নরেন্দ্র মোদীর মধ্যে সম্ভবত এই প্রথম মনমোহন সিংহের ছায়া দেখল শিল্পমহল!
১৯৯১ সালের সেই ডাকাবুকো অর্থমন্ত্রী মনমোহন। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে হ্যাঁচকা টানে তার জানলা খুলে দেওয়ার সাহস দেখিয়েছিলেন যিনি।
২০১৬ সালের জুনে পরিস্থিতি অনেকখানি আলাদা। অর্থনীতিও তখনকার তুলনায় অনেক মজবুত ভিতের উপর দাঁড়িয়ে। কিন্তু তা সত্ত্বেও শিল্পমহল মনে করছে, মোদীর এ দিনের ঝোড়ো সংস্কারের ইনিংসের হাত ধরেই নতুন উচ্চতায় উড়ান শুরু হতে পারে ভারতীয় অর্থনীতির। যার প্রথম ‘স্টপওভার’ সম্ভবত ৮% বৃদ্ধি।
অনেক শিল্পপতিই মনে করছেন, এই মুহূর্তে দেশের অর্থনীতির যা গতিপথ, তাতে এই আর্থিক বছরের শেষেই ৮% বৃদ্ধির কক্ষপথে পৌঁছে যাওয়া অসম্ভব নয়। কারণ হিসেবে তাঁদের যুক্তি, তার জন্য প্রয়োজনীয় শর্তগুলি পূরণ হচ্ছে একে একে। রেল-রাস্তা-বন্দরের মতো প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো গড়তে বিপুল লগ্নি করছে কেন্দ্র। সঙ্গে মিলেছে ভাল বর্ষার পূর্বাভাস। তার উপর এ ভাবে এক লপ্তে এতগুলি ক্ষেত্রে বিদেশি লগ্নি আসার রাস্তা প্রশস্ত হওয়া অর্থনীতির চাকায় গতি জোগাবে বলেই তাদের আশা।
এ বার কেন্দ্রের ঘোষণায় শিল্পমহল এত উৎসাহিত মূলত তিনটি বিষয় অনুমান করে—
(১) বিদেশি বিনিয়োগের দরজা প্রতিরক্ষা, ওষুধ তৈরি, বিমান পরিবহণ, এক ব্র্যান্ডের খুচরো ব্যবসার (সিঙ্গল ব্র্যান্ড রিটেল) মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে এ ভাবে হাট করে খুলে যাওয়ায়, এ বার গবেষণা ও উন্নয়নে মোটা অঙ্ক ঢালতে এগিয়ে আসবে অনেক বিদেশি সংস্থা। তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় যুঝে টিকে থাকতে একই পথে হাঁটতে বাধ্য হবে দেশের সংস্থাগুলিও। ফলে সার্বিক ভাবে উন্নত হবে গবেষণা ও উন্নয়নের পরিবেশ। মান বাড়বে এ দেশে তৈরি পণ্যের। হয়তো সেই সূত্রে বাজার বাড়বে রফতানিরও। যা আগামী দিনে বৃদ্ধিকে দীর্ঘ মেয়াদে ৮ শতাংশের উপর ধরে রাখায় সহায়ক হতে পারে।
(২) সাধারণত সরকার নীতি ঘোষণার পরে বিদেশি লগ্নি আসতে ঢের সময় লাগে। কিন্তু এ বার তা দ্রুত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কারণ যে-সমস্ত ক্ষেত্রে বিদেশি বিনিয়োগ আসার পথ সহজ করার ঘোষণা এ দিন করা হয়েছে, অনেকগুলিতেই তার উপস্থিতি রয়েছে আগে থেকে। সেই সূত্রে দেশি-বিদেশি সংস্থার মধ্যে তৈরি রয়েছে গাঁটছড়া। এ বার বিদেশি লগ্নির ঊর্ধ্বসীমা বাড়া কিংবা তার পথ সহজ হওয়ার সুযোগ নিয়ে এ দেশে আরও বেশি টাকা ঢালতে পারবে বিদেশি সংস্থাগুলি।
মেক ইন ইন্ডিয়ার ওয়েবসাইটে দেখা যাচ্ছে, এ দেশে ওষুধ তৈরিতে লগ্নি করেছে জনসন অ্যান্ড জনসন, গ্ল্যাক্সো স্মিথক্লাইন, ফাইজার, অ্যাস্ট্রা জেঙ্কার মতো সংস্থা। প্রতিরক্ষায় পা পড়েছে এয়ারবাস, লকহিড মার্টিন, বোয়িং, রাফায়েলের মতো বহুজাতিকের। বিমান তৈরি ও পরিষেবা ক্ষেত্রে এসেছে এয়ারবাস, বোয়িং, রোলস রয়েস, জিই অ্যাভিয়েশন, এয়ার এশিয়া, সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্স, রোলস রয়েস, ফ্রাঙ্কফুর্ট এয়ারপোর্ট সার্ভিসেস ইত্যাদি। এ দেশের লোভনীয় বাজারে পা রাখতে তৈরি কাতার এয়ারওয়েজ, এমিরেটসের মতো সংস্থা। ফলে সরকারের বিদেশি লগ্নির দরজা হাট করার সিদ্ধান্তে এ বার চটজলদি সুফল মেলার সম্ভাবনা।
(৩) অর্থনীতিকে পোক্ত ভিতের উপর দাঁড় করাতে ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ প্রকল্পকে সফল করার কথা নিয়ম করে বলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। দেশের বাজারের জন্য পণ্য তৈরির পাশাপাশি ভারতকে চান রফতানির ভরকেন্দ্র করে তুলতে। বিদেশ থেকে উন্নত প্রযুক্তি এবং তার হাত ধরে গবেষণা-উন্নয়নে জোর ছাড়া যা অসম্ভব। তাই এ দিনের ঘোষণাই প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্নের ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ প্রকল্পকে যথার্থ মানে দিল বলে অনেকের ধারণা। বড় শিল্প তো বটেই, আগামী দিনে যার সুফল কুড়োতে পারে ছোট-মাঝারি শিল্পও।
সিআইআইয়ের ডিরেক্টর জেনারেল চন্দ্রজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘এ দিনের ঘোষণায় স্পষ্ট যে, সংস্কারের বিষয়ে সরকার দায়বদ্ধ। একবগ্গা এ দেশে ব্যবসা করার পথ সহজ করতেও। এতে বড় মাপের বিদেশি বিনিয়োগ আসবে। তৈরি হবে কাজের সুযোগও।’’ অর্থনীতি যে-পথে হাঁটছে, তাতে খুব তাড়াতাড়ি ফের ৮% বৃদ্ধির মাইলফলক ছোঁয়া অসম্ভব হবে না বলে তাঁর ধারণা।
ফিকি-র সেক্রেটারি জেনারেল এ দিদার সিংহের মতে, ‘‘মোদী-সরকার যে সংস্কারকে ধারাবাহিক প্রক্রিয়া মনে করে, এ দিনের পদক্ষেপে তা ফের প্রমাণিত।’’ অ্যাসোচ্যামের সেক্রেটারি জেনারেল ডি এস রাওয়াত বলেন, ‘‘এই সিদ্ধান্ত বড় অঙ্কের লগ্নি ও উন্নত প্রযুক্তি আনবে প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে।’’ তাঁর মতে, তাতে লাভবান হবে দেশি সংস্থাগুলি। ওই একই বণিকসভার প্রেসিডেন্ট সুনীল কানোরিয়ার দাবি, ‘‘সরকারের এই পদক্ষেপে লাভ হবে অর্থনীতির। এখানে কারখানা গড়তে আগ্রহ বাড়বে বিদেশি সংস্থাগুলির।’’
তবে এই সমস্ত কিছুর মধ্যে আশঙ্কার মেঘও যে একেবারে নেই, এমন নয়। যেমন অনেকে দেখতে চান, কত দ্রুত রূপায়িত হয় এই সমস্ত সিদ্ধান্ত। লাল ফিতের ফাঁস সত্যিই আলগা হয় কি না। চিন্তার মেঘ রয়েছে কিছু ক্ষেত্রের সংস্থার কপালেও। যেমন, ১০০% প্রত্যক্ষ বিদেশি লগ্নির সিদ্ধান্তে খুশি নয় ডিটিএইচ পরিষেবা সংস্থা টাটা স্কাই। সিইও হরিৎ নাগপালের দাবি, ‘ক্রস হোল্ডিং’-এর ঊর্ধ্বসীমা না-তুললে, শুধুমাত্র এই নির্দেশে আখেরে কোনও লাভ হবে না তাঁদের।