গাড়ি তৈরি বন্ধ হয়ে গিয়েছে বছর তিনেক আগে। ঝাঁপ বন্ধ কারখানার। তবু স্মৃতি, আড্ডা আর নস্টালজিয়ায় আজও অমলিন দেশে তৈরি প্রথম গাড়ি ‘অ্যাম্বাসাডর’। এতটাই যে, রাস্তায় নতুন গাড়ি না-নামা সত্ত্বেও সোশ্যাল মিডিয়ায় তাকে নিয়ে চর্চা কখনও থামেনি। জল্পনা হয়েছে নতুন করে বাজারে ফিরলে, ওই গাড়ির চেহারা কেমন হবে, তা নিয়ে। এক কথায়, ‘মরেও তা কখনও মরেনি।’ গোলমাথা গাড়ির প্রতি এই নাছোড় ভাললাগা আর স্মৃতিমেদুরতার নাড়ি টিপেই অ্যাম্বাসাডর ব্র্যান্ডটিকে কিনে নিল ফরাসি বহুজাতিক পুজো।
স্বাধীনতার পর থেকে উত্তরপাড়া কারখানায় অ্যাম্বাসাডর তৈরি করত সি কে বিড়লা গোষ্ঠীর সংস্থা হিন্দুস্তান মোটরস। বিএসই-কে তারা জানিয়েছে, অ্যাম্বাসাডর ব্র্যান্ড ও ট্রেডমার্ক ৮০ কোটি টাকায় পুজো গোষ্ঠীর কাছে বিক্রি করার কথা। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সোশ্যাল মিডিয়ায় আরও জোরালো হয়েছে জল্পনা। এ বার কি তবে ‘পুজো’, ‘সিট্রন’-এর মতো নামী ব্র্যান্ডের গাড়ি নির্মাতার হাত ধরে নতুন অবতারে ফিরবে অ্যাম্বাসাডর? আরও এক ধাপ এগিয়ে কেউ কেউ বলছেন, উত্তরপাড়ার অদূরেই চন্দননগর ছিল ফরাসি উপনিবেশ। তাঁদের আশা, ফের এক ফরাসি সংস্থার হাত ধরেই হয়তো নতুন করে দৌড় শুরু হবে ব্র্যান্ড-অ্যাম্বাসাডরের।
সেই পাঁচের দশকে ব্রিটিশ গাড়ির মডেল ‘মরিস অক্সফোর্ড’-এর আদলে উত্তরপাড়ায় তৈরি শুরু হয় অ্যাম্বাসাডর। দেশে প্রথম তো বটেই, সারা এশিয়ায় দ্বিতীয় গাড়ি কারখানা ছিল এটি। তারপরে টানা প্রায় চার দশক দেশের রাস্তায় প্রায় একাধিপত্য ছিল তার। প্রেসিডেন্ট-প্রধানমন্ত্রীর গাড়ি থেকে শুরু করে আমজনতার ট্যাক্সি— সবই তখন অ্যাম্বাসাডরময়। রোজকার খবর থেকে জীবনে, প্রায় সর্বত্র এত লম্বা সময় এ ভাবে জড়িয়ে থেকেই তার এমন এক ডাকে চেনা কিংবদন্তি ব্র্যান্ড হয়ে ওঠা।
অনেকে বলেন, এ দেশের এবড়ো-খেবড়ো রাস্তাতেও নিরাপদ ও আরামদায়ক সফরের জন্য অ্যাম্বাসাডরের জুড়ি নেই। তার পোক্ত চেহারা, মালপত্র নেওয়ার অঢেল জায়গা আর ভীষণ পরিচিত গোল মাথার গড়ন দশকের পর দশক মন কেড়েছিল গাড়িপ্রেমীদের। ওই গাড়ি ছাড়া অন্য কিছু কেনার উপায়ও অবশ্য নয়ের দশকে অর্থনীতির আগল খোলার আগে প্রায় ছিল না। তাই দীর্ঘ চার-পাঁচ দশক তখন মন্ত্রী-আমলাদের গাড়ি মানে লালবাতি লাগানো সাদা অ্যাম্বাসাডর। আবার ট্যাক্সি হলে সেই একই গাড়ি হলুদ-কালো। বহু সিনেমায় গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে নায়ক-নায়িকার গান মানে প্রায় অবধারিত ভাবে অ্যাম্বাসাডর। বিশেষত সাদা-কালো সিনেমার যুগে। আবার ভিড়ে ঠাসা রাস্তা-হাঁটু পর্যন্ত জল টপকাতে কিংবা বাড়ির সকলকে নিয়ে বেড়াতে যেতেও দীর্ঘদিনের একমাত্র দোসর ছিল এই অ্যাম্বাসাডরই।
পুজোর কাছে ব্র্যান্ড বিক্রির খবর শুনে এই স্মৃতির সরণিতেই ডুব দিচ্ছেন অস্টিন ডিস্ট্রিবিউটরের কর্ণধার সঞ্জয় পতোদিয়া। কলকাতায় এই গাড়ির দুই ডিলারের মধ্যে তাঁদেরটিই শেষ পর্যন্ত চালু ছিল। তিনি বলেন, ‘‘আমার ঠাকুরদা রামেশ্বর প্রসাদ পতোদিয়া ১৯৫০ সালে অ্যাম্বাসাডরের ডিলার হন। প্রয়াত মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের জন্য ওই গাড়ি রাজ্য সরকার কিনেছিল আমাদের কাছ থেকেই। এ শহরের বহু ফিল্মস্টার, শিল্পপতির গাড়িও গিয়েছে আমাদের কাছ থেকে।’’ অ্যাম্বাসাডর ব্র্যান্ডের প্রতি তাঁর টান আজও এতটাই পোক্ত যে, পুজোর হাত ধরে তা বাজারে ফিরলেই, তিনি ফের তার ডিস্ট্রিবিউটর হতে রাজি।
পতোদিয়া বলছিলেন, এক সময়ে ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য সাদা আর ট্যাক্সির জন্য হলুদ-কালো ছাড়া আর কোনও রঙের অ্যাম্বাসাডর তৈরি হত না। কারখানা থেকে গাড়ি এনে মেটালিক-সিলভার, মেটালিক-রেডের মতো বিভিন্ন রং চাপানো হত তাঁদের সার্ভিস স্টেশনেই।
বেঙ্গল মোটর স্পোর্টস ক্লাবের ভাইস প্রেসিডেন্ট সুজিত রায়ের আবার মনে পড়ছে তাঁর প্রথম অ্যাম্বাসাডরের কথা। যা কিনা হাতফেরতা ছিল। তাকে মনের মতো করে নিতে পার্ক সার্কাসের বাবুজান মিস্ত্রির কাছে ছুটেছিলেন তিনি। পরে যোগ দিয়েছিলেন কলকাতা-শিলচর মোটর র্যালিতে। বন্ধুর আর একটি পুরনো অ্যাম্বাসাডর (সংক্ষেপে অনেকের প্রিয় অ্যাম্বি) নিয়ে গিয়েছিলেন কলকাতা-জামশেদপুর র্যালিতেও। বন্ধুর নতুন অ্যাম্বিতে র্যালি জয় এখনও তাঁর চোখে ভাসে।
তবে শুধু আবেগ আর নস্টালজিয়ায় তো ব্যবসা চলে না। তাই সময়ের সঙ্গে বদলাতে না-পারার মাসুল গুনতে হয়েছে অ্যাম্বাসাডরকেও। সুজুকির হাত ধরে মারুতির চাকা গড়ানোর আগে এ দেশের রাস্তায় যে-গাড়ির প্রায় একচেটিয়া কব্জা ছিল, নয়ের দশকে অর্থনীতির আগল খুলে যাওয়ার পরে তীব্র প্রতিযোগিতায় যুঝতে পারেনি তারা। রুগ্ণ হয়ে পড়েছে হিন্দমোটরস। চুক্তিমাফিক কখনও মিৎসুবিশির যাত্রী গাড়ি, তো কখনও হাল্কা বাণিজ্যিক গাড়ি তৈরির মাধ্যমে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা তারা করেছে বটে। কিন্তু হালে পানি পায়নি। ৮০-র দশকে বছরে ২৪ হাজার অ্যাম্বাসাডর বিক্রি হত। ২০১৩-’১৪ সালে তা নেমে আসে আড়াই হাজারে। অন্য সংস্থা যেখানে প্রতি বছর কর্মী পিছু গড়ে ৩৬৫টি গাড়ি তৈরি করে, সেখানে হিন্দমোটরসে সেই সংখ্যা শেষ দিকে দাঁড়িয়েছিল একেরও কম। তার মানে, যেখানে অন্য সংস্থায় এক জন কর্মী প্রতিদিন গড়ে একটি করে গাড়ি তৈরি করছেন, সেখানে এক বছর ধরেও একটি গাড়ি বানাতে পারেননি হিন্দমোটরসের একজন কর্মী। শেষমেশ ২০১৪ সালের মে মাসে তালা পড়েছে কারখানায়। বন্ধ হয়ে যায় সেই গাড়ি তৈরি, যা আর রাস্তায় নামবে না বলে আমুল বিজ্ঞাপন করে— ‘দেশ দুঃখিত’।
এর পরে সম্প্রতি ভারতে যৌথ ভাবে গাড়ি তৈরি ও বিক্রির জন্য পুজোর সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধার কথা জানায় সি কে বিড়লা গোষ্ঠী। আর তারপরে এই ব্র্যান্ড বিক্রি। যদিও ওই ব্র্যান্ড-নামে পুরনো আদলের গাড়ি ফের তৈরি হবে কি না, কিংবা উত্তরপাড়া কারখানার তালা খুলবে কি না, সেটা তারা স্পষ্ট করেনি।
একটি গাড়ি টানা পাঁচ দশক ব্যবসা করছে, এমন নজির বিশ্বে নেই বলে জানাচ্ছেন ‘ভিন্টেজ’ গাড়ি সংগ্রাহক তথা বিশেষজ্ঞ সঞ্জয় ঘোষ। তবে তাঁর মতে, বাজার থেকে হারিয়ে যাওয়াই ভবিতব্য ছিল অ্যাম্বাসাডরের। তাঁর কথায়, ‘‘তখন চলেছে কারণ আর কোনও বিকল্প ছিল না। সুবিধা পেয়েছে একচেটিয়া বাজারের। নকশা বা প্রযুক্তি উন্নয়নের দিকে নজর দেওয়ার কথা ভাবেনি।’’ এখন তাই পুজোর হাত ধরে উন্নত প্রযুক্তি আর আকর্ষণীয় নকশাকে সঙ্গী করে ওই কিংবদন্তি ব্র্যান্ড আবার ফিরবে বলে আশা অনেকের।
নেহাতই কাকতালীয়। কিন্তু পুজোর এই ঘোষণার পর থেকে দিনভর চর্চার কেন্দ্রে থেকেছে ইউটিউবের একটি ভিডিও। দেখা যাচ্ছে, ২০০২-এ একটি বিতর্কিত বিজ্ঞাপন তৈরি করে ফরাসি সংস্থাটি। যেখানে একটি অ্যাম্বাসাডরকে ভেঙেচুরে, তুবড়ে এমনকী বনেটে হাতি বসিয়ে আধুনিক মডেলের গাড়ি তৈরি করছে তারা। এ বার সত্যি তেমনটাই হবে কি? উত্তরের অপেক্ষায় গাড়িপ্রেমীরা।