বাগান খুলেছে। কিন্তু সংশয় কাটেনি। টোল খেয়েছে আস্থাও। তাই ফি বছর যে দার্জিলিং চায়ের বরাত কার্যত বাগানের কথার ভরসাতেই দেওয়ার রেওয়াজ, এ বার ছেদ পড়েছে তাতে। আগাম চুক্তির আগে সরেজমিনে পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে বিদেশ থেকে এসে বাগানে পা রাখছেন আমদানিকারীরা। সংশ্লিষ্ট সূত্রের খবর, কেউ আসছেন একাধিক বার। কেউ গত কয়েক বছরের মধ্যে এই প্রথম। কেউ আবার একেবারে প্রথম বারই।
বিস্তর জলঘোলার পরে চালু হলেও এ বার দার্জিলিং চায়ের উৎপাদন ও গুণমান নিয়ে সংশয়ে বিদেশি ক্রেতারা। তাই এখনও তাঁদের বেশিরভাগই বাগান বা ভারতীয় রফতানি সংস্থাগুলির সঙ্গে চা কেনার আগাম চুক্তি করেননি। বরং হাঁটছেন না দেখলে বিশ্বাস নেই নীতিতে।
গত জুনে পাহাড়ে অশান্তি বাধার পর থেকে আর চা-ই হয়নি বাগানগুলিতে। উপরন্তু গাছের উচ্চতা অস্বাভাবিক রকম বেড়েছে। আগাছায় ভরে গিয়েছে বাগান। সে সব সাফ করে বাগান এখনও পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি। এই কারণেই সাধারণত মার্চের শেষে ‘ফার্স্ট ফ্লাশ’ চায়ের উৎপাদন শুরু হলেও এ বার তা ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
গন্তব্য
দেশ রফতানি*
• জার্মানি ৩০-৩৫
• জাপান ১০
• ব্রিটেন ৭-৮
• আমেরিকা ৫
* লক্ষ কেজিতে
** এ ছাড়া আরও কিছু দেশে কম পরিমাণে রফতানি হয় দার্জিলিং চা
দার্জিলিঙের ফার্স্ট ও সেকেন্ড ফ্লাশ চায়ের বেশিরভাগটাই রফতানি হয় ইউরোপ, আমেরিকা, এশিয়ার বিভিন্ন দেশে। মূল ক্রেতা জার্মানি, জাপান, ব্রিটেন, আমেরিকা। জার্মানি থেকে আবার সেই চায়ের কিছুটা অন্যান্য দেশে রফতানি হয়। সাধারণত মরসুম শুরুর অনেক আগে, ডিসেম্বর-জানুয়ারি নাগাদ বিদেশি ক্রেতাদের সঙ্গে বাগান অথবা কিছু রফতানি ব্যবসায়ীর আগাম চুক্তির চল আছে। এঁদের মধ্যে আগে কেউ কেউ বাগানে ঘুরে গেলেও, অন্যরা কিন্তু ভরসা রাখতেন বাগান বা রফতানি সংস্থার উপরেই। কিন্তু দার্জিলিং টি অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি জেনারেল কৌশিক বসু জানান, এ বার সেই সব আগাম চুক্তির কিছুই প্রায় হয়নি। নতুন ক্রেতা আসা তো দূর অস্ত্, অনেকেই নিজে বাগান পরিদর্শনে আসছেন। অর্থাৎ ইঙ্গিত, টোল খেয়েছে আস্থা। পরিস্থিতি কতটা ঠিক হয়েছে, উৎপাদন ঠিকঠাক হবে কি না, গুণমান ঠিক থাকার মতো পরিস্থিতি বাগানে রয়েছে কি না, এ সব না দেখে আগাম চুক্তি করতে চাইছেন না আমদানিকারীরা।
চা শিল্প সূত্রেরও খবর, দার্জিলিঙে এ বার কতটা চা তৈরি হবে ও তার মান কেমন হবে, তা নিয়ে সংশয়ে দানা বেঁধে আছে তাঁদের মধ্যে। তাই এক বার অন্তত চোখে দেখে সিদ্ধান্ত নিতে চাইছেন অনেকে। যে কারণে এ বার বাগান পরিদর্শনে আসা বিদেশি ক্রেতাদের সংখ্যা বাড়ছে। কয়েক মাস আগে কয়েকজন ঘুরেও গিয়েছেন। এ মাসের শেষ থেকে ফের আসবেন বলে বাগানগুলিকে বার্তা দিয়েছেন অনেকে। গত কয়েক বছরে বাগানে কখনও আসেননি, এমন ক্রেতাও রয়েছেন এই তালিকায়।
এঁদের পরিচয় প্রকাশে চা শিল্প নারাজ হলেও, অধিকাংশই জার্মানির ক্রেতা বলে খবর। গত বছর দার্জিলিঙের চা না পাওয়ায় সেই সব বিদেশি ক্রেতার ব্যবসাও মার খেয়েছে। এ বারও যদি কম চা মেলে বা চায়ের দাম বাড়ে, তা হলে তাঁদের ব্যবসায়িক কৌশল কী হবে, তা স্থির করতে নিজেদের চোখে বাগানের হাল হকিকৎ বোঝাই এই বাগান পরিদর্শনের মূল উদ্দেশ্য।
দার্জিলিং টি অ্যাসোসিয়েশনের দাবি, মরসুম শুরুর আগে যে সব গাছ ছাঁটা হত, সেগুলি থেকে আসত সেকেন্ড ফ্লাশ চা। আর ফার্স্ট ফ্লাশ চা হত অন্য গাছগুলি থেকে। এ বার যে হেতু সব গাছই প্রায় ছাঁটতে হবে, তাই বাগানে চা উৎপাদন কয়েক সপ্তাহ পিছোতে পারে। এ মাসের শেষে ছাঁটাইয়ের কাজ শুরু হওয়ার কথা।
বাগানের স্বাভাবিক কাজকর্ম হওয়া নিয়েও চিন্তিত শিল্পমহল। তাদের দাবি, গত বছর প্রায় পুরো ব্যবসাই মার খাওয়ায় এমনিতেই আর্থিক সঙ্কটের জন্য কর্মী, শ্রমিকদের বেতন দিতে দেরি হচ্ছে। এখনও আগের বছরের বোনাসের অর্ধেক দেওয়া বাকি। উপরন্তু বাগান সাফ করতে বাড়তি খরচ বইতে হচ্ছে। এই অবস্থায় কেন্দ্র কিছু আর্থিক সাহায্যের আশ্বাস দিলেও, এখনও তা মেলেনি।