এক জন স্বাগত জানিয়েও সতর্ক করলেন। আর অন্য জনের তরফ থেকে বরাদ্দ রইল কটাক্ষ। মুডি’জের রেটিংয়ে এক ধাপ ওঠা নিয়ে চব্বিশ ঘণ্টা পেরিয়েও দেশের দু’প্রান্তে মোদী সরকারকে বিঁধলেন মনমোহন সিংহ এবং পি চিদম্বরম। ইউপিএ জমানায় অর্থনীতির দুই কাণ্ডারি। একই বিষয়ে চাঁচাছোলা আক্রমণের পথে হাঁটলেন কংগ্রেস নেতা তথা প্রাক্তন তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী কপিল সিব্বলও।
প্রত্যেকের বক্তব্যেরই নির্যাস হল, রেটিং এক ধাপ ওঠায় উচ্ছ্বসিত হওয়ার কোনও কারণ নেই। বরং নজর দেওয়া জরুরি বেহাল অর্থনীতির দিকে। বিশেষত যা আরও ধাক্কা খেয়েছে নোটবন্দি এবং তড়িঘড়ি জিএসটি চালুর জেরে।
প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের মতে, রেটিংয়ে উন্নতি স্বাগত। কিন্তু তা বলে কেন্দ্র যেন না-ভাবে যে, এতে অর্থনীতির যাবতীয় সমস্যা উবে গেল কর্পূরের মতো। আর প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী চিদম্বরমের কটাক্ষ, এই সে দিনও মুডি’জের রেটিং পদ্ধতি নিয়েই প্রশ্ন তুলেছে মোদী সরকার। তা নিয়ে লম্বা চিঠি দিয়েছেন তৎকালীন আর্থিক বিষয়ক সচিব শক্তিকান্ত দাস। দাবি তোলা হয়েছে তা পাল্টানোর জন্য। অথচ এখন সেই মুডি’জের খাতায় এক ধাপ উঠেই উচ্ছ্বসিত কেন্দ্র।
এক যুগেরও বেশি সময় পেরিয়ে (প্রায় ১৪ বছর পরে) শুক্রবারই ভারতের রেটিং এক ধাপ বাড়িয়েছে আন্তর্জাতিক মূল্যায়ন সংস্থা মুডি’জ। Baa3 থেকে এক ধাপ উঠে তা হয়েছে Baa2। সেই অটলবিহারী বাজপেয়ীর জমানার পরে এই প্রথম। সেই সাফল্য প্রচারে কোমর বেঁধে নেমে পড়েছে মোদী সরকারও। কিন্তু কেন তাতে বড় সাফল্যের গন্ধ পাওয়ার অবকাশ নেই, এ দিন অর্থনীতির যুক্তি তুলে ধরে সেই বিষয়টিই সামনে এনেছেন মনমোহন-চিদম্বরম।
এ দেশে উদার অর্থনীতির ভগীরথ মনমোহনের কথায়, ‘‘প্রতি গ্যালন অশোধিত তেলের দাম এখন ৬২-৬৪ ডলার। অথচ মাস কয়েক আগেও তা ছিল ৪০-৪৫ ডলারে। যা বাণিজ্যিক ভারসাম্য এবং ঘাটতিকে ধাক্কা দিতে পারে।’’ অর্থাৎ তিনি সূক্ষ্ম ভাবে মনে করিয়ে দিয়েছেন যে, গত কয়েক বছরে ভারতীয় অর্থনীতির পক্ষে সব থেকে বড় সুখবর ছিল বিশ্ব বাজারে অশোধিত তেলের দাম কম থাকা। এতে আমদানি বাবদ অনেক কম ডলার গুনতে হয়েছে। নিয়ন্ত্রণে রাখা সহজ রয়েছে রাজকোষ ঘাটতি। কিন্তু এখন সেই তেলের দরই ঊর্ধ্বমুখী। তাই সেই সুবিধা খোয়ানোর ধাক্কা দেশের অর্থনীতির পক্ষে সামাল দেওয়া সহজ হবে না বলে মনে করছেন তিনি।
অনেকের মতে, এই বিষয়টি আরও প্রাসঙ্গিক যেহেতু এখন রেটিংয়ে এক ধাপ ওঠার দৌলতে রাজকোষ ঘাটতির লক্ষ্যচ্যুতি মেনে নেওয়া অনেক বেশি কঠিন হবে সরকারের পক্ষে। যে কোনও মূল্যে ওই ঘাটতিকে লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে বেঁধে রাখা নিয়ে আরও চাপ বাড়বে কেন্দ্রের উপর। কারণ, মুডি’জ-এর মূল্যায়ন ভাল হওয়ার অন্যতম কারণই এই আশা যে, সরকার সংস্কারের পথেই থাকবে। রাজকোষ ঘাটতিতে রাশের রাস্তা থেকে।
প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী চিদম্বরম আবার কৌশলে খোঁচা দিয়েছেন ঠিক সেই জায়গায়, যা নিয়ে বিস্তর প্রশ্ন উঠেছে আগের দিন। অনেকেই বলছেন, গত বছর বিশ্ব বাজারে অশোধিত তেলের দর এখনকার তুলনায় কম ছিল। বেশি ছিল ভারতের আর্থিক বৃদ্ধির হার। সম্ভাবনা অনেক কম ছিল ঘাটতি মাত্রাছাড়া হওয়ারও। কিন্তু তখন কেন্দ্র লাগাতার সওয়াল করে যাওয়া সত্ত্বেও রেটিং বাড়ায়নি মুডি’জ। তাঁদের প্রশ্ন, এ বার তা হলে ঠিক কোন সম্ভাবনার আলো দেখে তা করল তারা?
হয়তো সেই কারণেই গতকাল জোরালো ছিল জল্পনা যে, এর আগে ভারতকে রেটিং ঠিকমতো না-দেওয়া নিয়ে মূল্যায়ন সংস্থাগুলির দিকে মোদী সরকারের লাগাতার তোপও হয়তো কিছুটা চাপে ফেলেছে মুডি’জকে। এ দিন সরাসরি সেই প্রসঙ্গ না-তুলে প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী শুধু বলেছেন, ‘‘২০১৫-’১৬ সালে বৃদ্ধির হার ছিল ৮%। ২০১৬-’১৭ সালে ৭.১%। আর ২০১৭-’১৮ আর্থিক বছরে তা হওয়ার কথা ৬.৭%। উন্নতি না অবনতি আপনারাই বুঝে নিন।’’
চিদম্বরমের মতে, অর্থনীতির স্বাস্থ্য কেমন, তা যাচাইয়ে প্রধান লক্ষণ মূলধন তৈরির পরিমাণ, বেসরকারি লগ্নি, ঋণের চাহিদা বৃদ্ধি (বিশেষত ছোট সংস্থার) এবং কর্মসংস্থান। এই সবগুলিতেই এই মুহূর্তে ভারতের অবস্থা তথৈবচ বলে তাঁর দাবি।