দ্য কান্ট্রি অব ফার্স্ট বয়েজ। অমর্ত্য সেন। অক্সফোর্ড, ৫৫০.০০
গত পনেরো বছরে প্রধানত দ্য লিটল ম্যাগাজিন পত্রিকায় অমর্ত্য সেনের লেখা তেরোটি প্রবন্ধ নিয়ে তৈরি ছিমছাম বইটির পূর্বকথায় গোপালকৃষ্ণ গাঁধী তাঁকে বলেছেন ‘ইন্টেলেকচুয়াল ডেমোক্র্যাট’। তিনি দেখিয়েছেন, অমর্ত্য সেন তাঁর লেখায় কী ভাবে নিজের যুক্তির পরতে পরতে সম্ভাব্য প্রতিযুক্তিগুলিকেও বুনে চলেন, নিছক সেগুলিকে খণ্ডনের জন্য নয়, অনেক সময়েই নিজের প্রধান অভিমতকে বৃহত্তর প্রেক্ষিতে রাখার জন্যও, যাতে সেই মতটাই ছাপ্পান্ন ইঞ্চি ছাতি নিয়ে ‘আমিই স্বর্গ আমিই ধর্ম’ হুঙ্কার দিতে না পারে। বহুমত, ভিন্নমতকে নিজের যুক্তির পাশে, এমনকী নিজের যুক্তিশৃঙ্খলার মধ্যে সসম্মান জায়গা করে দেওয়ার এই স্ব-ভাবে চিন্তার যে গণতান্ত্রিকতা নিহিত, এই প্রবন্ধগুলি তার স্বাক্ষর বহন করে।
এই স্বাভাবিক বহুত্ববাদের সঙ্গে বহু বিষয়ে গভীর আগ্রহের একটা সম্পর্ক আছে। যাঁদের চর্চার ভুবন বিস্তৃত, সচরাচর তাঁদের চিন্তার স্বভাবে গণতান্ত্রিকতা দেখি। এই গ্রন্থেও অমর্ত্য সেনের মনোজগতের বিস্তারকে চেনা যায়। তিনি লেখাগুলিকে তিনটি বর্গে ভাগ করেছেন: সংস্কৃতি, সমাজ ও পলিসি বা কর্মনীতি। যদিও জানি, তিনিই সবার আগে সতর্ক করে দেবেন, এই তিন বর্গের মধ্যে সীমান্তরেখা মোটেও সুনির্দিষ্ট নয়, এবং ‘যা স্বভাবত অনির্দিষ্ট, তাকে জোর করে নির্দিষ্ট করতে নেই, বরং সেই অনির্দিষ্টতাটাকেই প্রাঞ্জল করে বোঝাতে হয়।’ তাঁর ক্ষুরধার চিন্তা অনায়াসে সীমান্ত অতিক্রম করে বহু বিষয়ে আলো ফেলে: ভারতে সময় গণনা ও ক্যালেন্ডার নির্মাণের দীর্ঘ ও বিচিত্র ঐতিহ্য কিংবা রকমারি লোকপ্রিয় খেলার অন্তর্নিহিত শক্তি থেকে শুরু করে এ দেশে দারিদ্র, বুভুক্ষা, অপুষ্টি, অশিক্ষা, অস্বাস্থ্যের প্রকোপ, বহুমাত্রিক অসাম্যের সর্বগ্রাসী বিস্তার এবং এই বিপুল অন্যায়ের প্রতি সুবিধাভোগী বর্গের বিপুলতর ঔদাসীন্য, সেই ঔদাসীন্যের শরিক সংবাদমাধ্যমের খণ্ডিত ও বিকৃত দৃষ্টি, সমাজ, অর্থনীতি ও রাজনীতির অন্তর্নিহিত হিংস্রতা, মানুষকে তার বহু-পরিচয়ের রাজপথ থেকে উচ্ছিন্ন করে একক পরিচিতির কানাগলিতে বন্দি করার ফলে সেই হিংস্রতার স্ফীতি ও স্ফূর্তি— তালিকা স্বচ্ছন্দে অনেক দূর চলতে পারত।
কিন্তু অমর্ত্য সেন কেবল বহু বিষয়ের লেখক নন। কেবল অন্য মতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল উদার, গণতান্ত্রিক মনের প্রাবন্ধিক নন। তাঁর আলোচনা দাঁড়িয়ে থাকে একটি সুচিন্তিত নৈতিক ভিত্তির উপরে। যদি এক কথায় সেই ভিতটিকে বোঝাতে চাই, তবে বলতে হবে তার নাম ‘জাস্টিস’ বা ন্যায্যতা। এই ন্যায্যতা কোনও বিমূর্ত, পূর্বনির্ধারিত ধারণা নয়, বিভিন্ন পরিস্থিতিতে নানান মাপকাঠি দিয়ে ন্যায়-অন্যায়ের বিচার করতে হবে, এটাই তাঁর দি আইডিয়া অব জাস্টিস গ্রন্থের (২০০৯) অন্যতম সার কথা। কেমন সেই বিচার, এই সংকলনের নানা লেখাতেও তার বহু নজির আছে। একটির কথা বলি। বিশ্বায়ন দরিদ্রের পক্ষে ভাল, কারণ বিশ্বায়নের যুগে দরিদ্রের অবস্থা ভাল হয়েছে— এই বহুলপ্রচারিত যুক্তির জবাবে লেখক বলেন, বিশ্বায়ন না হলে দরিদ্রের অবস্থা যা হত, তার চেয়ে ভাল হয়েছে, এটা যথেষ্ট নয়, বিশ্বায়নের ফলে যে আর্থিক সমৃদ্ধি ঘটছে, তার বণ্টনে দরিদ্ররা ‘যথেষ্ট’ ভাগ পাচ্ছেন কি না, সেটাই বিচার্য। যদি তা না পান, তবে বিশ্বায়নকে ন্যায়ের প্রসারী বলা চলবে না। ‘যথেষ্ট’ কাকে বলে, সেটা আগে থেকে ঠিক করে দেওয়া যাবে না, বস্তুত সে বিষয়ে যুক্তি ও তথ্যের ভিত্তিতে নিরন্তর মুক্ত আলোচনা ও বিতর্কই ন্যায্যতার সন্ধানে এগিয়ে যাওয়ার প্রধান শর্ত।
বিশ্বায়নের ভাল-মন্দ বিশ্লেষণে বণ্টনের মাপকাঠি কেন জরুরি, তা বোঝাতে একটি উপমা দিয়েছেন লেখক। পিতৃতান্ত্রিক পরিবারে মেয়েরা অসাম্য আর বঞ্চনার শিকার হয়েই থাকেন। এ নিয়ে অভিযোগ করলে যদি বলা হয়, ‘পরিবার না থাকলে তো মেয়েদের অবস্থা আরও খারাপ হত’, তবে সেটা কুযুক্তির চমৎকার নজিরমাত্র। উপমাটি কেবল কাজেরই নয়, তা নির্ভুল ভাবে দেখিয়ে দেয়, অর্থনীতি এবং দর্শনের আলোচনায় সমাজভাবনা কী ভাবে আলো ফেলতে পারে। এই প্রসঙ্গে অনেক দিন আগে শোনা একটি কাহিনি মনে পড়ল। মিড ডে মিল-এর জন্য রান্না-করা খাবারের বদলে শুকনো খাবারের প্যাকেট চালানোর জন্যে ব্যবসায়ীরা এক বার খুব তৎপর হয়েছিলেন, কিছু সরকারি লোকজনকেও তাঁরা প্রায় পেড়ে ফেলেছিলেন। সেই সময় এ বিষয়ে এক আলোচনাসভায় অনেকে অনেক কথা বলার পরে অমর্ত্য সেন একটি বাক্য উচ্চারণ করেছিলেন: ‘স্কুলে প্যাকেট দিলে মেয়েগুলো তো কিছুই খাবে না, সব বাড়িতে নিয়ে যাবে।’
ন্যায্যতার প্রতিষ্ঠায় ভারতের কৃতিত্ব গর্ব করার মতো নয়, সেটা অমর্ত্য সেন বহু দিন ধরে অক্লান্ত ভাবে বলে আসছেন। কেবল শিক্ষায় নয়, সব বিষয়েই ‘ফার্স্ট বয়’দের নিয়ে মাতামাতির আড়ালে বহু মানুষের ধারাবাহিক বঞ্চনার প্রতি আমাদের ঔদাসীন্য তাঁকে পীড়া দেয়, তা এই লেখাগুলির ছত্রে ছত্রে প্রকট। কিন্তু নৈরাশ্য? নৈব নৈব চ। মোদী-জমানায় লিখিত ভূমিকাতেও তাঁর সাফ কথা: ‘তবু, আমরা চেষ্টা করলে অবস্থা বদলাতে পারে; সামাজিক বিভাজনের উত্তরাধিকার হিসেবে সংবাদমাধ্যম বা বিদ্যাজীবীরা যে (করুণ) ভূমিকা পালন করেছেন, চাইলেই তাঁরা সেখান থেকে মুক্তি পেতে পারেন।’ নিছক আশাবাদ নয়, এখানে নিহিত আছে ইতিহাসের শিক্ষাও। লেখক খেয়াল করিয়ে দেন, এই সে দিন যা ‘দূর অস্ত্’ মনে হয়েছিল, কত কম সময়ের মধ্যে তা কেবল সম্ভব নয়, নিতান্ত মামুলি ব্যাপার হয়ে উঠতে পারে! সত্যিই তো! ক্রীতদাস প্রথা এমন কিছু প্রাগৈতিহাসিক তো নয়। কিংবা বয়সে অনেক বড় রিকশাচালককে ভদ্রলোক বাঙালির অম্লানবদনে তুইতোকারি? সমাজ বদলায় বইকী। মনও।
লেখক নির্ঘাত মনে করিয়ে দেবেন, সে পরিবর্তন স্বয়ংক্রিয় হতে পারে না, তাকে সম্ভব করে তোলার জন্য আমাদের ‘শিক্ষিত, সংগঠিত, সক্রিয়’ হতে হবে। প্রশ্ন উঠতে পারে, শুধু এই? বিদ্রোহ নয়? বিপ্লব নয়? অমর্ত্য সেন হয়তো বলবেন, উত্তরটা মুক্ত বিতর্কের পথেই খোঁজা ভাল। আগুনখোর বিপ্লবীরা সে উত্তরে খুশি হবেন না, তবে সেটা তাঁদের সমস্যা।