সেই ১৮৬৮ সালে হান্টার লিখেছিলেন, ‘নিম্ন গাঙ্গেয় প্রদেশে বিশেষত বীরভূম ও সীমান্তবর্তী ভিন্ন সংস্কৃতির অন্য জেলার সাধারণ মানুষ যে ভাষায় কথা বলে সেই ভাষায় এমন সব শব্দ বা পদ ব্যবহৃত হয় যা কিছুতেই সংস্কৃত ভাষা থেকে আহরিত হয়নি। আর লিখিত বাংলা ভাষায় এই সব শব্দ বা পদ বাদ দেওয়া সত্ত্বেও এই সব জেলার কৃষক, পশুপালক বা অরণ্যবাসীরা এই ভাষাতেই কথা বলে। এই ভাষাতেই তারা তাদের ঘর-গেরস্থালির মায়া-মমতা প্রকাশ করে, এই ভাষাতেই তাদের ঘরের কোনও মা তার সন্তানের সঙ্গে কথা বলে’। (দি অ্যানালস অব রুরাল বেঙ্গল, তৃতীয় অধ্যায়)।
হান্টার সাহেবের কথা মনে পড়ল সব্যসাচী সেন সম্পাদিত বইটি হাতে পেয়ে। বা ঠিক করে বললে এই বইয়ের ‘ভাষা বিমোচন’ প্রবন্ধটি পড়তে গিয়ে, যেখানে শৈলেশ্বর ঘোষ সত্তর দশকে শুরু হওয়া ‘হাংরি জেনারেশন’ আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করেছেন। এখানে তিনি ক্ষমতার সঙ্গে ভাষার অঙ্গাঙ্গি সম্পর্কের কথা বলেছেন: ‘ক্ষমতার সঙ্গে ভাষার সম্পর্ক সহজ নয়, জটিল। ক্ষমতা যখন যার করায়ত্ত থাকে, সে নিজের আধিপত্য বিস্তার ও তাকে স্থায়িত্ব দেওয়ার আকাঙ্খায় বস্তুসমূহকে (নাম সমূহকে) ষড়যন্ত্রময় অবস্থানে নিয়ে যায়।’ ‘কেবলমাত্র অবদমিতের ভাষা— ক্ষমতার ভাষা ধ্বংস হলে যে ভাষার জন্ম হয়, সে-ই অধঃবাস্তবে নেমে গিয়ে সত্যকে তুলে আনতে পারে।’ বাংলা ভাষার প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, ‘বাংলা কবিতাজন্মের আতুর ঘরটি তৈরি হয়েছিল অবদমিতের ভাষায়। কিন্তু বৌদ্ধ ধর্মের বিকৃতি ও পতনের পর আবার শুরু হয় ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রাধান্য। ক্ষমতাশালী হিন্দুরা ব্রাহ্মণ্যদর্শনকে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার ও তাকে কায়েম রাখার কাজে প্রয়োগ করতে শুরু করেন। ভাষার দখল নিয়ে নেয় সমাজের শিক্ষিত উচ্চবর্গ, উচ্চশ্রেণি। আধিপত্যবাদী ব্রাহ্মণ্যদর্শন সৃষ্টি করে, ‘‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে’’— এই ভাষা।’
আধুনিক বাংলা ভাষার লিখিত রূপ বিশেষ করে সাহিত্যের ভাষা কিন্তু গড়ে উঠেছিল হান্টার সাহেবের চোখের সামনেই। দেড়শো বছর আগে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বা বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের হাতে যখন বাংলা সাহিত্যের ভাষার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হচ্ছে তখন শৈলেশ্বর ঘোষের প্রবন্ধে উল্লেখ করা ‘সমাজের শিক্ষিত উচ্চবর্গ, উচ্চশ্রেণি’ যে ‘আধিপত্যবাদী ব্রাহ্মণ্যদর্শন’-এর প্রয়োজনমাফিক বাংলা ভাষার লিখিত রূপকে জনজীবনের মুখের ভাষা থেকে আলাদা করে নিচ্ছে এটা হান্টার সাহেবের চোখ এড়ায়নি।
সত্তরের দশক শুধু বাংলায় কেন, গোটা ভারতবর্ষেই এক টালমাটাল সময়। খাদ্য সংকট, কমিউনিস্ট পার্টি ভাগ, কংগ্রেসের একচ্ছত্র রাজের সমাপ্তির সূচনা, সর্বোপরি আঞ্চলিক শক্তির উত্থান। মুম্বইয়ে ১৯৫৮-য় অনুষ্ঠিত হল মহারাষ্ট্র দলিত সাহিত্য সঙ্ঘের প্রথম সম্মেলন। শুরু হল অস্পৃশ্যদের কণ্ঠস্বর হয়ে দলিত সাহিত্য আন্দোলন। প্রায় একই সময় শক্তি চট্টোপাধ্যায়, মলয় রায়চৌধুরী, উৎপলকুমার বসু, বাসুদেব দাশগুপ্ত, দেবী রায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়দের নিয়ে ‘হাংরি জেনারেশন’ আন্দোলনের সূচনা করলেন। ১৯৬২-তে ‘সম্প্রতি’ পত্রিকায় শক্তি লিখলেন, ‘...আমাদের রাষ্ট্রনৈতিক বা সামাজিক পরিবেশে ‘‘ক্ষুধা সংক্রান্ত’’ আন্দোলনই হওয়া সম্ভব। ও দিকে ও দেশে সামাজিক অবস্থা অ্যাফ্লুয়েন্ট, ওরা বীট বা অ্যাংরী হতে পারে। আমরা কিন্তু ক্ষুধার্ত। যে কোনো রূপের বা রসের ক্ষুধাই একে বলতে হবে। ...কারণ এ আন্দোলনের মূল কথা ‘‘সর্বগ্রাস’’।’ পরে আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায়ে এসে শৈলেশ্বর ঘোষ ঘোষণা করলেন, ‘কবিতা মানুষের শেষ ধর্ম। বুদ্ধ যিশু রামকৃষ্ণ নয়— কবি/কবিতা পৃথিবীকে স্বাধীন মুক্ত করতে থাকবে ক্রমশ।’ তাঁর ইস্তাহারের ২৯ দফার মধ্যে তিনটি ঘোষণা ছিল: শিল্প নামক তথাকথিত ভুষিমালে বিশ্বাস না করা, সত্যকে সরাসরি বলা ও অভিজ্ঞতা ছাড়া সত্যকে ধরার কোনও উপায় নেই— শুদ্ধ বুদ্ধি জীবন সত্যকে ধরতে পারে না।
এই সংকলনের কবিতার অংশ শুরু হয়েছে শৈলেশ্বর ঘোষের সেই শিহরন সৃষ্টিকারী কবিতা ‘ঘোড়ার সঙ্গে ভৌতিক কথাবার্তা দিয়ে’। সেই ‘একশো ভাদ্রবধু সাধ খায়, কবিতারই শুধু রক্তপাত/দাতব্য চিকিৎসালয় খুলেছি আমরা পেচ্ছাপখানায়/কলকাতা গলে যায়—’। বা ‘তিন ঘণ্টা বসে আছি বেদনাপ্রধান চিঠি পকেটে/কলকাতা চৌরঙ্গী লেখা এমন নিস্তব্ধ বন্দুক হাতে/কতদিন ঘুম জাগা প্রহরায় কাটাই—’। বা সেই তুমুল বিতর্ক সৃষ্টিকারী ‘তিন বিধবা গর্ভ করে শুয়ে আছি পুণ্য বিছানায়/ হে ঘোড়া, কলকাতায় তিন গেলাস স্বাস্থ্যসুধাপান পরিত্রাণীহীণতা হাসে পুরুতের নামাবলীগীতা/ ধাতুধর্ম সাতবার গড়াগড়ি খায়—’। এই ‘তিন বিধবা’ কবিতা ছাপা হওয়ার পরই শক্তি চট্টোপাধ্যায় শৈলেশ্বরের উপর ক্রুদ্ধ হয়ে হাংরি জেনারেশন ছেড়ে দেন। রচনা সংগ্রহে এ ছাড়াও আছেন সুবো আচার্য আর তাঁর ‘ফাঁকা শহরের মধ্যরাতে আমি হেঁটে যাচ্ছি/দূর নিরুদ্দেশ আমাকে ডাক দিয়ে যায়/যেমন মানুষজন্ম অথবা নিগূঢ় কংকাল’ বা ‘আমার অস্তিত্বে ভয় পায় কেউ কেউ, কেউ ঘাড়হেঁট চলে যায়—/আমার রক্তভরা আর্তনাদ আমারই বুকের মধ্যে নিভে যায়—’, কবিতার নাম, ‘মানুষের পৃথিবী থেকে কবিতা শেষ হয়ে গেছে’। এর পর অরুণেশ ঘোষের ‘মানুষের বিরুদ্ধে মানুষ’ বা ‘মুক্তির সরাইখানা’ বা ফালগুনি রায়, নিত্য মালাকারের কবিতা হয়ে বাসুদেব দাশগুপ্তের ‘রন্ধনশালা’, সুভাষ ঘোষের ‘যুদ্ধে আমার তৃতীয় ফ্রন্ট’, সুবো আচার্যের ‘মড়ক’-এর মতো হাংরি গদ্য। হাংরি-র পুরনো বা নতুন সব কবি বা লেখকই কিন্তু অনায়াসে ব্যবহার করেছেন অবদমিতের ভাষা। এঁদের লেখায় অনায়াসেই চলে আসে প্রকৃত শ্রমিক-কৃষকের দৈনন্দিন ব্যবহৃত শব্দাবলি। ভালবাসা-ঘৃণা বা ক্রোধ বা ইতরামি প্রকাশে হাংরিদের কোনও ভণ্ডামি নেই, রূপক বা প্রতীক নয়, এঁদের লেখায় যৌনতা বা ইতরামির প্রকাশে থাকে অভিজ্ঞতার প্রত্যক্ষ বিবরণ— একেবারে জনজীবনের তথাকথিত শিল্পহীন কথা। সংকলনে আরও আছে অরুণেশ ঘোষ, শৈলেশ্বর ঘোষ ও বাসুদেব দাশগুপ্তের তিনটি সাক্ষাৎকার। এতে, বিশেষত বাসুদেব দাশগুপ্ত ও শৈলেশ্বর ঘোষের ক্ষেত্রে যিনি সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন ও যিনি দিচ্ছেন দুজনেরই প্রধান আগ্রহ যেন ছিল মলয় রায়চৌধুরীর নিজেকে হাংরি জেনারেশনের সৃষ্টিকর্তা বলে দাবির বিরুদ্ধে যুক্তি খাড়া করা। তা করতে গিয়ে শৈলেশ্বরের মতো মানুষও নিজের এক সময়কার সঙ্গী মলয় রায়চৌধুরীকে অপ্রত্যাশিত ভাবে ‘বিহারী-বাঙালিবাবুটি’ বলে ফেলেছেন।
অনেকেই প্রায় সমসময়ের নকশাল আন্দোলনের সঙ্গে হাংরি আন্দোলনকে তুলনা করে এদের অরাজনৈতিক তকমা দেন, কিন্তু ক্ষমতার সঙ্গে ভাষার সম্পর্ক নিয়ে হাংরি জেনারেশন যে প্রশ্ন তুলেছিল তা ছিল নকশালদের তোলা প্রশ্নের চেয়েও অনেক বেশি মৌলিক। এমনকী তুমুল প্রচার পাওয়া এবং নিজস্ব অস্তিত্ব তৈরি করা সত্ত্বেও দলিত সাহিত্য আন্দোলনকে শেষ পর্যন্ত হাংরি আন্দোলনের থেকে পিছিয়েই রাখতে হয়। দাবি-দাওয়া, জমায়েত বা প্রথাগত রাজনৈতিক প্রতিবাদ আন্দোলনকে প্রথম থেকেই সাহিত্য আন্দোলনে জড়িয়ে রাখায় এই আন্দোলন দ্রুতই বুর্জোয়া কুঅভ্যাসগুলিতে আক্রান্ত হয়।
হাংরি আন্দোলন শুরুর প্রায় পঞ্চাশ বছর পর সেই সময় ও পরবর্তী কালে এই আন্দোলনে যোগ দেওয়া কবি ও গদ্যলেখকদের রচনাসংগ্রহ সম্পাদনায় উদ্যোগী হয়ে সব্যসাচী সেন খুবই প্রয়োজনীয় কাজ করেছেন। তবে উৎপলকুমার বসুর ‘পোপের সমাধি’ কবিতাটি বর্তমান সংগ্রহে না থাকাটা রীতিমতো বিস্ময়কর। আর হাংরি আন্দোলন নিয়ে ‘সম্প্রতি’ পত্রিকায় প্রকাশিত শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের পুরো প্রবন্ধটিও থাকা উচিত ছিল। সর্বোপরি সমীর রায়চৌধুরী ও মলয় রায়চৌধুরী প্রসঙ্গ। সম্পাদকীয়ের শুরুতেই আমরা সম্পাদকের এক ‘বন্ধু’র বয়ানে জেনে যাই, ‘এই (হাংরি কিংবদন্তি) গ্রন্থে মলয় রায়চৌধুরী অতীব যত্ন সহকারে নিজেকে হাংরি আন্দোলনের স্রষ্টা বলে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেছেন যা সর্বৈব মিথ্যা। হাংরি সাহিত্যের স্রষ্টা হলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়।’ সে ক্ষেত্রে যতই শক্তি চট্টোপাধ্যায় শৈলেশ্বর ঘোষের ‘তিন বিধবা’ কবিতা প্রকাশের পর আন্দোলন থেকে বিদায় নিন, অন্তত ঐতিহাসিক কারণে তাঁর ‘সীমান্ত প্রস্তাব ১/ মুখ্যমন্ত্রীর প্রতি নিবেদন’ কবিতাটি এখানে অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত ছিল। আর, শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে এই আন্দোলনের সৃষ্টিকর্তা ধরে নিলে তিনিই যখন আদালতে দাঁড়িয়ে ‘এটা ঘটনা যে, এই সাহিত্য আন্দোলন (হাংরি জেনারেশন) আমি কয়েক জন বন্ধুকে নিয়ে শুরু করেছিলাম’ বলে সাক্ষ্য দেন আর কয়েক জন বন্ধুর মধ্যে মলয় রায়চৌধুরী থাকেন তখন মলয় সৃষ্টিকর্তা হোন বা না হোন তাঁর অন্তত একটি লেখা এই সংকলনে ঠাঁই পাওয়ার অধিকার পেয়ে যায়। বিশেষ করে তাঁর যে লেখার জন্য এত কোর্ট কাছারি এত সাক্ষ্যদান সেই ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক কুঠার’ থাকবে না? শক্তি বা আরও অনেক কবিই এই লেখাটিকে বাজে লেখা বলেছিলেন, কিন্তু ইতিহাসের দাবিতেই এই লেখা বা সমীর রায়চৌধুরীর লেখা এই সঙ্কলনভুক্ত হওয়া উচিত ছিল। সম্পাদকীয়তে বলা আছে, ‘সুভাষ ঘোষের একটি বক্তব্যে জানা যাচ্ছে—‘‘তখন হাংরি জেনারেশনের প্রথম পর্ব শেষ... শেষ পর্বে ঝাঁকের কই মিশে গ্যাছে ঝাঁকে— আমাদের নিয়ে ’৬৩-’৬৪তে আরম্ভ দ্বিতীয় পর্বের’’—। এই সংগ্রহকে ‘হাংরি জেনারেশন (দ্বিতীয় পর্ব)’ বললে মলয়, সমীর, শক্তি বা উৎপলকুমার বসুর লেখা বাদ দেওয়ার যুক্তি বোঝা যেত। অন্য দিকে যতই মলয় রায়চৌধুরী উদ্বাস্তুদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ করে থাকুন বা নিজের বুর্জোয়া অতীত নিয়ে গর্ব প্রকাশ করুন বা ১৯৬৪ সালে হাংরি জেনারেশনের মৃত্যু ঘোষণা করুন, তাতে তিনি যে ১৯৬৫-র আগে পর্যন্ত অর্থাৎ হাংরি জেনারেশনের প্রথম পর্বের এক জন ছিলেন এটা তো অপ্রমাণ হয় না। অর্থাৎ কোথাও যেন একটু উদারতার অভাব থেকে গেল।