চিন্তার ভাঁজ মানুষের কপালে। —ফাইল চিত্র।
টানা আট দিন ধরে ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার পর বুধবার স্থিতিশীল হল পেট্রল-ডিজেলের দাম। তবে কত দিন এই স্থিতাবস্থা থাকবে তা নিয়ে সংশয়ে রয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। একই সঙ্গে ক্রেডিট কার্ডে তেলের দাম মেটালে ০.৭৫ শতাংশ ক্যাশব্যাকের সিদ্ধান্ত সরকার প্রায় আড়াই বছর পর প্রত্যাহার করায়, বাড়তি বোঝা চাপবে ক্রেতাদের।
১৭ সেপ্টেম্বর থেকে টানা বেড়ে চলেছে তেলের দাম। ইন্ডিয়ান অয়েল কর্পোরেশনের এক মুখপত্র জানান, এ মাসে জ্বালানি তেলের দাম সর্বনিম্ন ছিল গত ৯ তারিখ। কলকাতায় ওই দিন পেট্রলের দাম ছিল ৭৪ টাকা ৪২ পয়সা। ২৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সেই দাম বেড়ে হয়েছে ৭৬ টাকা ৭৯ পয়সা। একই ভাবে বেড়েছে ডিজেলের দামও। ৬৭ টাকা ৪৮ পয়সা থেকে ২৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কলকাতায় দাম বেড়ে হয়েছে ৬৯ টাকা ৪৬ পয়সা।
তবে মঙ্গলবারের পর বুধবার আর নতুন করে দাম বাড়েনি। গতকালের দামেই শুরু হয়েছে এ দিন। আন্তর্জাতিক বাজারে অশোধিত তেলের দামের নিরিখে দেশে তেলের দাম নির্ধারণের সিদ্ধান্তের পর থেকেই প্রতি দিন আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দামের সঙ্গে তাল রেখে পরিবর্তিত হয় পেট্রল-ডিজেলের খুচরো মূল্য।
আরও পড়ুন: তৃণমূলে কঠোর, উল্টো পক্ষে নরম কেন? পুলিশকে কড়া ধমক মুখ্যমন্ত্রীর, সমালোচনায় বিরোধীরা
আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তেল উৎপাদন এবং বাজারের উপর নজর রাখা বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, এ বছরের শেষ তিন মাস এবং পরের বছরের প্রথম তিন মাস তেলের দাম আরও ঊর্ধ্বমুখী হবে। যার জের টের পাওয়া যাবে আমাদের অভ্যন্তরীণ বাজারেও।
গত ১৪ সেপ্টেম্বর সৌদি আরবের সরকারি অশোধিত তেল সংস্থা আরামকো-র খনিতে নাশকতার ঘটনা ঘটার পরেই লাফিয়ে বাড়তে থাকে তেলের দাম। ব্যারেল প্রতি তেলের দাম ৬০ মার্কিন ডলার থেকে বেড়ে হয়ে যায় ৬৯ মার্কিন ডলার। তার প্রভাব পড়ে ভারতের বাজারেও। সৌদি সরকার যদিও সেই নাশকতার প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে উঠেছে এবং বুধবার আরামকো-র মুখ্য এগ্জিকিউটিভ অফিসার আমিন নাসের সংবাদ সংস্থা রয়টার্সকে জানিয়েছেন, এ মাসের মধ্যেই তাঁদের তেলের জোগান আগের অবস্থায় ফিরে আসবে। ইতিমধ্যেই নাশকতার জন্য তেল উৎপাদনের ঘাটতি মিটিয়ে প্রতি দিন ১ কোটি ১৩ লাখ ব্যারেল তেল উৎপাদন করা শুরু হয়েছে। ফলে ব্যারেল প্রতি অশোধিত তেলের দাম ৬৯ থেকে কমে ৬২ মার্কিন ডলারের আশেপাশে হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের দাবি, এর ফলে ভারতের বাজারে তেলের দাম স্থিতিশীল হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু, আন্তর্জাতিক তেল বাজার সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ কিমবারলি অ্যামাডিও, দ্য ব্যালান্স পত্রিকায় জানিয়েছেন, পশ্চিম এশিয়ার তেল উৎপাদক দেশগুলির যৌথ মঞ্চ ওপেকের সর্বসম্মত ভাবে তেল উৎপাদন কমানোর সিদ্ধান্ত ফের তেলের দামকে ঊর্ধ্বমুখী করে তুলতে পারে। কারণ, এ বছরের জুলাই মাসে ওপেক সদস্যরা প্রতি দিনের উৎপাদন ১২ লাখ ব্যারেল কমিয়ে তেলের দাম ৭০ ডলার করতে লক্ষ্যমাত্রা স্থির করেছে। ফলে উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ বজায় থাকবে পরের বছরের প্রথম তিন মাসেও।
আরও পড়ুন: পাইকারি ৪৫, খুচরো ৭০ টাকা! পেঁয়াজের ‘ঝাঁঝে’ চোখে জল গৃহস্থের
অন্য দিকে, ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক চেতন ঘাটে একটি ইংরেজি দৈনিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মার্কিন ডলারের নিরিখে টাকার দাম কমার প্রবণতা দেখে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। কারণ ডলারের সঙ্গে সম্প্রতি টাকার দাম কমতে কমতে প্রায় ৭২ টাকায় পৌঁছয়। বুধবার ডলারের নিরিখে টাকার দাম ৭১ টাকা ৩ পয়সা। ঘাটের আশঙ্কাকে উড়িয়ে দিয়ে ভারতীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামনের কর্পোরেট করে ছাড় পরবর্তী সময়ে ‘তেজি’ বাজারকে দেখিয়ে অনেকে দাবি করেছেন যে, বাজারে ফের অর্থের জোগান বাড়ছে যা, মুদ্রাস্ফীতি রোধ করবে এবং টাকার অবমূল্যায়ণ ঠেকিয়ে স্থিতিশীল করবে। কিন্তু সেই সঙ্গে তথ্য বলছে, কর্পোরেট করে ছাড়ের ফলে সরকারের ১ লাখ ৪৫ হাজার কোটি রাজস্ব ঘাটতি হবে, যার প্রভাব পড়বে জিডিপি-তেও।
রাজস্ব ক্ষতি কমাতে অন্য ক্ষেত্র থেকে সরকার দায় কমাবে বলে অর্থনীতিবিদদের একাংশের মত। নোটবন্দির সময়ে নগদবিহীন কেনাকাটায় উৎসাহ জোগাতে তেলের দাম ক্রেডিট কার্ড, ডেবিট কার্ড বা ই-ওয়ালেট থেকে মেটালে ০.৭৫ শতাংশ ক্যাশব্যাকের ঘোষণা করেছিল। বুধবার সমস্ত সরকার নিয়ন্ত্রিত তেল সরবরাহ সংস্থাকে ক্রেডিট কার্ডে ওই ক্যাশব্যাকের সুযোগ আগামী ১ অক্টোবর থেকে প্রত্যাহার করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আপাতত ডেবিট কার্ড এবং ই-ওয়ালেটে সেই সুযোগ বজায় থাকলেও, ভবিষ্যতে সেই সুবিধাও বন্ধ করা হতে পারে বলে মনে করছে তেল সরবরাহ সংস্থাগুলি।
ফলে শুধু আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম নয়, সঙ্গে টাকার দাম এবং রাজস্ব ঘাটতির ত্রহ্যস্পর্শে আগামী দিনে কতটা মহার্ঘ হবে পেট্রল-ডিজেল তা নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে।