পুরোপুরি ছন্দে ফেরার আগেই ফের ছন্দপতনের আশঙ্কা ঘিরে ধরল রাজ্যের চর্মশিল্পকে।
নোট সঙ্কটের ধাক্কা কাটিয়ে সবে উৎপাদন ও রফতানি বাড়ানোর দিকে নজর দিতে শুরু করেছিল চর্মনগরী বানতলা। এই পরিস্থিতিতে উত্তরপ্রদেশে যোগী আদিত্যনাথ সরকারের অবৈধ কসাইখানা বন্ধের নির্দেশে প্রমাদ গুনছেন রাজ্যের চর্ম ব্যবসায়ীরা। তাঁদের আশঙ্কা, এর জেরে কাঁচা চামড়ার জোগান আরও কমবে। ব্যাহত হবে পণ্য উৎপাদন।
বস্তুত, গত দেড় বছরে গোটা দেশেই কাঁচা চামড়ার জোগান তলানিতে ঠেকেছে। পরিস্থিতি আরও সঙ্গীন করেছে উত্তরপ্রদেশ-সহ বিভিন্ন রাজ্যে কসাইখানায় কোপ। ফলে কাঁচমালের ঘাটতিতে মার খাচ্ছে দেশ জুড়ে প্রায় ১৫০০টি ট্যানারি। যেগুলির সঙ্গে জড়িয়ে ১০ লক্ষেরও বেশি মানুষের রোজগার। ঘাটতি পূরণে তৈরি চামড়ার আমদানি বাড়াতে হয়েছে প্রায় ৭০%। ব্রাজিল, নিউজিল্যান্ড ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ এক লাফে রফতানি বাড়িয়ে নিয়েছে প্রায় ১৫%। আর আমদানির এই বাড়বাড়ন্তে রুজি-রুটি হারাচ্ছেন চামড়া প্রক্রিয়াকরণের কাজে যুক্ত লক্ষাধিক শ্রমিক। সব মিলিয়ে চূড়ান্ত সমস্যায় ১,১০০ কোটি ডলারের (প্রায় ৭১,৫০০ কোটি টাকা) শিল্প। যার ছায়া পড়েছে পশ্চিমবঙ্গেও।
সমস্যা
• দেশ জুড়ে কাঁচা চামড়ার জোগানে ভাটা
• মার খাচ্ছে ১,৫০০ ট্যানারি
• বিদেশ থেকে তৈরি চামড়ার আমদানি বৃদ্ধি
• লক্ষাধিক শ্রমিকের রুটি-রুজিতে টান
এ রাজ্য চামড়ার যে সব জিনিসপত্র রফতানি করে, তার ৭৫ শতাংশই দস্তানা (গ্লাভস)। টাকার অঙ্কে মোট ব্যবসার ৫৫% এই পণ্যটির দখলে। যা তৈরি হয় মোষের চামড়া দিয়ে। আর সেই চামড়ার ৩০% জোগায় উত্তরপ্রদেশ। এ বার বানতলার ব্যবসায়ীদের আশঙ্কা, যোগী মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরে ওই রাজ্যে যে ভাবে বেআইনি কসাইখানার বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হয়েছে, তাতে সেই জোগান প্রায় বন্ধেরই জোগাড়। অথচ মোষের চামড়ার বদলে অন্য পশুর চামড়া দিয়ে দস্তানা তৈরি করলে বরাত হারাতে হতে পারে বলে মনে করছেন তাঁরা।
লেদার এক্সপোর্ট প্রোমোশন কাউন্সিলের রমেশ জুনেজার দাবি, পশ্চিমবঙ্গের চর্মশিল্পে প্রয়োজনীয় কাঁচা চামড়ার মাত্র ২০% রাজ্য থেকে পাওয়া যায়। বাকি ৮০ শতাংশের জন্য অন্য রাজ্যের উপর নির্ভরশীল ব্যবসায়ীরা। উত্তরপ্রদেশের পাশাপাশি যে তালিকায় রয়েছে মহারাষ্ট্রও (প্রায় ২৫%)। কিন্তু ‘গো-হত্যা’ বন্ধ সংক্রান্ত নিষেধাজ্ঞার জেরে সেখান থেকেও জোগান কার্যত বন্ধ বলে অভিযোগ চর্ম ব্যবসায়ীদের।
রাজ্যের আশঙ্কা
• উত্তরপ্রদেশে কসাইখানায় কোপ আরও কমাবে কাঁচা চামড়ার জোগান
• দুর্ভোগ বাড়বে ট্যানারিগুলির
• কমবে উৎপাদন
• ধাক্কা খাবে দস্তানা রফতানির ব্যবসাও
• মূলত উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র থেকেই দস্তানার কাঁচামাল, মোষের চামড়া আনে রাজ্য
• অন্য চামড়ায় দস্তানা বানাতে হলে মার খাবে বরাত
তবে শুধু এ রাজ্য নয়, একই অবস্থা কোলাপুর, চেন্নাই, কানপুরের মতো চর্মশিল্প কেন্দ্রগুলিরও। আর এই ঘাটতির সুযোগ নিয়েই লাফিয়ে বাড়ছে আমদানি। ২০১৪-’১৫ সালে বিদেশ থেকে ৩৫০ কোটি টাকার তৈরি চামড়া কিনেছে ভারত। ২০১৫-’১৬ সালে সেই অঙ্ক বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬০০ কোটিতে। অর্থাৎ প্রায় ৭০% বেশি। আর ২০১৬-’১৭ সালে তা আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা। ফলে বাড়ছে পণ্য উৎপাদনের খরচও। ব্যবসায়ীদের নালিশ, এর ফলে প্রতিযোগিতার বাজারে পিছিয়ে পড়ছে দেশ।
পরিসংখ্যানেও সেই পিছিয়ে পড়ার ছবিটা স্পষ্ট ধরা পড়েছে। ২০১৪-’১৫ সালে দেশ থেকে জুতো-সহ অন্যান্য চামড়ার জিনিস রফতানি হয়েছিল ৬৪৯ কোটি ডলারের বেশি। ২০১৫-’১৬ আর্থিক বছরে তা নেমে এসে দাঁড়িয়েছে ৫৮৬ কোটি ডলারে। অর্থাৎ সব মিলিয়ে ১০% কমে গিয়েছে রফতানি। বিশ্ব বাজারে চর্মশিল্পের হাল এখন এমনিতেই খারাপ। বিশেষজ্ঞদের মতে, ইউরোপের মতো বাজারে মন্দার কারণে চর্মশিল্পের রমরমা কমেছে। আর সেই বাজারে কাঁচামালের অভাবে আরও কোণঠাসা হয়ে পড়ছে ভারত।