পুস্তক পরিচয় ১

জনজীবনের বিশ্লেষণী দর্পণ

আজও বাঙালির কাছে যাঁরা স্মৃতিধার্য গৌরব, তেমনই একজন চন্দ্রাবতী দেবী। পুরনো বাংলা ছবির ব্যতিক্রমী অভিনেত্রী, তিরিশ-চল্লিশ দশকের চলচ্চিত্রের নায়িকা। ছবি প্রযোজনাও করেছেন, যা সে সময়ে এক বিরল ঘটনা।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০০:০০
Share:

নকশালবাড়ির পঞ্চাশ বছর নিয়ে নিছক আরও একটি গ্রন্থ নয় অর্জুন গোস্বামী সংকলিত ও সম্পাদিত নকশালবাড়ির দিনগুলো (গাঙচিল, ৪৫০.০০)। অর্জুন লিখেছেন, ‘একেবারে অবিকৃত ভাবে নকশালবাড়ি আন্দোলনের সময়টাকে আমরা ধরতে চেয়েছি।’ এ কাজে তিনি সফল। লেখকসূচিতে চারু মজুমদার, শৈবাল মিত্র, দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, সুমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে শুরু করে পুলিশ অফিসার রুনু গুহনিয়োগীর নামও আছে। নানা দিক থেকে উত্তাল সেই সময়কে ধরার চেষ্টা হয়েছে এ গ্রন্থে।

Advertisement

মেমসাহেব যদি বাঘ শিকার করতে গিয়ে হাওদা ভিজিয়ে ফেলেন, হাতি-মারা বন্দুক হাতে যদি শজারু শিকারের ইচ্ছে জাগে, বিজয়াদশমীর সিদ্ধিসেবনের পর যদি সামনে পড়ে ‘জোড়া’ বাঘ, তবে... এ এক স্মৃতির ক্যারাভান। ধৃতিকান্ত লাহিড়ী চৌধুরীর রচনা সংকলন জঙ্গলগাথা ও রসনাবিলাস-এর (৯ঋকাল বুকস, ৫৫০.০০) ছত্রে ছত্রে বিগত আভিজাত্যের সোনালি ধুলো। মুখ্যত শিকার কাহিনি, হাতির শাস্ত্র-অশাস্ত্র, আরও আছে ঝটিকা-ভ্রমণ, দেশেবিদেশে তাঁর ঔদরিক অ্যাডভেঞ্চার, বাঙালির রন্ধনমঞ্জুষার বাছাই মণিমুক্তো।

‘বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নিয়ে লেখালিখির ক্ষেত্রে সিদ্ধার্থর অবদান স্মরণীয় হয়ে থাকবে’, মন্তব্য আশীষ লাহিড়ীর, সিদ্ধার্থ ঘোষ প্রবন্ধ সংগ্রহ ২ (সম্পা: কৌশিক মজুমদার ও সৌম্যেন পাল, বুকফার্ম, ৩৭৫.০০) বইয়ের ভূমিকায়। এই খণ্ডে আছে গুরুত্বপূর্ণ অনেকগুলি লেখা, যেমন ফোটোগ্রাফির রূপরেখা, বাঙালির ছবি তোলা, চলচ্চিত্র উদ্ভাবনের পটভূমি, সায়েন্স ফিকশন, এইচ বোস ও প্রিন্স দ্বারকানাথ।

Advertisement

প্রথম মহাযুদ্ধের পরবর্তী কাল থেকে পঞ্চাশের দশকের গোড়া পর্যন্ত এক অসম্ভব ওঠাপড়ার ভিতর দিয়ে গিয়েছে বাঙালির জীবন, তা তো কেবল গত শতকের খণ্ডকালের স্মৃতি নয়, আজও আমাদের বেঁচে থাকার অন্তর্লীন ইতিহাস, তারই ছবি পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়ের চলমান জীবন-এ (প্রতিক্ষণ, ৬০০.০০)। সাহিত্য, সমাজ, শিল্প, অভিনয়, রাজনীতি— এ সমস্ত কিছুর উত্থান-পতন, পরিবর্তন ও বিবর্তনের মধ্যে নিজেকে মিশিয়েই লিখেছেন তিনি। ১৩৫৯ বঙ্গাব্দে প্রথম সংস্করণ, দু’খণ্ড একত্রে প্রতিক্ষণ-সংস্করণ ১৯৯৪-এ, এতকাল পর তারই পুনর্মুদ্রণ বেরোল।

আজও বাঙালির কাছে যাঁরা স্মৃতিধার্য গৌরব, তেমনই একজন চন্দ্রাবতী দেবী। পুরনো বাংলা ছবির ব্যতিক্রমী অভিনেত্রী, তিরিশ-চল্লিশ দশকের চলচ্চিত্রের নায়িকা। ছবি প্রযোজনাও করেছেন, যা সে সময়ে এক বিরল ঘটনা। রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্যধন্য এই শিক্ষিত মানুষটিকে কেবল রুপোলি পর্দার ছায়ামানুষ হিসেবেই জানি, কিন্তু তাঁর ভিতরকার রক্তমাংসের মানুষটির কথা, তাঁর নিভৃত মনের কথা এ বারে তাঁর জবানিতেই জানা যাবে সুমিতা সামন্ত সম্পাদিত চন্দ্রাবতী দেবী/ স্মৃতিকথা ও অন্যান্য (ঋত, ২২৫.০০) বইটিতে। প্রবেশক লিখেছেন সূর্য বন্দ্যোপাধ্যায়।

সুবিমল মিশ্র সম্পাদিত সখারাম গণেশ দেউস্কর-এর (১৮৬৯-১৯১২) ন’টি দুষ্প্রাপ্য বইয়ের সংকলন: সখারাম গণেশ দেউস্কর/ বাংলা রচনাসম্ভার (পরি: দে’জ পাবলিশিং, ৩৫০.০০)। মহারাষ্ট্রের ইতিহাসের স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব শিবাজী, মহাদেব গোবিন্দ রানাডে, তিলক, বাজীরাও, লক্ষ্মীবাই, ঝাঁসির রাজকুমার, আনন্দীবাই প্রমুখের জীবনকথা রচনা করে বাংলার তরুণদের মনে বিপ্লবের আদর্শ জাগিয়ে তুলেছিলেন সখারাম। একাধারে ছিলেন উগ্রজাতীয়তাবাদী, সাহিত্যসেবী, সাংবাদিক, নির্ভীক দেশপ্রেমিক এবং বাস্তবমুখী বিদগ্ধজন। তিনি মরাঠি হলেও বাংলাকে প্রাণ দিয়ে ভালবেসেছিলেন। তাঁর অগ্নিগর্ভ রচনাবলি জাতীয় আন্দোলনেও যথেষ্ট প্রেরণা দিয়েছিল।

শ্রীরামকৃষ্ণদেবের বেদান্তগুরু শ্রীশ্রীতোতাপুরী মহারাজ সম্পর্কে বাংলায় কোনও পূর্ণাঙ্গ বই নেই বললেই চলে। তোতাপুরী নামের মোট পাঁচ জন সন্ন্যাসীর সন্ধান পাওয়া যায়। প্রত্যেক তোতাপুরীর ভক্তদের বিশ্বাস তাঁদের আচার্যই শ্রীরামকৃষ্ণদেবের গুরু। এঁদের সকলের সম্পর্কে প্রাপ্ত তথ্যই বিশ্লেষণসমেত পার্থপ্রতিম বন্দ্যোপাধ্যায়ের শ্রীশ্রীতোতাপুরী-প্রসঙ্গ (লেক কালীবাড়ি, ২৫০.০০) বইতে পরিবেশিত হয়েছে। সেই সঙ্গে আছে কোন তোতাপুরীর প্রকৃতপক্ষে শ্রীরামকৃষ্ণদেবের গুরু হওয়া সম্ভব, তা যুক্তিসহকারে নিরূপণের প্রয়াস।

‘নবীন বসু তাঁর থিয়েটারে বিদ্যাসুন্দর অভিনয়ে চারজন অভিনেত্রীকে নিয়েছিলেন— রাধামণি, জয়দুর্গা, রাজকুমারী ও বৌহরো ম্যাথরানি। এই চার অভিনেত্রী যে পতিতাপল্লি থেকেই এসেছিলেন সে নিয়ে কোনও বিতর্ক নেই।’ মলয় রক্ষিত তাঁর বাংলা থিয়েটার অন্য ইতিহাস (সিগনেট প্রেস, ২৫০.০০) বইয়ের ‘বাংলা রঙ্গমঞ্চে নারী: প্রসঙ্গ ফিমেল থিয়েটার’ অধ্যায়ে লিখেছেন। বইটিতে প্রচলিত ধারাবাহিক ঘটনা-বিবরণের পরিবর্তে থিয়েটারের ভিন্ন ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে। আছে বাংলা থিয়েটারের বিকল্প সাংস্কৃতিক ইতিহাস নির্মাণের প্রয়াস।

দু’মলাটের মধ্যে আটটি কাব্যগ্রন্থের সন্নিবেশ সুধীর দত্তের কবিতাসমগ্র-তে (সিগনেট প্রেস, ৩৫০.০০)। অধ্যাত্ম-অনুভূতিতে লীন কবি উচ্চারণ করেছেন জীবনের পঙ্‌ক্তিমালা, তাঁর কবিতা পড়লে মন নির্জন হয়। কবি তবু জেগে থাকেন মানুষের পাশেই, দেখেন ‘কী মহার্ঘে মানুষ কিনেছে মানুষেরই অপচয়!’ তাঁর শব্দেরা মৃদু কিন্তু দৃঢ়, রূপকল্প গহন। সযত্ন নির্মাণের ছোঁয়া বইটির সর্বাঙ্গে, শেষ ক’টি পাতার গ্রন্থ-পরিচয় ও প্রথম পঙ্‌ক্তির বর্ণানুক্রমিক সূচি পাঠকের সুপ্রাপ্তি।

দীপেশ চক্রবর্তীর মতো ইতিহাসবিদই পারেন, ইতিহাসকে এত অজানা আলোয় ফুটিয়ে তুলতে! এই যেমন, একটি অপরিচিত তথ্য— ১৯১৩ সালে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে কিছুতেই পাঁচটি বক্তৃতার জন্য আমন্ত্রণে রাজি না হয়ে শেষ পর্যন্ত একটি বক্তৃতা দিতে ডাকে। প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতা নিয়ে বলবেন তিনি, ধরে নেওয়া হয় সেটা ধর্মীয় বিষয়, ধর্মযাজকদের গেস্টহাউসে রাখা হয় তাঁকে। শতাব্দীশেষে কিন্তু বাংলা সংস্কৃতিই জিতে যায়। যে বিশ্ববিদ্যালয় রবীন্দ্রনাথের নাম জানত না, তারাই এখন ভারতবিদ্যাচর্চার পীঠস্থান। এই সংকলনে (মনোরথের ঠিকানা, অনুষ্টুপ, ৪৯০.০০)রবীন্দ্রনাথের পাশাপাশি আছেন বঙ্গবন্ধু, যদুনাথ সরকার, দেরিদা, ক্রিস্টোফার বেইলি, এজাজ আহমদ। আছে বাঙালি ভদ্রলোক, আধুনিকতা কিংবা ইতিহাসের মৃত্যুর মতো বিষয়। জনজীবনের বিশ্লেষণী দর্পণ এই বই।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement