চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১

কল্পরূপের ছায়ায় প্রকৃতির অন্তর্নিহিত স্পন্দন

সম্প্রতি অ্যাকাডেমিতে অনুষ্ঠিত হরাইজন দলটির সম্মেলক প্রদর্শনীটি দেখে এলেন মৃণাল ঘোষহরাইজন দলটির সম্মেলক প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হল সম্প্রতি। এই দলের সদস্য সাতজন শিল্পী ছাড়াও দুজন আমন্ত্রিত শিল্পী ছিলেন প্রদর্শনীতে। এই দুজন আমন্ত্রিত শিল্পী, গৌতম বসু ও দীপক মুখোপাধ্যায়।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৫ জুন ২০১৬ ০০:০০
Share:

হরাইজন দলটির সম্মেলক প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হল সম্প্রতি। এই দলের সদস্য সাতজন শিল্পী ছাড়াও দুজন আমন্ত্রিত শিল্পী ছিলেন প্রদর্শনীতে। এই দুজন আমন্ত্রিত শিল্পী, গৌতম বসু ও দীপক মুখোপাধ্যায়। এই দলের অন্তর্গত শিল্পীদের থেকে অন্তত এক দশক আগে শুরু করেছিলেন তাঁদের শিল্পযাত্রা। ১৯৮০-তে গড়ে ওঠা ‘ফাইভ পেইন্টার্স’ দলের প্রধান সংগঠক ছিলেন তাঁরা। ‘ফাইভ পেইন্টার্স’ অবশ্য অনেক দিন আগেই তাঁদের সমবেত যাত্রা বন্ধ করেছে। এই দুজন শিল্পী এখনও নিমগ্ন কাজ করে যাচ্ছেন। ‘হরাইজন’ দলটি তৈরি হয়েছিল ২০০৪ সালে। এর পর থেকে তাঁরা নিয়মিত প্রদর্শনী করে আসছেন। এদের মধ্যে দুজন চন্দন দাস ও বিদ্যুৎ বসাক ভাস্কর। বাকি পাঁচজন বিশ্বজিৎ মিত্র, প্রদীপ ভৌমিক, মৃন্ময় দাস, নির্মলকান্তি চক্রবর্তী ও সঞ্চিতা সেনগুপ্ত ছবি এঁকেছেন। ভাবনায় ও আঙ্গিকে এই ন’জন শিল্পীর কাজ স্বভাবতই স্বতন্ত্র। তাঁদের কেউ কেউ অবয়বী ছবি এঁকেছেন। কেউ অবয়বকে বিশ্লিষ্ট করেছেন, কিংবা বিমূর্ততার আভাসও এনেছেন। এই বৈচিত্রের মধ্যেও একটি জায়গায় তাঁদের মিল। প্রকৃতির বা সত্তার অন্তর্নিহিত স্পন্দনকে খুঁজেছেন। অস্তিত্বের গভীরে থাকা অন্তহীন রহস্যের জগৎকে উন্মীলিত করেছেন। তথাকথিত সমাজবাস্তবতার বাইরে গিয়ে কল্পরূপের ভিতর দিয়ে অন্তর্লীন রহস্যের সন্ধানই এই প্রদর্শনীর মূল সুর।

Advertisement

গৌতম বসুর টেম্পারার প্রাকরণিক নির্মাণ পদ্ধতি তার ছবির বিষয়কেও প্রভাবিত করে। তিনি রূপ-কেই (ফর্ম) ভাব-এ (কনসেপ্ট) রূপান্তরিত করেন। নব্য-ভারতীয় ঘরানার ঐতিহ্যগত যে আত্মপরিচয় সন্ধান, তাকেই সাম্প্রতিকে প্রসারিত করেছেন। এই প্রদর্শনীতে তাঁর ছ’টি ছবির মধ্যে ‘Wrath’ শিরোনামে শিকলে বাঁধা চিৎকৃত কুকুরের ছবিটি বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এখানে তিনি তাঁর স্বভাবসিদ্ধ প্রশান্তিকে ভেঙে হিংসার বা প্রতিবাদের এক প্রতীকী বাতাবরণ তৈরি করেছেন। ‘মাই গার্ডেন’, ‘ফ্লেভার অব লাভ’ ইত্যাদি ছবিতে তিনি সৌন্দর্যের নানা সংকেতকে উন্মীলিত করেছেন।

দীপক মুখোপাধ্যায়ের ছবিতে সব সময়ই বিদূষকের বিশেষ ভূমিকা থাকে। স্বাভাবিকতাবাদী উপস্থাপনার মধ্যে কল্পরূপের আবরণ এনে তিনি বাস্তবের অন্তরালবর্তী গভীরতর রহস্যকে উন্মোচিত করেছেন। ‘ক্লাউন ১’ ছবিতে চোখে মুখে বিচিত্র রং মাখা বিদূষকের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা যুবতীর শুভ্র মুখে এক স্তব্ধতা সঞ্চারিত থাকে। দুটি অভিব্যক্তির দ্বান্দ্বিকতায় আলোড়িত হয় পশ্চাদ্বর্তী অন্ধকারের নিবিড় রহস্য।

Advertisement

চন্দন দাস তাঁর চারটি ব্রোঞ্জ-ভাস্কর্যে মুক্ত অবয়বের জঙ্গম উপস্থাপনায় আনন্দ ও উদ্দীপনার প্রতীকী রূপ নির্মাণ করেছেন। স্ফীত অবয়বের মধ্যে কোনও শূন্য পরিসর রাখেননি। সমস্যা-সংকুল জীবনের উপর তিনি যেন উদ্দামতা ছুড়ে দিতে চেয়েছেন।

বিদ্যুৎ বসাকের ছ’টি ফাইবারের তৈরি মিশ্রমাধ্যমের ভাস্কর্য অনেক সংবৃত। সাংগীতিক বিমূর্ততার প্রতীকী রূপ নির্মাণ করেছেন তিনি। তবে বস্তুর ভারকে আরও কমাতে হবে।

কাঙ্ক্ষিতের দিকে মানুষের যে অভীপ্সা এবং তাকে না-পাওয়ার যে শূন্যতা এই দুইয়ের মধ্যে সেতু নির্মাণের চেষ্টা করেছেন বিশ্বজিৎ মিত্র তাঁর ‘দ্য ফরবিড্ন ফ্রুট’ ছবিতে। টেবিলের উপর একটি অর্ধেক কাটা আপেল। সেদিকে তাকিয়ে দরজার কাছে দাঁড়ানো এক যুবতী, যার চোখ নেই, দৃষ্টি নেই। মেঝের উপর হাঁ-করা একটি কুমির। এ রকম কল্পরূপের সহাবস্থানে শূন্যতাই বাঙ্ময় হয়ে ওঠে।

প্রদীপ ভৌমিক টেম্পারায় এঁকেছেন স্বাভাবিকতাবাদী অবয়বী রূপারোপ। ‘লুকিং অ্যাট’ ছবিতে এক হাতে ছুরি, অন্য হাতে ফুল নিয়ে শূন্যের দিকেই তাকিয়ে থাকে সম্ভ্রান্ত যুবক। এরকমই স্বপ্নের আবহ তাঁর বাকি তিনটি ছবিতেও।

মৃন্ময় দাশ অ্যাক্রিলিকে আঁকা চারটি ছবিতে নিসর্গকে বিমূর্তায়িত করেছেন। কিন্তু উপস্থাপনার শ্লথতা ভারাক্রান্ত করেছে তাঁর বিমূর্তায়ন পদ্ধতিকে। নির্মল কান্তি চক্রবর্তীর কালি-কলমে রচিত ১২-টি ছবি নিসর্গকে বিমূর্তায়িত করে তার ভিতর গহন রহস্যের সঞ্চার করেছে। সঞ্চিতা সেনগুপ্তের মিশ্র মাধ্যমের বর্ণিল নিসর্গও স্বাভাবিকতার অন্তরালবর্তী মগ্ন সৌন্দর্যকে উন্মীলিত করতে চেয়েছে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement