ভাড়া বাড়ি ছেড়ে নিজের ফ্ল্যাটে উঠে এসেছেন সমীর। কিন্তু এখনও অনেক জায়গায় দেওয়া রয়েছে আগের বাড়ির ঠিকানা। একে একে সে সব পাল্টাতে হবে। আর তা করতে গিয়েই জানতে পারলেন বদলে গিয়েছে কেওয়াইসির বেশ কিছু নিয়ম। ফলে শুরু হল দৌড়। কোথায়, কী ভাবে তা জমা দেওয়া যায়, চলল তার খোঁজ। চলুন তাঁর সঙ্গে আমরাও জেনে নিই সেই খুঁটিনাটি।
কেওয়াইসি কী
পুরো কথা নো ইয়োর কাস্টমার (কেওয়াইসি)। ব্যাঙ্ক ও ডাকঘরে অ্যাকাউন্ট খুলতে বা লেনদেন করতে, বিমা চালু বা ফান্ডের লগ্নির আগে গ্রাহকের পরিচয় প্রমাণ করতে যে নথি লাগে, তাকেই বলে কেওয়াইসি।
কেন এই ব্যবস্থা
কালো টাকা লেনদেন ও সন্ত্রাসবাদী কাজে ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার অপব্যবহার রুখতে কেওয়াইসি পদ্ধতি চালু হয়েছে। এর মাধ্যমে গ্রাহকের পরিচয়, ঠিকানা জেনে নেয় আর্থিক প্রতিষ্ঠান। তা যাচাইয়ের পরে অ্যাকাউন্ট খোলা বা লেনদেনের অনুমতি দেওয়া হয়।
দুই ভাগ
কেওয়াইসি-র মূলত দু’টি ভাগ—
• পরিচয়ের প্রমাণ। অর্থাৎ, গ্রাহক যে নামে অ্যাকাউন্ট খুলছেন বা লেনদেন করছেন, তিনিই সেই ব্যক্তি কি না, তা নিশ্চিত করা হয়।
• বাসস্থানের প্রমাণ। যেখানে নিজের বাড়ি বলে জানাচ্ছেন, সেখানে আদৌ তিনি থাকেন কি না, সেটা দেখা হয়।
কোন কোন নথি
পরিচয় এবং ঠিকানার জন্য আলাদা নথি জমা দিতে হয়। সেগুলি হল—
পরিচয়ের জন্য জরুরি
• পাসপোর্ট।
• প্যান কার্ড।
• ভোটার কার্ড।
• ড্রাইভিং লাইসেন্স।
• আধার কার্ড।
• এনআরইজিএ কার্ড, অন্য কোনও পরিচয়পত্র (ব্যাঙ্ক রাজি থাকলে)।
• গ্রাহকের পরিচয় ও বাসস্থান সম্পর্কে সরকারি কর্মীর লিখিত বয়ান।
বাসস্থানের জন্য দরকার
• টেলিফোন বিল।
• অন্য কোনও ব্যাঙ্কে লেনদেনের প্রমাণপত্র।
• বিদ্যুতের বিল।
• রেশন কার্ড।
• সংস্থার চিঠি (ব্যাঙ্ক রাজি হলে)।
এ ছাড়াও ব্যাঙ্ক অন্য নথি নিতে রাজি থাকলে, তা জমা দেওয়া যায়।
ড্রাইভিং লাইসেন্স বা ভোটার কার্ডের মতো নথিতে ঠিকানা থাকে। কিন্তু বহু সময়ে দেখা যায় গ্রাহক সেখানে থাকেন না। তাই ওই নথি ঠিকানার প্রমাণ হিসেবে জমা দিলেও বহু ক্ষেত্রে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বর্তমান ঠিকানায় গ্রাহকের নামে থাকা বিদ্যুৎ বা টেলিফোন বিল জমা দিতে বলে।
কার্ডেও কেওয়াইসি
ডেবিট বা ক্রেডিট, স্মার্ট কার্ড ইত্যাদি পেতে কেওয়াইসি লাগে। সাধারণত এখন ব্যাঙ্কে সেভিংস অ্যাকাউন্টের সঙ্গেই ডেবিট বা এটিএম কার্ড দেওয়া হয়। তবে সাবধান থাকার জন্য ব্যাঙ্কের সঙ্গে কথা বলে নিলে ভাল।
কী ভাবে জমা
• ব্যাঙ্কে গিয়েই যে নথি জমা দিতে হবে, তা নয়। চাইলে ই-মেল বা ডাকেও নথি পাঠাতে পারেন।
• তবে সংশ্লিষ্ট সংস্থা বা ব্যাঙ্ক যদি মনে করে নথি জমার জন্য শাখায় গ্রাহকের উপস্থিতি জরুরি, তা হলে তাঁকে সেখানে গিয়েই তা জমা দিতে হবে।
• গ্রাহকের সুবিধার জন্য এখন বাড়িতে বসেও কেওয়াইসি নথি জমার সুবিধা চালু হয়েছে। এতে ভিডিয়োর মাধ্যমে তা জমা দেওয়া যায়।
• কাগজ ছাড়া আধার, প্যানের তথ্যের উপরে ভিত্তি করে ই-কেওয়াইসি জমার পদ্ধতিও চালু রয়েছে।
কখন দেখা হয়
সাধারণত তিনটি পর্যায়ে যাচাই হয়—
• কোনও অ্যাকাউন্ট খোলার সময়।
• লেনদেন করার সময়।
• গ্রাহকের পেশ করা তথ্য সম্পর্কে ব্যাঙ্কের সন্দেহ হলে।
দ্বিতীয়বারেও জমা?
হ্যাঁ। এক বার জমা দিলেও ফের তা চাওয়া হতে পারে। বিশেষত ব্যাঙ্কে। সাধারণত ঝুঁকির ভিত্তিতে গ্রাহকদের তিন ভাগে ভাগ করে ব্যাঙ্কগুলি—
• কম ঝুঁকি। এ ক্ষেত্রে সাধারণ ভাবে ১০ বছর অন্তর নথি জমা দিতে হয়।
• মাঝারি ঝুঁকি। এই সব গ্রাহকদের ৮ বছর অন্তর তা জমা দিতে বলা হয়।
• বেশি ঝুঁকি। ২ বছর অন্তর নতুন করে কেওয়াইসি চাইতে পারে ব্যাঙ্ক।
তবে প্রয়োজনে সময়সীমার আগেই ফের নথি চাওয়া হতে পারে।
ঝুঁকি মাপার মাপকাঠি
একাধিক মাপকাঠির ভিত্তিতে গ্রাহকের
ঝুঁকি মাপা হয়। যার মধ্যে থাকে—
• গ্রাহকের পরিচয়।
• তাঁর সামাজিক ও আর্থিক অবস্থান।
• তিনি কী ধরণের কাজ করেন।
• তিনি কোথায় বসবাস করেন।
তথ্য না-দিলে
• পুরো কেওয়াইসি তথ্য জমা না-দিলে অ্যাকাউন্ট খোলা যায় না।
• যদি প্রথমে কেওয়াইসি তথ্য জমা দেওয়া না-হয়, তা হলে পরে অবশ্যই তা দিতে হয়। তা-ও করা না-হলে সংশ্লিষ্ট অ্যাকাউন্ট বা তাতে লেনদেন বন্ধ করা হতে পারে। এ জন্য গ্রাহককে প্রথমে অ্যাকাউন্ট বন্ধের কারণ দর্শিয়ে নোটিস দিতে বাধ্য থাকবে ব্যাঙ্ক।
• তাই প্রথমে জমা না-দিলে পরে তা দিয়ে দেওয়া ভাল। কত দিন সে জন্য সময় পাবেন, তা জেনে নিন।
এনবিএফসির ক্ষেত্রে
ব্যাঙ্ক নয় এমন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে (এনবিএফসি) অ্যাকাউন্ট খুলতেও কেওয়াইসি লাগে। তবে কেউ তা দিতে না-পারলে শর্তসাপেক্ষে সরল নিয়ম চালু রয়েছে। যেমন—
• নথি হিসেবে গ্রাহককে নিজের সই (অ্যাটেস্ট) করা ফটো জমা দিতে হবে।
• সংস্থার দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসারকে সার্টিফিকেট দিতে হবে। সেখানে লেখা থাকবে যে, গ্রাহক তাঁর সামনেই সই করেছেন বা আঙুলের ছাপ দিয়েছেন।
• এই অ্যাকাউন্ট প্রাথমিক ভাবে চালু থাকবে ১২ মাস। ওই সময়ের মধ্যে সাধারণ কেওয়াইসির পুরো নিয়ম পূরণ করতে হবে গ্রাহককে।
লেনদেনের শর্ত
এই অ্যাকাউন্টে লেনদেনের ক্ষেত্রেও কিছু শর্ত থাকে। সেগুলি হল—
• গ্রাহকের সব অ্যাকাউন্ট মিলে জমা অঙ্ক কোনও সময়েই ৫০,০০০ টাকার বেশি হতে পারবে না।
• সারা বছরে ওই অ্যাকাউন্টে মোট জমা ১ লক্ষ টাকার মধ্যে থাকতে হবে।
• কোনও সময়ে তা ৪০,০০০ টাকা হলেই বা সারা বছরে ৮০,০০০ টাকা হলেই গ্রাহককে তা জানাবে সংস্থা। বলতে হবে, কেওয়াইসির পুরো প্রক্রিয়া পূরণ করা না-হলে জমার অঙ্ক ঊর্ধ্বসীমা ছুঁলেই লেনদেন বন্ধ হবে।
• শুধু এনবিএফসি-ই নয়, জনধনের মতো কিছু অ্যাকাউন্ট খোলার সময়েও ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষও অনেক সময়েই এই ধরনের নিয়ম মেনে চলেন।
নথি যখন নেই
পরিযায়ী শ্রমিক-সহ বহু ক্ষেত্রেই ঠিকানা ও পরিচয়ের প্রমাণ না-থাকায় ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট খুলতে সমস্যা হত। তা সমাধানের জন্য বেসিক সেভিংস অ্যাকাউন্ট চালু হয়েছে। এ ক্ষেত্রে—
• ১৮ বছর বয়সের যে সব ব্যক্তির পরিচয় বা ঠিকানার নথি নেই, তাঁরা ‘বেসিক সেভিংস ব্যাঙ্ক ডিপোজিট স্মল অ্যাকাউন্টস’ খুলতে পারবেন।
• শিথিল কেওয়াইসি বিধি (লিবারালাইজ়্ড কেওয়াইসি) মেনেই অ্যাকাউন্ট খুলতে সায় দেওয়া হবে।
• এ ক্ষেত্রে ব্যাঙ্কে দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসারের সামনে নিজের ফটোতে সই করতে হবে। তিনি সেটি অ্যাটেস্ট করলে অ্যাকাউন্ট খোলা যাবে।
• অ্যাকাউন্ট খোলার ২৪ মাসের মধ্যে পূর্ণ কেওয়াইসি নথি জমা দিতে হবে। না-হলে অ্যাকাউন্ট বন্ধ হবে।
• অ্যাকাউন্টে কোনও সময়ে ৫০,০০০ টাকার বেশি থাকতে পারবে না ও বছরে মোট জমার অঙ্ক হতে হবে ১ লক্ষ টাকার মধ্যে।
• এ ছাড়াও লেনদেনের ক্ষেত্রে রয়েছে আরও কিছু সীমাবদ্ধতা।
ভিডিয়ো মারফত
এই পদ্ধতিতে বাড়িতে বসে অ্যাকাউন্ট খোলা যায়। সাধারণত এ জন্য—
• অ্যাকাউন্ট খোলার আবেদন জানানোর সময়ে নানা তথ্য (নাম, ঠিকানা, পরিচয় ইত্যাদি) দিতে হয়।
• ব্যাঙ্ক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান ভিডিয়ো কলের জন্য সময় চেয়ে নেয়।
• গ্রাহকের মোবাইলে লিঙ্ক আসে। তার মাধ্যমে ভিডিয়ো কল করে তাঁর ও আধার, প্যানের ছবি নেয় ব্যাঙ্ক।
• গ্রাহকের ছবি নেওয়ার সময় যাতে বোঝা যায় তিনি ভারতেই রয়েছেন, সেটা নিশ্চিত করা হয়।
নেটে হেঁটে
কাগজ ছাড়াই যাতে কেওয়াইসির নিয়ম পালন করা যায়, তা নিশ্চিত করে এই ব্যবস্থা। এতে—
• বায়োমেট্রিক মেশিন ব্যবহার করে গ্রাহকের আঙুলের ছাপ নেওয়া হয় ও তা আধার তথ্যের সঙ্গে মেলানো হয়।
• ব্যাঙ্ক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শাখায় গিয়ে এই কেওয়াইসি করানো যায়।
• চাইলে বাড়িতে গিয়ে এই পদ্ধতিতে কেওয়াইসি যাচাই করতে পারে ব্যাঙ্ক।
• এখন দেশে নতুন মোবাইল সংযোগ নিতেও এই পদ্ধতি মেনে চলা হয়।