বাঙালির জাতীয়তাবাদী মননে ‘অগ্নিযুগ’ বলে পর্বটা বহুচর্চিত, ঐ কালটা (১৯০৮-১৯১৮) যে ‘বোমা, বন্দুক, পিস্তলে রোমাঞ্চকর।’ সেই সব রোমাঞ্চকর মামলার সাক্ষ্যপ্রমাণ রূপে আদালতে পেশ করা ও আর্কাইভসে রক্ষিত বাজেয়াপ্ত প্রচারপত্র বা লিফলেট ও চটি পুস্তিকাগুলোর রাজনৈতিক তাৎপর্য ও সাংস্কৃতিক অভিঘাতের বিচার শুক্লা সান্যালের গবেষণার বিষয়। ওই পর্বের উপর অমলেশ ত্রিপাঠী, সুমিত সরকার, হীরেন চক্রবর্তী ও রজতকান্ত রায়ের গবেষণাগ্রন্থের যোগ্য উত্তরসূরি এই বইটি, স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল। যেমন, শুক্লার বইটি পড়ার টানে আমার মনে ভেসে ওঠে তারাপদ রায়ের স্মৃতিকথন, সরকারি আর্কাইভসের উপর ফরিদপুর বা পাবনার গরিব মৌলবি তায়েবউদ্দিনের ছায়া এসে পড়ে। গত শতকের ত্রিশের দশকের শেষে উপরি কিছু রোজগারের আশায় পুব বাংলার নানা শহরে তায়েবউদ্দিন ঘুরে ঘুরে বই বিক্রি করতেন, টিনের দুই বাক্স ভর্তি হরেক কিসিমের কেতাব, পাঁজি থেকে কিস্সা, বিষাদ সিন্ধু থেকে সচিত্র প্রেমপত্র। আর ঢোলা পিরানের বড় বড় পকেটে লুকিয়ে থাকত রাজরোষের প্রকোপে নিষিদ্ধ সব বই। খুব ‘বিশ্বস্ত’ ও ‘উৎসাহী’ পাঠক পেলে দেশের কথা-র মতো বই বার করা হত, গোপনে নেড়ে চেড়ে এক আধটু চোখ বোলানোর মতো বই, কিশোররা হয়তো বা উত্তেজনার আগুন পোয়াত, মৌলবির স্বাদেশিকতাও তৃপ্ত হত। হুলিয়া জারি হয়, বই ও প্রচার পুস্তিকারা ফেরারি, গোপন আস্তানা থেকে এলেবেলেদের হাত ধরে হঠাৎ উঁকি মেরে তারা কাজ সারে, সরকারি খবরদারির সঙ্গে লুকোচুরি খেলাটা চলতেই থাকে।
এই খেলার বিবরণ শুক্লার আলোচনার প্রাথমিক ভিত্তি। সরকারি নিয়ন্ত্রণের ঘেরাটোপে কী ভাবে প্রচারপত্রগুলি লেখা, ছাপা, বিলি করা ও পড়া হত, সেই কর্মকাণ্ডের একটি বিশ্বস্ত বিবরণ নানা টুকরো তথ্যের মাধ্যমে তিনি তৈরি করেছেন। জানতে পারি যে রাজা নন্দকুমার ও নবাব সিরাজদ্দৌলার নামে স্বাক্ষরিত উত্তেজনাকর প্রচারপত্র বিলি করা হত। অতি সাধারণ কাগজে পুরনো হাত-প্রেস বা লিথোতে ছাপা প্রচারপত্র বেনামি ডাকে পাঠানো হত, সেগুলি ইস্তাহার রূপে ফেরিঘাটে সাঁটা যেত বা স্কুলের ছাত্রদের বইতে গোঁজা থাকত। ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে মালদহ জেলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক নবীনচন্দ্র বসুর হত্যা মামলার নথিপত্রকে ব্যবহার করে শুক্লা দেখিয়েছেন যে নজরদারির বজ্র আঁটুনিতে ফসকা গেরো কী ভাবে কাজ করে, মাস্টারমশাইরা নিষিদ্ধ প্রচারপত্র বিলিও করতেন, আবার কেউ কেউ দক্ষ চর হিসেবেও কাজ করতেন। রাজভক্ত ও রাজবিদ্রোহীতে বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজ বিভক্ত, সরকারবিরোধী প্রচারপত্র রাখা ও পড়া এবং সেই দ্রোহপত্রের সুলুকসন্ধান করে পুলিশকে হদিশ দেওয়া ওই বিভাজনের অন্যতম অক্ষরেখা। ওই রেখায় ছাত্র ও মাস্টার পরস্পর পরস্পরকে মোকাবিলা করে, ছাত্রের হাতে শিক্ষক নিহত হন।
এই প্রচারপট থেকে শুক্লা চলে গিয়েছেন বাঙালির রাজনৈতিক চিন্তনের রূপ বিচারে। ক্রম অনুসারে ‘যুগান্তর’, ‘স্বাধীন ভারত’ ও ‘লিবার্টি’ নামমালার অন্তর্গত নানা প্রচারপত্রের বিষয় বিশ্লেষণ করে তাঁর রচনায় দেখানো হয়েছে যে বক্তব্যের অবয়ব বঙ্কিম, অরবিন্দ বা বিবেকানন্দের মত, কথা ও শব্দের বুনটে সাজানো হয়েছে, উদ্ধৃতিরূপে গীতার নির্বাচিত শ্লোকবিশেষ ঘুরে ফিরে এসেছে, হিন্দু পৌরাণিক রূপকল্প, চরিত্র ও ঘটনাই অতীত তুলনার প্রধান নির্দেশক। প্রায় সব প্রচারপত্রের উপস্থাপনার বিন্যাসটি দেশবাসী বনাম বিদেশি ‘ফিরিঙ্গি’র মধ্যে ধর্মযুদ্ধের ছকে সাজানো হয়, মাঝে মাঝে একেবারে সমসাময়িক দেশি ও বিদেশি ঘটনাও সেই ছকে খাপ খেয়ে যায়। প্রচারপত্রগুলি তো প্রণোদনার জন্য লেখা, এই প্রণোদনার মানসমণ্ডলটি চাকুরিজীবী, নানা উপস্বত্বভোগী স্বল্পবিত্ত বর্ণহিন্দুর সংস্কৃতিতেই পুষ্ট হয়েছিল। শুক্লার মতে, সেই সীমার মধ্যেই নাগরিক সমাজের জন্য ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষা বাঙালি মধ্যবিত্ত মানসে জেগে ওঠে। ফলে পুরাণকথা কেবল অলস অতীতচারিতা থাকে না, বরং ব্যর্থ বর্তমানকে অর্থবহ করার চেষ্টায় রূপ নেয়। প্রচারপত্রগুলির ধর্মিষ্ঠ আহ্বান ও উপস্থাপন ইংরেজ রাজের আইনি শাসনের ইতিবৃত্তকে স্বৈরাচার ও অধর্মের বিজয় বলে চিত্রিত করে তোলে, দেশজ মানসে ইংরেজ কর্তৃত্বের হিতবাদী ন্যায়ের ভিত্তিকে ধর্মদণ্ডের জিগির নড়বড়ে করে তোলে। বৈপ্লবিক প্রচারপত্রের উপস্থাপনায় ভাল ইংরেজ ও খারাপ ইংরেজের মধ্যে এ হেন তুলনাটা অবান্তর হয়ে ওঠে। অন্য পক্ষে, এ হেন প্রকল্পের মধ্যে বৈকল্পিক পৌর সমাজ ও রাজনীতির জন্য ভারতবাসীর সাধ ফুটে ওঠে। ফিরিঙ্গিদের অনস্তিত্ব সেই সাধ পূরণের প্রাকশর্ত, এই ধারণা পরিস্ফুট হয়, বাস্তবে সিদ্ধিলাভের প্রশ্নটি স্বতন্ত্র। আলোচনায় নানা ঐতিহাসিকের সঙ্গে শুক্লা মতবিনিময় করেছেন। অথচ বৈপ্লবিক জাতীয়তাবাদের ‘ধর্মিক’ চরিত্র প্রসঙ্গে রণজিৎ গুহের রচনা ‘অ্যান ইন্ডিয়ান হিস্টরিয়োগ্রাফি অব ইন্ডিয়া’-র নামোল্লেখ তিনি করেননি। আমার পড়ে মনে হয়েছে যে শুক্লার বিচার প্রকারান্তরে রণজিৎ গুহের অভিমতের কাছাকাছি।
বৈপ্লবিক প্রচারপত্রগুলির কেন্দ্রে সন্ত্রাস ও হিংসার যাথার্থ ও মাহাত্ম্যকথা আছে। এই উপস্থাপনার চরিত্র নিয়ে পূর্ণাঙ্গ আলোচনা সন্দর্ভটির সেরা অধ্যায়। উদ্দেশ্য সাধনে হিংসা উপায়মাত্র, উপেয় নয়, এই বিষয়ে প্রথমে কারও দ্বিমত থাকে না। কোন কোন পরিস্থিতিতে এই উপায় গ্রহণ অনিবার্য হয়ে ওঠে, তাই দিয়ে প্রতর্কের সূত্রপাত হয়। তারপরে শুক্লা দেখিয়েছেন যে আলোচনার টানে, যুক্তি ও উপমার ঝোঁকে, বাদ-প্রতিবাদে নানা মাত্রা যুক্ত হয়। দেশমাতার অপমান ও ইংরেজ অত্যাচারের প্রতিশোধরূপে হিংসার আশ্রয় নেওয়া সঙ্গত বলে মনে করা হত। দুর্বল স্বদেশবাসীকে অত্যাচারীর হাত থেকে রক্ষা করাটা পারিবারিক ও সামাজিক কর্তব্য, কাপুরুষতা ও আত্মসমর্পণ অপেক্ষা গুপ্ত সন্ত্রাস শ্রেয়। আবার ধর্মযুদ্ধের ছকে ঐতিহাসিক কর্তব্য ও দায়িত্বরূপেও হিংসার মাহাত্ম্য কীর্তিত হতে পারে। অধিকন্তু দেশ গড়তে গেলে আত্মবলিদান প্রয়োজন, স্বাধীনতার যজ্ঞে আহূতি দরকার। ঐ প্রজ্জ্বলিত যজ্ঞানলে দেশ শুদ্ধ হবে, জনজাগরণ ঘটবে, যেন ‘আমার জীবনে লভিয়া জীবন/ জাগরে সকল দেশ।’ ‘অপর’ কেউ নয়, বিপ্লবী নিজেই এই যজ্ঞের হোতা ও সমিধ। এই শহিদি তত্ত্ব ও শুদ্ধিতত্ত্ব একাকার হয়ে গেলে উপায় ও উপেয়ের ভেদজ্ঞান লোপ পায়। দুঃখভোগ ও আত্ম-উৎসর্গের শতেক কথাকণিকার বলয়ে জাতীয়তাবাদী তথা বৈপ্লবিক ‘সন্ত্রাসী’ শহিদের কলেবরে সন্তের মর্যাদা লাভ করেন, নৈতিক আদর্শের পরাকাষ্ঠারূপে তাঁর রক্তক্ষয়ী জীবন বন্দিত হয়।
শুক্লার ভাষা আঁটোসাঁটো, নৈর্ব্যক্তিক, বিশেষণবর্জিত। তবে আলোচনায় যেখানেই সম্ভব প্রচারপুস্তিকার আবেগমথিত ভাষা মূল বাংলায় তিনি উদ্ধৃত করেছেন। ফলে বিশ্লেষণের মাঝে মাঝেই সন্দর্ভের পাতায় ‘অভি’ মন্ত্র উচ্চারিত হয়, ‘রণচণ্ডী’ নেচে বেড়ান, ফিরিঙ্গির ‘রক্তপিপাসা’য় বাঙালিরা ছটফট করে, আর ‘নৃমুণ্ডমালিনীর খর্পরতলে আত্মবলিদান দিয়া অমরত্বের জন্য’ যুবকরা মুখিয়ে আছে। এই সবই বৈপ্লবিক প্রচারপত্রের বাচনিক বিন্যাস, অনুপ্রাসের ঝংকারে এবং উপমান ও উপমেয়ের মধ্যে তুলনার টানে উপমিতির বোধ সর্বগ্রাসী হয়ে ওঠে। জনপরিসরে বাঙালির রাজনীতির ভাষা একটি বিশেষ আকার নেয়, ভঙ্গিটা উপমার ছটায় উচ্চকিত, যুক্তির মনটা জ্বালাময়ী ও ক্রন্দনময়ী শব্দকথার জালে বন্দি। বাংলায় রাজনৈতিক ভাষার বাচনিক বিবর্তন, কুলজি বিচার ও অনুরণনের অভিঘাত নিয়ে বিশদ কাজ এখনও চোখে পড়েনি, এই বড় সমস্যার উত্থাপন শুক্লাও করেননি। কিন্তু নিজের ঐতিহাসিক গবেষণায় বিষয়বিন্যাস, কৃৎকৌশল ও বক্তব্য পেশ করার সূত্রে ওই গোত্রের বিচারের একটি মুখপাত তিনি করলেন, কারণ গণপরিসরে রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রথম প্রকাশ তো একটি বিশিষ্ট ভাষাভঙ্গির নির্মিতি।