বিপর্যস্ত: সেনসেক্সের পতনে উদ্বিগ্ন লগ্নিকারী। বৃহস্পতিবার বিএসই-তে। রয়টার্স
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনাভাইরাস সংক্রমণকে অতিমারি (প্যানডেমিক) ঘোষণা করতেই, বিশ্ব জুড়ে ফের আর্থিক মন্দা ঘনিয়ে আসার ভয় জাঁকিয়ে বসল লগ্নিকারীদের মনে। ইউরোপ থেকে আমেরিকায় প্রবেশের উপরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নিষেধাজ্ঞা বসানোর পরে আরও বাড়ল সেই কাঁপুনি। এতটাই যে, বৃহস্পতিবার তাসের ঘরের মতো হুড়মুড়িয়ে পড়ে গেল প্রায় সব দেশের সমস্ত শেয়ার সূচক। ধসের কবলে পড়ে ‘রক্তাক্ত’ হল ভারতও। রেকর্ড গড়ে সেনসেক্স এই প্রথম এক দিনে নামল ৩০০০ পয়েন্টের কাছাকাছি। যে বাজার কিছু দিন আগেও দেশীয় অর্থনীতির ঝিমুনিকে তেমন আমল না-দিয়ে পেরিয়ে গিয়েছিল ৪২ হাজারের শিখর, তা-ই আবার ফিরে এল ৩২ হাজারের ঘরে। প্রায় আড়াই বছর বাদে। আর তার ধাক্কায় প্রায় ১১ লক্ষ কোটি টাকার শেয়ার সম্পদ খুইয়ে বসলেন লগ্নিকারীরা। ৮৬৮ পয়েন্টের রেকর্ড পতনের জেরে নিফ্টিও ফিরেছে ন’হাজারের ঘরে।
ভাইরাসের ছড়িয়ে পড়া রুখতে দেশীয় নাগরিকদের বিদেশ যাত্রা ও বিদেশিদের দেশে ঢুকতে দেওয়ার ক্ষেত্রে কড়াকড়ি এখন বিশ্ব জুড়ে। বিশেষজ্ঞদের দাবি, এটাই উস্কে দিয়েছে বিশ্ব অর্থনীতিতে ফের মন্দা চেপে বসার আশঙ্কা। সেই ২০০৮ সালের মতো। শেষ পর্যন্ত সত্যিই সেটা হলে, নিস্তার পাবে না ভারতও। যে দেশের অর্থনীতি এমনিতেই এখন ঝিমোচ্ছে দীর্ঘ দিন ধরে কাহিল চাহিদার জেরে।
বিশ্লেষকদের দাবি, এই বিশ্বায়নের যুগে কোনও দেশ একা হয়ে ভাল থাকে না। বন্দর দিয়ে পণ্যের আসা-যাওয়া বন্ধ, বিমানবন্দর প্রায় ফাঁকা, আমদানি-রফতানি আটকে যাচ্ছে, মাথা খুঁড়ছে চাহিদা। অবস্থা এতটাই সঙ্গিন যে অশোধিত তেলও বিক্রি হচ্ছে কম। দু’দিন আগে ২৯ বছরের তলানি ছুঁয়েছিল তার দাম। এ দিন অতটা না-হলেও দাম থেকেছে নিম্নমুখীই। ব্যারেলে ৩৩-৩৪ ডলারের আশেপাশে। তাঁদের মতে, আন্তর্জাতিক ব্যবসার পথ বন্ধ হলে, বিভিন্ন দেশ যেমন তাদের সব পণ্য বেচতে পারবে না, তেমনই সেগুলি তৈরির পথও আটকে যেতে পারে। কারণ একটি পণ্য তৈরি করতে নানা রকম কাঁচামালের জন্যও অনেকে অন্য দেশের উপরে নির্ভর করে।
সোমবার ১৯৪১.৬৭ পড়ে রেকর্ড গড়েছিল সেনসেক্স। মন্দার আতঙ্কে মাত্র দু’দিনের দূরত্বে সেই রেকর্ডই ভাঙল এ দিন। এই নিয়ে মাত্র ৭ দিনে সূচকটি নামল প্রায় ৫৩৬৫ পয়েন্ট।
তাল মিলিয়ে নাগাড়ে পড়ছে ডলারের নিরিখে টাকার দামও। এ দিনও এক লাফে ৬০ পয়সা বেড়ে এক ডলার হয়েছে ৭৪.২৮ টাকা।
শেয়ার সংক্রান্ত গবেষণাকারী সংস্থা ভ্যালু রিসার্চের সিইও ধীরেন্দ্র কুমার বলেন, ‘‘এই প্রথম সরাসরি কোনও আর্থিক কারণ ছাড়াই চূড়ান্ত বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে সারা বিশ্ব। তবে এই ভাইরাস যে শেষ পর্যন্ত অর্থনীতিতেই সব থেকে বেশি আঘাত হানবে তা-ও স্পষ্ট।’’ তাঁর দাবি, অবস্থা এমন জায়গায় পৌঁছচ্ছে যে মুনাফা তো দূরের কথা, বহু শিল্প সংস্থার টিকে থাকাই কঠিন হতে পারে।
কলকাতা স্টক এক্সচেঞ্জের প্রাক্তন সভাপতি কমল পারেখের দাবি, ‘‘বহু দেশই বিদেশিদের ঢুকতে দিচ্ছে না। ভারতও বিদেশি পর্যটকদের ভিসা দেওয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। ফলে এক দিকে পর্যটন শিল্প, অন্য দিকে বিমান সংস্থাগুলি চূড়ান্ত আর্থিক সঙ্কটে। বহু সংস্থা কাঁচামাল আমদানি করতে না-পেরে বিপাকে। মার খাচ্ছে আমদানি-রফতানি।’’ কমলের দাবি, চিন থেকে বহু কাঁচামালের আমদানি আটকে যাওয়ায় ভারতের মতো অনেক দেশকে অন্য দেশ থেকে বেশি দামে কাঁচামাল কিনতে হচ্ছে। ফলে ডলারের খরচ বাড়ছে। যে ডলারের দাম এখন চড়া। ফলে সমস্যা ঘিরেছে সব দিক থেকে।
এ সবেরই বিরূপ প্রভাব ভারত-সহ বিভিন্ন দেশের অর্থনীতিতে পড়ছে, বলছেন বাজার বিশেষজ্ঞ অজিত দে। তাঁর দাবি, ‘‘আসলে কেউ শেয়ার ধরে রাখতে সাহসই পাচ্ছে না। বিদেশি লগ্নিকারী সংস্থাগুলিরও একই অবস্থা। নাগাড়ে এত শেয়ার বিক্রিই টেনে নামাচ্ছে সূচককে।’’ এ দিনই ভারতে বিদেশি লগ্নিকারী সংস্থাগুলি ৩৪৭৫.২৯ কোটি টাকার শেয়ার বেচেছে।