। যেমন, ‘রুচিবান’ (পৃ ৭৫) হয় না, হবে ‘রুচিমান’। ‘ম্যান অপটিক্যান’ (পৃ ৯৭) নয়, প্যানঅপটিকন। আর একটু যত্নবান হওয়া প্রয়োজন ছিল।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement