mahatma gandhi

Book review: গণমাধ্যমের সঙ্গে সম্পর্ক গভীর

মনে রাখতে হবে, গান্ধী ও গণমাধ্যমের ইতিহাস বহুরূপী। এখানে গণমাধ্যমে গান্ধী আছেন, আবার গান্ধীর গণমাধ্যমও আছে।

Advertisement

অরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৯ জানুয়ারি ২০২২ ০৭:৩৪
Share:

এম.কে. গান্ধী, মিডিয়া, পলিটিক্স অ্যান্ড সোসাইটি: নিউ পার্সপেক্টিভস
সম্পা: চন্দ্রিকা কউল
৩২৯৫.০০
প্যালগ্রেভ ম্যাকমিলান

Advertisement

সম্পাদিত গ্রন্থটি গান্ধী বিষয়ক আলোচনায় একটি ব্যতিক্রমী প্রচেষ্টা। গান্ধীর দেড়শোতম জন্মদিন উপলক্ষে একটি আন্তর্জাতিক আলোচনাচক্রের উপর ভিত্তি করে বইটি তৈরি হয়েছে, এবং গান্ধীচর্চার সচরাচর পটভূমি থেকে বেরিয়ে তাঁর ব্যক্তিত্ব ও কার্যপদ্ধতির মধ্যে সংবাদপত্র, অন্যান্য গণমাধ্যম ও প্রচারের সংযোগের দিকে দৃষ্টিপাত করা হয়েছে। জীবৎকালে গান্ধী চারটি পত্রিকা সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, টেলিগ্রামের বিস্তৃত ব্যবহার করেছেন, এমনকি নিজেকে ‘নিউজ়পেপারম্যান’ হিসাবেও একদা অভিহিত করেছেন। গ্রন্থটির বৈশিষ্ট্য, গান্ধী-আলোচনায় বৃহত্তর অর্থে মিডিয়া বা গণমাধ্যমকে কেন্দ্রস্থলে আনা হয়েছে, এবং এই কাজ করা হয়েছে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে। সম্পাদকের নিজস্ব ভূমিকা ছাড়া মোট ন’জন প্রবন্ধকারের রচনা সঙ্কলিত হয়েছে এই গ্রন্থে— অ্যামেলিয়া বোনেয়া, সঞ্জীব ককর, টিমোথি দোবে, সর্বাণী গুপ্তু, চন্দ্রিকা কউল, গোপা সভরওয়াল, অঞ্জনা শর্মা এবং মেই লি বাদেকার। এঁদের রচনার পরিধি বিচিত্র হলেও নানা ভাবে তা ইতিহাস, রাজনীতি, সাহিত্য ও ধর্ম, গণমাধ্যম ও গণসংস্কৃতি বিষয়ক আলোচনায় অংশগ্রহণ করেছে। গান্ধীভাবনা ও গান্ধীর বহুমুখী নির্মাণের উপর এই আলোচনার প্রতিফলন তাৎপর্যপূর্ণ।

অ্যামেলিয়া বোনেয়া ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পটভূমিকায় গান্ধী যে ভাবে ইলেকট্রিক টেলিগ্রাফের ব্যবহার করেছেন, সেই রাজনীতির কথা বলেছেন। প্রসঙ্গত, লেখিকা গান্ধীর প্রযুক্তি-সন্দিগ্ধ ভাবমূর্তিটি পাল্টানোর চেষ্টা করেছেন। তিনি প্রশ্ন করেছেন, গান্ধীর তথাকথিত আধুনিক প্রযুক্তি-বিরোধিতা (হিন্দ স্বরাজ গ্রন্থের সূত্রে) সাধারণ ভাবে মেনে নেওয়া হলেও, তাঁর জীবনের দক্ষিণ আফ্রিকা পর্বে এবং ভারতে প্রত্যাবর্তনের পরেও টেলিগ্রাফ প্রযুক্তির বিস্তৃত ব্যবহার, এমনকি সেই রাজনীতির পূর্বাপরও কেন প্রায় অনালোচিত থেকে যায়? উল্লেখযোগ্য যে, এই সূত্রে বোনেয়া ১৮৯৬ সালের যে ‘গ্রিন প্যামফ্লেট’টির উল্লেখ করেন, সেটি ছিল গান্ধীর ‘অ্যাপিল টু দি ইন্ডিয়ান পাবলিক’, যার একটি জাতিবিদ্বেষমূলক সংক্ষিপ্তসার রয়টার্সের টেলিগ্রামে প্রতিফলিত হয়। এর ফলে গান্ধী নাটালের ডারবান শহরে সাহেবদের দ্বারা আক্রান্ত হন, এমনকি তাঁর জীবনসংশয় হয়। কিন্তু এ জন্য সেই অর্থে, টেলিগ্রাফ প্রযুক্তিকে তিনি দোষারোপ করেননি, তার সতর্ক ব্যবহার চেয়েছিলেন। আরও দেখা যায়, তিনি নিজেও টেলিগ্রাফের বিস্তৃত ব্যবহার করেছেন তাঁর রাজনৈতিক কার্যকলাপে, এক সময় এ জন্য নিজের আয়ের এক-ষষ্ঠাংশ ব্যয়ও করেছেন। এক সময় টেলিগ্রাফ প্রযুক্তি তাঁর কাছে প্রতিরোধের যন্ত্র হয়েও দাঁড়িয়েছিল।

Advertisement

সমাজ সংস্কারের উপায় হিসাবে গান্ধী যে ভাবে সংবাদপত্রকে ব্যবহার করেছেন তার চমৎকার বিবরণ দিয়েছেন সঞ্জীব ককর। গান্ধী তাঁর সম্পাদিত বিভিন্ন পত্রিকা, যথা ইন্ডিয়ান ওপিনিয়ন, ইয়ং ইন্ডিয়া এবং হরিজন-এ ‘স্বাস্থ্য সংবাদদাতা’ হিসাবে লিখেছেন এবং কুষ্ঠ সংক্রান্ত তাঁর ভাবনার নানা রূপান্তরের প্রতিফলনও এখানে লক্ষিত হয়। প্রধানত, দু’টি পর্বে গান্ধীর কুষ্ঠ রোগ সংক্রান্ত ভাবনাকে বিভক্ত করা যায়, একটি ১৯৩৪-এর আগে, অন্যটি পরে। প্রথম পর্বে গান্ধীর চিন্তা প্রধানত মিশনারিদের এই সংক্রান্ত মিশ্র ভাবনা দ্বারা প্রভাবিত ছিল, কিন্তু দ্বিতীয় পর্বে গান্ধী ক্রমশ কুষ্ঠ বিষয়ে আধুনিক চিকিৎসাকে গ্রহণ করেছিলেন। এই সব আধুনিক চিকিৎসকের মধ্যে ডা. ককরেন-এর নাম অগ্রগণ্য। তা ছাড়া, ‘ব্রিটিশ এম্পায়ার লেপ্রসি রিলিফ অ্যাসোসিয়েশন’-এর সঙ্গে গান্ধীর বর্ধমান সংযোগও লক্ষণীয়। এই ইতিহাসেরও রন্ধ্রে রন্ধ্রে জড়িয়ে আছে গণমাধ্যম ও গণসংযোগ।

টিমোথি দোবে উর্দু লেখক খাজা হাসান নিজ়ামি-র ১৯১০ ও ১৯২০-র দশকে লিখিত জনপ্রিয় রচনা গান্ধীনামা-র আলোচনা করেছেন। এগুলি অধিকাংশই স্ব-প্রকাশিত, স্ব-অলঙ্কৃত। নিজ়ামি ক্রমশ গান্ধীর ভারতীয় তথা এশীয় রূপের বাইরে এক বিশ্বরূপের সন্ধান করছিলেন। তাঁর রচনায় আন্তর্জাতিক সুফি ভাবনার প্রভাব ছিল, তা তাঁর গান্ধীভাবনাতেও প্রতিফলিত হয়েছিল। আবুল কালাম আজ়াদের মতো নেতা ছিলেন নিজ়ামির ভাবনার অনুসারী। সর্বাণী গুপ্তু বাংলা বাংলার বিভিন্ন পত্রিকায় গান্ধী ও তাঁর ভাবনা নিয়ে প্রলম্বিত বিতর্কের কথা বলেছেন এক বিস্তৃত পর্বে, ১৯১৬ থেকে ১৯৪০ পর্যন্ত। যে সব পত্রিকা বিশেষ ভাবে সর্বাণী দেখেছেন, সেগুলি হল বঙ্গবাণী, ভারতী, ভারতবর্ষ, বিচিত্রা এবং প্রবাসী। এই সব বিতর্কে তৎকালীন যুগের বিশিষ্ট বাঙালি বুদ্ধিজীবী, এমনকি প্রখ্যাত নারীরাও, যথা সরলা দেবী চৌধুরানী অংশগ্রহণ করেছিলেন। সর্বাণী মনে করেন, মহাত্মার মূল্যায়নে নানা বিতর্ক সত্ত্বেও বাংলার সাময়িক পত্রগুলির উপর তাঁর ব্যক্তিত্ব এবং খাদি ও চরকার মাধ্যমে গঠনমূলক জাতীয়তাবাদের গভীর প্রভাব লক্ষ করা যায়। চন্দ্রিকা কউল মুদ্রণ মাধ্যম ছাড়াও গান্ধীর রেডিয়ো মাধ্যম ব্যবহারের কথা বলেছেন, এবং প্রসঙ্গত যথাক্রমে তাঁর ১৯৩১ ও ১৯৪৭ সালের বেতার সংযোগের কথা এসেছে, বিবিসি এবং এআইআর-এর সঙ্গে সম্পর্কের কথাও।

গোপা সভরওয়াল ১৯৪৭ সালের ডন পত্রিকার প্রতিবেদনগুলির বিস্তৃত আলোচনা করেছেন। এই সংবাদপত্রের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মহম্মদ আলি জিন্না, এবং এটি নয়াদিল্লি থেকে প্রকাশিত হত। পত্রিকাটিকে মুসলিম কণ্ঠস্বরের সরকারি ভাষ্য হিসাবে দেখা হত। গান্ধী-জিন্না বিরোধ যখন চরমে, সেই ১৯৪৭ সালেও, ডন পত্রিকায় গান্ধী যে ভাবে চিত্রিত হয়েছেন, তা বিশেষ ভাবে আলোচনাসাপেক্ষ। লেখিকা দেখিয়েছেন, পত্রিকায় যা চিত্রিত হয়েছে, এবং যা চিত্রিত হয়নি, দুটোই দেখার মতো। যেমন, জিন্নাকে সর্বত্র ‘কয়েদ-ই-আজ়ম’ নামে অভিহিত করা হলেও গান্ধীর অভিধা নেহাতই ‘মিস্টার’-এ সীমিত ছিল প্রায়শ, এবং কদাচিৎ তাঁকে ‘মহাত্মা’ বলা হলেও সেটা হয়েছে ব্যঙ্গার্থে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার শিকার হিন্দু ও মুসলিম জনগণ ও শরণার্থীদের মধ্যে গান্ধীর কার্যকলাপের বিবরণ দেওয়া হয়েছে, কিন্তু তাঁকে শেষ পর্যন্ত বলা হয়েছে নীতিভ্রষ্ট, একদেশদর্শী এবং নিছক কৌশলীমাত্র। বোঝা যায়, গণনেতৃত্বের ক্ষেত্রে গান্ধীর সঙ্গে জিন্নার অসম প্রতিযোগিতা ডন সংবাদপত্রটিকে ১৯৪৭ সালেও তাড়া করে বেড়িয়েছে।

অঞ্জনা শর্মার রচনার বিষয়টিও ১৯৪৭ সালের গান্ধী-চিত্রণ, যথাক্রমে নয়াদিল্লির হিন্দুস্থান টাইমস এবং কলকাতার দ্য -এ। হিন্দুস্থান টাইমস-এর সেই সময়ের সম্পাদক ছিলেন দেবদাস গান্ধী, স্বভাবতই গান্ধীর সর্বভারতীয় কেন্দ্রীয় চরিত্র সেখানে নির্মিত হয়। বিপরীতে, ব্রিটিশ মালিকানাধীন স্টেটসম্যান-এর সমস্ত প্রতিবেদনে গান্ধীর একটি মিশ্র চরিত্র নির্মিত হয়। এই দুই নির্মাণের দীর্ঘস্থায়ী প্রতিক্রিয়া— যা গান্ধীর জন্মের দেড়শো বছর পরেও খোঁজা যেতে পারে— লেখিকা আলোচনা করেছেন।

গ্রন্থের শেষ রচনাটিতে মেই লি বাদেকার একবিংশ শতাব্দীর সমকালীন গণসংস্কৃতিতে গান্ধীর নির্মাণের সন্ধান করেছেন। এ ক্ষেত্রে তিনি টিভি, পথশিল্পকলা, এমনকি এনবিসি ও নেটফ্লিক্সের মতো মাধ্যমও সন্ধান করেছেন। স্বভাবতই দিল্লি, মুম্বই, নিউ ইয়র্ক এবং পিটসবার্গ শহরের গণসাংস্কৃতিক গান্ধীনির্মাণ তাঁর লেখায় স্থান পেয়েছে। বাদেকারের মতে, নতুন প্রজন্মের কাছে গণসংস্কৃতির এই সমস্ত নির্মাণই গুরুত্বপূর্ণ, গান্ধীভাবনার আত্মীকরণের জন্য, নানা ভাবে। তবে সব সময়ই নজর রাখা উচিত, এই প্রতিফলনে যেন গান্ধীর বিশ্বাস, দর্শন ও কর্মকাণ্ডের বিবরণের কোনও প্রত্যক্ষ বিচ্যুতি না থাকে।

মনে রাখতে হবে, গান্ধী ও গণমাধ্যমের ইতিহাস বহুরূপী। এখানে গণমাধ্যমে গান্ধী আছেন, আবার গান্ধীর গণমাধ্যমও আছে। গান্ধী চরিত্র-চিত্রণের তথ্যবিন্যাসে এর মধ্যে নতুন ইতিহাসের সন্ধান করা যেতে পারে। আবার, গান্ধীভাবনার তাত্ত্বিক নির্মাণে গান্ধী-পদ্ধতির আলোচনা এবং গণমাধ্যমে তার প্রতিফলন নতুন দিশা দিতে পারে। উদাহরণ হিসাবে, ‘প্রযুক্তি’, ‘চিকিৎসা’ এবং ‘পরিবেশ’ বিষয়ে গান্ধীর ‘তত্ত্ব’ কী ভাবে তাঁর ‘কার্যকলাপ’ দ্বারা প্রভাবিত/রূপান্তরিত/প্রসারিত হয়েছে, তা ভাবা যেতে পারে। সম্পাদিকার ‘সংক্ষিপ্ত প্রারম্ভিক মন্তব্য’-এ এই সব কিছু প্রশ্নের আর একটু বিস্তৃত বিচার থাকলে ভাল হত।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement