মুদ্রায় লক্ষ্মীলাভ

চায়ের দোকান, আনাজ বিক্রি কিংবা ছোট কারখানা। যে কোনও নতুন ব্যবসা শুরু করতে অথবা পুরনোটিরই বাড়বাড়ন্তের জন্য কেন্দ্রের মুদ্রা প্রকল্পের হদিস দিলেন  তিমির বরণ চট্টোপাধ্যায়এমন নয় যে, যাঁরা ব্যবসা শুরু করতে চান, তাঁদের জন্য পুঁজি বা ঋণের বন্দোবস্ত সরকারি তরফে নেই।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৮ জুন ২০১৮ ০৮:০০
Share:

নিজের ছোট্ট ব্যবসা। অনেকের কাছে স্বনির্ভর হতে তা একান্ত জরুরি। আবার অনেকের তা স্বপ্নও। কিন্তু নতুন ব্যবসা শুরু কিংবা তাকে বড় করার ক্ষেত্রে হামেশাই বাধা হয়ে দাঁড়ায় পুঁজির অভাব। গৌরী সেন তো আর অত সহজে সকলের ভাগ্যে জোটে না।

Advertisement

এমন নয় যে, যাঁরা ব্যবসা শুরু করতে চান, তাঁদের জন্য পুঁজি বা ঋণের বন্দোবস্ত সরকারি তরফে নেই। সত্যি বলতে স্বনির্ভরতার পথে পা বাড়ানোয় সহায়তা দিতে কেন্দ্র ও রাজ্যের বিভিন্ন প্রকল্প ইতিমধ্যেই চালু রয়েছে। যার আওতায় ঋণ পাওয়ার পথও সহজ। কিন্তু আমরা অনেকেই তার হালহদিস জানি না। যেমন, প্রকল্পে ঋণ পেতে কোথায় আবেদন জানাতে হবে, কী কী কাগজপত্র লাগবে, এই সব ঠিক মতো আমাদের নখদর্পণে থাকে না। তাই জুতোর সুখতলা খইয়ে বার বার ব্যাঙ্কের দরজায় হত্যে দিয়েও হাতে আসে না ঋণের টাকাও। দরজা খোলে না ব্যবসারও। কিছু ক্ষেত্রে আবার পথ আগলে দাঁড়ায় বিপুল বন্ধকের বাধ্যবাধকতা। তখন বাধ্য হয়ে পরিচিত কারও কাছে চড়া সুদে ধার নিতেও বাধ্য হন অনেকে। তাই আমার মতে, ব্যবসায় পা রাখতে হলে কিংবা তাকে বড় করার পরিকল্পনা থাকলে, সবার আগে এই সমস্ত খুঁটিনাটি জানা জরুরি।

সব প্রকল্প নিয়ে তো একসঙ্গে আলোচনা করা যাবে না। তাই আজ শুধু প্রধানমন্ত্রী মুদ্রা প্রকল্পের দিকেই নজর রাখব আমরা। নতুন ব্যবসা শুরু কিংবা চালু ব্যবসাকে কিছুটা বড় করার জন্য যে প্রকল্প আনার কথা জানিয়েছে কেন্দ্র। তবে আড্ডার শুরুটা না হয় ছোট ব্যবসার সমস্যা নিয়েই করা যাক।

Advertisement

সমস্যা কোথায়?

ছোট ব্যবসা বা সংস্থাগুলিকে যে সমস্ত সমস্যায় সাধারণত ভুগতে হয়, সেগুলি হল—

• ব্যবসা চালুর জন্য মূলধন জোগাড় করতে না পারা।

• বন্ধক দেওয়ার মতো সম্পদ হাতে না থাকা।

• সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে উপযুক্ত প্রশিক্ষণের অভাব।

• সংস্থা পরিচালনার দক্ষতা তৈরি না হওয়া।

• প্রযুক্তি ও তার ব্যবহার সম্পর্কে ধারণা না থাকা।

এর মধ্যে প্রথম দু’টি সমস্যার সমাধান খুঁজতে মুদ্রা প্রকল্পের দ্বারস্থ হওয়া যায়। পরিচালনা, প্রশিক্ষণ বা প্রযুক্তির ব্যবহার শিখে নিলেও হাতে মূলধন না থাকলে কিন্তু ব্যবসা চালুই করা যাবে না। তাই সেই সমস্যার সুরাহা করতেই কেন্দ্রের এই প্রকল্প।

মুদ্রা প্রকল্প কী?

জাতীয় আয়ের অনেকটা জুড়ে থাকে অসংগঠিত ছোট শিল্প ও ছোট ব্যবসা। লক্ষ লক্ষ মানুষ এই সব সংস্থায় কাজ করেন। ফলে ব্যবসা চালু বা সম্প্রসারণের জন্য যাতে তাদের ঋণ পেতে অসুবিধা না হয়, তার বন্দোবস্ত করতেই আনা হয়েছে মুদ্রা যোজনা বা মুদ্রা প্রকল্প।

এই প্রকল্পের আওতায় ঋণ পাওয়ার জন্য বাড়তি কোনও সম্পত্তি বন্ধক রাখতে হয় না। অর্থাৎ, যে দোকানের জন্য ধার নিচ্ছেন, তা হয়তো বন্ধক থাকল। কিন্তু তা বলে বাড়িও বন্ধক রাখতে হবে না।

রকমফের

ধারের অঙ্কের নিরিখে এই প্রকল্পে তিনটি ভাগ আছে—

• শিশু: যাঁদের ৫০,০০০ টাকা পর্যন্ত মূলধন প্রয়োজন, তাঁরা এই ‘শিশু’ প্রকল্পে ঋণের আবেদন করতে পারেন।

• কিশোর: ৫০,০০০ টাকার বেশি থেকে ৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত ঋণ মেলে এই প্রকল্পে।

• তরুণ: এতে ঋণের অঙ্ক হয় ৫ থেকে ১০ লক্ষ টাকা।

কেন্দ্র মুদ্রা যোজনার জন্য ১ লক্ষ কোটি টাকা পর্যন্ত অতিরিক্ত বরাদ্দের কথা বলেছে। যার মধ্যে ৪০% যাবে শিশু প্রকল্পে, ৩৫% কিশোর আর ২৫% তরুণ খাতে।

কীসের জন্য ধার?

আগেই বলেছি, নতুন ব্যবসা চালু এবং পুরনো ব্যবসা সম্প্রসারণে মুদ্রা যোজনার আওতায় ঋণ পাওয়া যায়। যে সব ক্ষেত্রে তা মিলতে পারে, তাদের মধ্যে রয়েছে—

• ছোট কারখানা ও দোকান

• ফল ও আনাজ বিক্রি

• কারিগরির কাজ

• বাণিজ্যিক গাড়ি কেনা

• কার্যকরী মূলধন জোগাড়

• কারখানা এবং মেশিন কেনা

• ব্যবসার জায়গা সাজানো

• বিভিন্ন ব্যবসায়িক গোষ্ঠী এবং গ্রামীণ শিল্পের জন্য ওভারড্রাফটের ব্যবস্থা করতেও ঋণ মেলে এই প্রকল্পে।

মনে রাখুন

• এই প্রকল্পে কৃষিকাজের জন্য ঋণ পাওয়া যায় না।

• শুধু ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত কাজকর্মের জন্যই ঋণ মেলে। যেমন, কেউ মুদ্রা ঋণে গাড়ি কিনলে শুধু ব্যবসার প্রয়োজনেই ব্যবহার করা যাবে। ব্যক্তিগত কাজে নয়।

যোগ্যতা

• ন্যূনতম বয়স হতে হবে ১৮ বছর।

• খুলতে হবে নতুন ব্যবসা। কিংবা পুরনো ব্যবসাকে আড়েবহরে বড় করার স্পষ্ট পরিকল্পনা থাকতে হবে।

• শুধু ছোট সংস্থাই এ জন্য আবেদন করতে পারবে।

আবেদনের পদ্ধতি

• প্রথমে যেতে হবে কোনও বাণিজ্যিক ব্যাঙ্ক (রাষ্ট্রায়ত্ত অথবা বেসরকারি), ব্যাঙ্ক নয় এমন আর্থিক প্রতিষ্ঠান (এনবিএফসি) অথবা ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থার কাছে।

• কী ব্যবসা করতে চান, তা বোঝাতে কাগজ তৈরি করতে হবে। ঋণের আবেদনের সঙ্গে জমা দিতে হবে।

• ব্যাঙ্কের নির্দেশ মেনে দিতে হবে ব্যবসা সংক্রান্ত বাদবাকি কাগজও। যেমন, প্যান, যোগ্যতার প্রমাণপত্র (তা শিক্ষাগত যোগ্যতাও হতে পারে) ইত্যাদি।

কাগজ কী কী?

মুদ্রা যোজনায় মূলত দু’ভাবে ঋণ নেওয়া যায়। এ জন্য কাগজপত্রও আলাদা লাগে। চলুন দেখি—

কিস্তিতে ঋণ

এই ধরনের ঋণে একলপ্তে টাকা না নিয়ে ধাপে ধাপে তা নিতে পারেন ঋণগ্রহীতা। এ জন্য লাগবে—

• প্রকল্পের আবেদনপত্র এবং কিস্তিতে ঋণ নেওয়ার ফর্ম (দু’টিই ভর্তি থাকতে হবে)।

• ছবি-সহ পরিচয়পত্র এবং ঠিকানার প্রমাণপত্র।

• ব্যবসার প্রমাণ।

• শেষ ছ’মাসের ব্যাঙ্ক স্টেটমেন্ট।

• ব্যবসা যে আপনার নামেই, তার প্রমাণপত্র। নইলে অন্তত বাড়ি এবং অফিসের ঠিকানার প্রমাণপত্র।

• কোনও ধরনের কারিগরি শিক্ষা নিয়ে থাকলে, তার যোগ্যতার সার্টিফিকেট।

• ট্রেড লাইসেন্স সংক্রান্ত কাগজপত্র ইত্যাদি।

গোষ্ঠী হিসেবে অথবা গ্রামীণ ব্যবসায়

প্রথমটির ক্ষেত্রে অনেকে মিলে একটি গোষ্ঠী তৈরি করে ঋণের জন্য আবেদন করা যায়। প্রতি ব্যাঙ্কের গ্রামাঞ্চলে ঋণ দেওয়ায় বাধ্যবাধকতা থাকে, তার আওতায় আবার আসে দ্বিতীয় ধরনের ঋণ। দু’ক্ষেত্রেই কাগজ লাগবে—

• প্রকল্পের আবেদনপত্র এবং বিজনেস ইনস্টলমেন্ট লোন অথবা রুরাল বিজনেস ক্রেডিট আবেদনপত্র (দু’টিই ভর্তি করতে হবে)।

• ছবি-সহ পরিচয়পত্র এবং ঠিকানার প্রমাণপত্র।

• ব্যবসা যে আপনার নামেই, তার প্রমাণপত্র। অথবা বাড়ি এবং অফিসের ঠিকানার প্রমাণপত্র।

• কত দিন ধরে ব্যবসা করছেন, তার প্রমাণপত্র।

• শেষ ১২ মাসের ব্যাঙ্ক স্টেটমেন্ট।

• শেষ ২ বছরের আয়কর রিটার্ন জমার প্রমাণ।

মুদ্রা কার্ড

প্রতি ঋণগ্রহীতাকে একটি করে মুদ্রা কার্ড দেওয়া হয়। এর মাধ্যমে ব্যাঙ্কে না গিয়েও এটিএম থেকেই ঋণের টাকা তোলা যেতে পারে। যন্ত্রপাতি কেনার সময়ে সরাসরি এই কার্ড ব্যবহার করেও টাকা মেটানো সম্ভব।

যদি কোনও সময় কোনও ভাবে হাতে বাড়তি টাকা আসে, তা হলে এই কার্ডের মাধ্যমেই কিন্তু তা অ্যাকাউন্টে জমা করা যায়। এ ভাবে কমানো যায় আসল ও সুদের পরিমাণ।

লেখক কর ও বিনিয়োগ বিশেষজ্ঞ

(মতামত ব্যক্তিগত)

পাঠকের প্রশ্ন?

প্রঃ সম্প্রতি সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিয়েছি। জানতে চাই, সিনিয়র সিটিজেন সেভিংস স্কিমের আওতায় কোনও রাষ্ট্রায়ত্ত বা সরকারি ব্যাঙ্কে যদি ১৫ লক্ষ টাকা লগ্নি করি, তা হলে কি আমি আয়কর আইনের ৮০সি ধারায় দেড় লক্ষ টাকা পর্যন্ত কর ছাড়ের সুবিধা পেতে পারি? এই হিসেবের মধ্যে পিএফ বা পিপিএফের ছাড়কে ধরছি না আমি। এই মুহূর্তে সিনিয়র সিটিজেন সেভিংস স্কিমে সুদের হার কত?

শঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, বৈদ্যবাটি

সিনিয়র সিটিজেন সেভিংস স্কিম বা প্রবীণ নাগরিক সঞ্চয় প্রকল্পে করা লগ্নি আয়কর আইনের ৮০সি ধারায় বছরে সর্বাধিক ১.৫০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত কর ছাড় পাওয়ার যোগ্য। এই দেড় লক্ষ টাকা ছাড়ের সুবিধা নেওয়া যেতে পারে একক ভাবে। যেমন শুধু সিনিয়র সিটিজেন সেভিংস স্কিমে লগ্নি করে। আবার চাইলে এর সঙ্গে এই ধারায় অন্যান্য প্রকল্পে লগ্নি মিলিয়েও। প্রবীণ নাগরিকদের সঞ্চয় প্রকল্পে এখন সুদ দেওয়া হচ্ছে ৮.৩ শতাংশ হারে।

পরামর্শদাতা:

অমিতাভ গুহ সরকার

পরামর্শের জন্য লিখুন:

‘বিষয়’, ব্যবসা বিভাগ,

আনন্দবাজার পত্রিকা,

৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা, পিন-৭০০০০১।

ই-মেল: bishoy@abp.in

ঠিকানা ও ফোন নম্বর জানাতে ভুলবেন না

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement