পুস্তক পরিচয় ২

প্রেমের ইতিহাসে বৃহত্তর প্রেক্ষিত জরুরি ছিল

ভারতীয় ইতিহাসচর্চায় এক সময় প্রেম-ভালবাসা ইত্যাদি সম্পর্কে গবেষণামূলক লেখালিখির বিশেষ চল ছিল না, সৌভাগ্যবশত দু-এক দশক ধরে পরিবার, দাম্পত্য, ভালবাসা, গৃহস্থালি, ইত্যাদি সম্পর্কে বিবিধ গবেষণার মাধ্যমে সে অনীহা অংশত হলেও দূর হয়েছে।

Advertisement

অপরাজিতা দাশগুপ্ত

শেষ আপডেট: ২২ অক্টোবর ২০১৬ ০০:০০
Share:

ডিজায়ার অ্যান্ড ডিফায়েন্স: আ স্টাডি অব বেঙ্গলি উইমেন ইন লাভ। অপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়। ওরিয়েন্ট ব্ল্যাকসোয়ান, ১০৯৫.০০

ভারতীয় ইতিহাসচর্চায় এক সময় প্রেম-ভালবাসা ইত্যাদি সম্পর্কে গবেষণামূলক লেখালিখির বিশেষ চল ছিল না, সৌভাগ্যবশত দু-এক দশক ধরে পরিবার, দাম্পত্য, ভালবাসা, গৃহস্থালি, ইত্যাদি সম্পর্কে বিবিধ গবেষণার মাধ্যমে সে অনীহা অংশত হলেও দূর হয়েছে। আলোচ্য বইটিতে বিধৃত ১৮৫০-১৯৩০, আশি বছরের বিস্তৃত ক্যানভাসে বাঙালি মেয়েদের প্রেমে পড়া (‘বৈধ’ ও ‘অবৈধ’, দুই ভাবেই) এবং সেই সূত্রে তাঁদের সোচ্চার আত্মপ্রতিষ্ঠার ইতিহাস। কামনাবাসনা এবং ‘বিদ্রোহের’ ইতিহাস রচনার চেষ্টা করা হয় বলেই পাঠকের মনেও আশার সঞ্চার হতে থাকে যে, নিশ্চয়ই, কিছুটা হলেও অন্য রকম একটা গল্পের অবতারণা করছেন লেখক। কিন্তু কী ভাবে এগোয় সেই গল্প?

Advertisement

প্রথম পরিচ্ছেদেই পেশ করা হয় জনা ত্রিশেক দম্পতির একটি দীর্ঘ তালিকা। কমবেশি সেলিব্রিটি এই সব ব্রাহ্ম নারী-পুরুষদের প্রেমকাহিনি অবশ্য ইতিমধ্যেই বহু আলোচিত। শ্রীপান্থ, পূর্ণেন্দু পত্রী কিংবা চিত্রা দেবের লেখনীতে বহু বার ঘুরেফিরে এসেছে এ সব বৃত্তান্ত। তফাত হল, এই বইটির ভাষা ইংরেজি। চিত্তাকর্ষক এই প্রেমকাহিনিগুলি চমৎকার ভাবে সাজিয়ে ইংরেজি-বোদ্ধা পাঠকের জন্য পেশ করেছেন অপর্ণা, যদিও নতুন কথা তেমন কিছু বলেননি।

পরবর্তী পরিচ্ছেদগুলির বিষয়বস্তু হল, উপন্যাসে প্রেমের চিত্রণ, ব্যভিচার, কুলত্যাগ, কুলটা নারী, কামনাবাসনা, অসুখ ও মৃত্যু। বিষয় হিসেবে নতুন ও অভিনব। অপর্ণা এই সব থিমের পরিসরে নারীর আত্মনির্মাণ ও আত্মঘোষণার গল্পই বলতে চেয়েছেন, ফলে প্রায় অনুল্লিখিত থেকে গিয়েছে পাশাপাশি বয়ে-যাওয়া বড় সময় ও ইতিহাসের ঘটনাক্রম, যা কিন্তু অনিবার্য ভাবেই বাঙালির ভালবাসার ইতিহাসেও ছায়াপাত করছিল। মনে রাখা দরকার, এই বইয়ে বিবৃত বিষয়গুলির কালক্রমের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হল, জাতীয়তাবাদী চিন্তার অভ্যুত্থান এবং সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে তার বৌদ্ধিক চাপান-উতোর। জাতীয়তাবাদী বাঙালি ভদ্রলোকের চেতনায় ও লেখনীতে আদর্শ গৃহস্থালি, পরিবার ও সমাজ, আদর্শ রমণী এবং ‘বিশুদ্ধ’ প্রেমকে নির্মাণ করা হচ্ছিল ক্রমাগত, যা পরবর্তী পর্যায়ে নারীর আত্মপ্রতিষ্ঠার ধারাটিকে আত্মসাৎ বা অস্বীকার করতে চেয়েছিল বিভিন্ন ভাবে। এই বৃহত্তর বৌদ্ধিক প্রতর্কের কাঠামোটির আলোচনা থাকলে বইটি সমৃদ্ধতর হতে পারত। বৃহত্তর রাজনৈতিক-সামাজিক এই প্রেক্ষিতটিকে ধরার চেষ্টা করেননি বলেই বোধ হয় অপর্ণার গোটা বক্তব্যই নারীবাদের এক ধরনের একমাত্রিক ছকের মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে। সমাজবদ্ধ বাঙালি ভদ্রলোকের মনন বা চিন্তার বিষয়টি সচেতন ভাবে দূরে রাখার দরুনই সমাজ ও পরিবারের পরিসরের মধ্যে ভালবাসার আখ্যান নিয়ে এই বই খুব একটা ভাবিত নয়। ভাবনা যা কিছু, তার সবই সমাজের চোখে দোষাবহ ও শাস্তিযোগ্য প্রেমের স্বাধীন বিস্তারকে ঘিরে।

Advertisement

সেখানেও অবশ্য এই বইয়ের প্রধান অসুবিধে হল পারম্পর্যের অভাব। বস্তুত গল্প কখনও ঠিক সরলরৈখিক ভাবে এগোতে পারে না। যেমন, বিশ শতকের ‘উদ্ধার গৃহ’গুলির (rescue home) কথা বলে, এবং রাঁধুনি হিসেবে মেয়েদের বিকল্প জীবিকা খুলে যাওয়ার বক্তব্য (যা মূলত স্বপ্না বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্যেরই অনুলিখন) পেশ করেই অপর্ণা পরের পরিচ্ছেদে চলে যান ঊনবিংশ শতকে মেয়েদের পতিতাবৃত্তি গ্রহণ সম্পর্কে আলোচনায়। আবার একই পরিচ্ছেদের ভিতরেই নবীন সেনের ১৯০৮ সালে লেখা আত্মজীবনীতে তাঁর পরনারী আসক্তির বৃত্তান্ত (যাতে বিধৃত মধ্য-উনিশ শতকের সময়কাল) শুনিয়েই অপর্ণা লাফিয়ে চলে যান ১৯৩০-এর দশকে আশালতা সিংহের বিবাহ-বহির্ভূত প্রেম এবং তা নিয়ে শনিবারের চিঠি-তে জলঘোলা হওয়ার আলোচনায়, আবার পরমুহূর্তেই বিবৃত করেন ১৮৭২-এর চাঞ্চল্যকর মোহান্ত-এলোকেশী সংবাদের খুঁটিনাটি। মোটের উপর ব্যভিচার আর কুলত্যাগের উপর সার্বিক মনোনিবেশ করতে গিয়ে বইয়ের কালক্রমের ধারাবাহিকতা আর পারম্পর্য ক্ষুণ্ণ হয়েছে অনেক সময়েই।

বৈধব্য সংক্রান্ত আলোচনায় বইটিতে অবশ্যম্ভাবী ভাবেই উঠে আসে বিধবাদের সম্পত্তির বিষয়টি। কিন্তু, আশ্চর্য ভাবে এই আলোচনা থেমে যায় ১৮৭০-এর দশকেই। ১৯৩০-এর দশকে হিন্দু মহাসভার উত্থান এবং হিন্দু বিধবাদের বিষয়ে তাদের মতামত উল্লেখ করলে তা বিশ শতকের নতুন বক্তব্যকে বুঝতে সাহায্য করত। হিন্দু বাঙালি সমাজের ক্রমবর্ধমান মুসলমান বিদ্বেষের ফলেই যে স্বেচ্ছায় কুলত্যাগও পরিণত হয় বিধর্মীর হাতে নারীহরণের গল্পে, তা অবশ্য অপর্ণা উল্লেখ করেছেন। কিন্তু এই গল্প তৈরির পিছনে সমসাময়িক রাজনৈতিক সমীকরণগুলি ঠিক কী ভাবে কাজ করেছিল, তার উল্লেখ থাকলে বৃহত্তর প্রেক্ষিতটি বুঝতে পাঠকের সুবিধা হত।

দু-একটি অত্যন্ত কৌতূহলকর বিষয় অপর্ণা উল্লেখ করেই ছেড়ে দিয়েছেন। যেমন, বিশ শতকে পতিতাদের উদ্ধারকল্পে যে ‘উদ্ধার গৃহ’গুলি গড়ে উঠছিল, সেগুলি নাকি প্রায়শই গুপ্ত-পতিতাবৃত্তির আখড়া হয়ে উঠছিল, কেশব সেনের পুত্রবধূ মৃণালিনীও নাকি এমন অভিযোগ করেছিলেন।— এমন একটি চাঞ্চল্যকর তথ্য পেশ করেই অপর্ণা ক্ষান্ত থেকেছেন। বিষয়টি স্পষ্ট করে ব্যাখ্যা করলে কলকাতার সামাজিক ইতিহাসের ইতিবৃত্তে তা একটি অভিনব সংযোজন হত অবশ্যই।

সব মিলিয়ে বইটি বাঙালি নারীর প্রেম, স্বাধীনতাচিন্তা এবং যৌনতার ইতিহাসে একটি সুন্দর সংযোজন। তথ্যগুলিকে অযথা তত্ত্বভারাক্রান্ত করার কোনও চেষ্টা বইটির মধ্যে চোখে পড়ে না, শুধু শেষ অংশ ছাড়া। তবে একটু আশ্চর্যই লাগে, যখন শেষ দিকে হঠাৎ পেশ করা হয় ইউরোপের ইতিহাসে প্রাচীন কাল থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত যৌন বঞ্চনার সঙ্গে মূর্ছা বা হিস্টিরিয়ার প্রত্যয়টির সম্পর্কের ব্যাখ্যান। গোটা বিষয়টিকেই বেশ একটু প্রক্ষিপ্ত বলে মনে হয়। এই প্রক্ষেপের সূত্র ধরেই বইয়ের ষষ্ঠ তথা অন্তিম পরিচ্ছেদে হঠাৎ আসে বাঙালি মেয়েদের নভেল পড়ার সঙ্গে হিস্টিরিয়া, অসুখ ও মৃত্যুর এক সম্পর্কসূত্র গড়ে তোলার চেষ্টা। যদিও অপর্ণার নিজের কাছেই, বোধ করি মেয়েদের এই আত্মহত্যাপ্রবণতা এবং যৌন বঞ্চনার বিষয়টি বিশেষ স্পষ্ট নয়। তিনি এক বার বলেন, নারীবাদী চিন্তার নিরিখে মেয়েদের আত্মহত্যাপ্রবণতাকে সমসাময়িক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবেও ভাবা যেতে পারে। যে জীবন তাদের শুধু বঞ্চনা দিয়েছে, ব্যর্থ হয়েছে সব সাধ-আহ্লাদ পূরণে, তার বিরুদ্ধে এই মেয়েরা আত্মহত্যার মাধ্যমে নাকি কায়েম করেছিল তাদের জীবনের উপর তাদের স্বকীয় প্রভুত্ব বা সার্বভৌমত্বই।

এ এক অদ্ভুত ধোঁয়াটে যুক্তি। জানতে ইচ্ছে করে, এই মেয়েরা কারা (স্নেহলতা বা নিভাননীর মতো বহু-আলোচিত দৃষ্টান্তগুলি বাদ দিলে), সংখ্যাতেই বা তাঁরা কত জন, যাঁরা পিতৃতন্ত্রের শোষণের বিরুদ্ধে যুঝতে না পেরে আত্মবলিদানের পথ বেছে নিয়ে বকলমে জীবনেরই জয়গান গাইলেন? এই রকম কূটতর্কের মাধ্যমে নারীবাদী বক্তব্যের আমদানি করাটা একটু ঘুরিয়ে নাক দেখানো হয়ে গেল না কি? সব মিলিয়ে তবে কী দাঁড়াল? সমস্ত কামনাবাসনার টুঁটি টিপে ধরে রেখেছিল যে পিতৃতন্ত্র, মেয়েরা কি তার নিষ্করুণ নিষ্পেষণের বেদিতেই বলিপ্রদত্ত হলেন, না কি তাঁরা দলে দলে স্বেচ্ছামৃত্যুর পথ বেছে নিয়ে জীবনের জয়গান গাইলেন? ঠিক বোঝা গেল না— খটকা রয়েই গেল, কাদম্বিনী কি মরিয়া প্রমাণ করিল যে সে মরে নাই?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement