স্বপনবাবু সবে মাত্র অবসর নিয়েছেন। পিএফ, গ্র্যাচুইটি মিলিয়ে হাতে টাকা মন্দ আসেনি। তবে সেই টাকা আলাদা করে লগ্নি করে মাসে মাসে আয়ের ব্যবস্থা করবেন, নাকি অন্য কোনও পেনশন প্রকল্পে রাখবেন, তা ভেবে কুল পাচ্ছেন না। তখনই এক বন্ধু খবর দিলেন অ্যানুইটির। যেখানে একলপ্তে টাকা রেখে প্রতি মাসে পেনশনের ব্যবস্থা করা যায়। তাঁর
বন্ধু স্বপনবাবুকে সেই প্রকল্পের খুঁটিনাটি নিয়েও নানান কথা বুঝিয়েছিলেন। চলুন আজ আমরাও সেই অ্যানুইটি সম্পর্কে জেনে নিই।
অ্যানুইটি কী
• সরকার বা সরকার অনুমোদিত পেনশন প্রকল্প ছাড়াও বাজারে চালু আছে বহু পেনশন প্রকল্প। যেগুলি অ্যানুইটি হিসেবে পরিচিত।
• অ্যানুইটি প্রকল্পে একলপ্তে টাকা ঢেলে সেখান থেকে মাসে মাসে পেনশনের ব্যবস্থা করতে হয়।
• অ্যানুইটি প্রকল্পে পেনশনের অঙ্ক নির্ভর করে মূলত তিনটি বিষয়ের উপরে— গ্রাহকের বয়স, প্রকল্পে লগ্নি করা টাকা ও প্রকল্পের ধরন।
• মনে রাখতে হবে, বাজারে চালু থাকা অ্যানুইটি প্রকল্পগুলির মূল বৈশিষ্ট্য এক থাকলেও, সব প্রকল্প কিন্তু এক ধাঁচে তৈরি নয়। আবার সব প্রকল্পে পেনশন পাওয়ার শর্তও এক থাকে না। সংস্থা ও প্রকল্প বিশেষে শর্তের তারতম্য হয়। তাই প্রকল্প কেনার সময় শর্তগুলি ভাল করে পড়ে নেওয়া জরুরি।
কখন কেনা যায়
• যেহেতু অ্যানুইটি প্রকল্পগুলির মূল লক্ষ্য নিয়মিত সময় অন্তর হাতে টাকা আসার ব্যবস্থা করা, তাই সাধারণ ভাবে অবসরের পরে ৬০-৮৫ বছর বয়সের মধ্যে কেনা যায়, এমন অ্যানুইটি প্রকল্পই বেশি দেখা যায় বাজারে।
• তবে তার থেকে কম বয়সে কেনা যায়, এমন প্রকল্পও রয়েছে। বিশেষ করে যে সব প্রকল্পে দীর্ঘ দিন ধরে নিয়মিত টাকা জমিয়ে তার পরে অ্যানুইটি প্রকল্প কিনতে হয় (যেমন ন্যাশনাল পেনশন সিস্টেম বা এনপিএস), তাতে অবশ্য আরও কম বয়সেও তা কিনতে পারেন গ্রাহক।
• বরিষ্ঠ বিমা প্রকল্প কিনতে হলে বয়স ৬০ বছর থেকে ৮০ বছরের মধ্যে হওয়া চাই।
কোথা থেকে কেনা যায়
• সাধারণত বিভিন্ন বিমা সংস্থা অ্যানুইটি প্রকল্প বিক্রি করে।
• তবে বিমা সংস্থা ছাড়াও কিছু মিউচুয়াল ফান্ড বা অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট সংস্থা, বিশেষ করে যারা এনপিএস তহবিল পরিচালনা করে, তারাও ওই প্রকল্প বিক্রি করে থাকে।
• এ জন্য বিমা বা সংশ্লিষ্ট সংস্থার কাছে গিয়ে সমস্ত আবেদনপত্র পূরণ করে জমা দিতে হয়। লাগে নো ইয়োর কাস্টমার (কেওয়াইসি) নথিও।
প্রকল্প কত ধরনের
বাজারে প্রধানত দুই ধরনের অ্যানুইটি প্রকল্প রয়েছে—
• ইমিডিয়েট অ্যানুইটি।
• ডেফার্ড অ্যানুইটি।
• এ ছাড়াও রয়েছে ভ্যারিয়েব্ল অ্যানুইটি।
• তবে এই তালিকার বাইরেও আরও কিছু ধরনের অ্যানুইটি প্রকল্প বাজারে ছেড়েছে বিভিন্ন সংস্থা। প্রতিযোগিতার বাজারে গ্রাহককে টানতে তথাকথিত সাবেকি প্রকল্প ছাড়াও, নতুন নতুন শর্ত যোগ করে ছাড়া হয়েছে ওই সব প্রকল্প। সাধারণত টাকা জমা দেওয়ার সময়, পেনশন মেলার দিন, তার অঙ্ক, অতিরিক্ত কিছু সুবিধা ইত্যাদির ভিত্তিতে সেগুলি আলাদা হয়।
ইমিডিয়েট অ্যানুইটি
যে প্রকল্পে টাকা জমা দেওয়ার পরের মাস থেকেই পেনশন পাওয়া শুরু হয়, তাকে বলে ইমিডিয়েট অ্যানুইটি।
• এই ক্ষেত্রে প্রকল্প চালুর সময়েই একলপ্তে টাকা জমা দিতে হয়।
• সাধারণত প্রকল্প কেনার সময়েই বলে দেওয়া হয় যে, কত টাকা করে পেনশন পাওয়া যাবে।
ডেফার্ড অ্যানুইটি
যে অ্যানুইটি প্রকল্পে টাকা জমা দেওয়া শেষ করে একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর থেকে পেনশন পাওয়া শুরু হয়, তাকে বলে ডেফার্ড অ্যানুইটি।
• ইমিডিয়েট অ্যানুইটির মতো এ ক্ষেত্রেও প্রকল্প চালুর সময়ে একলপ্তে টাকা জমা দিতে হয়।
• ডেফার্ড অ্যানুইটিতে পেনশন পাওয়া দেরিতে শুরু হলেও, প্রকল্প কেনার সময়েই কত টাকা পেনশন পাওয়া যাবে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা গ্রাহককে আগাম বলে দেওয়া হয়।
অন্যান্য
এ ছাড়া আরও কিছু পেনশন প্রকল্প রয়েছে বাজারে।
• এই প্রকল্পগুলিতে নির্দিষ্ট সময় ধরে টাকা জমিয়ে তহবিল গড়ার পরে তা দিয়ে অ্যানুইটি প্রকল্প কিনে ব্যবস্থা করতে হয় পেনশনের।
• এই ক্ষেত্রে কিন্তু তহবিল গড়া শুরু করার সময়ে পেনশনের অঙ্ক জানা
যায় না। বরং শেষে গিয়ে অ্যানুইটি প্রকল্প কেনার সময়েই গ্রাহক জানতে পারেন কত টাকা করে পেনশন পাবেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পেনশনের অঙ্ক নির্ভর করে কত টাকা জমা হচ্ছে তার উপরে।
ফিক্সড অ্যানুইটি
• যে সব অ্যানুইটি প্রকল্পে পেনশনের অঙ্ক কী হবে, তা আগে থেকেই নির্দিষ্ট করা থাকে, তাকে ফিক্সড অ্যানুইটি প্রকল্পও বলা হয়।
• এই ধরনের প্রকল্পই বাজারে বেশি চালু। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই অ্যানুইটি প্রকল্পে সাধারণত পেনশনের পরিমাণ কম হয়। কারণ, ওই সব প্রকল্পের সিংহভাগ টাকাই বিমা সংস্থাগুলি ঋণপত্রে লগ্নি করে। যেখানে ওই লগ্নি থেকে আয়ের অঙ্কও আগে থেকে নির্দিষ্ট করা থাকে।
ভেরিয়েব্ল অ্যানুইটি
• এই অ্যানুইটিতে পেনশনের পরিমাণ নির্দিষ্ট থাকে না।
• এই সব প্রকল্পের সিংহভাগ টাকা বিমা সংস্থা লগ্নি করে শেয়ার বাজারে। ওই লগ্নি থেকে যেমন আয় ও মুনাফা হয়, তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে ঠিক হয় পেনশনের অঙ্ক। তাই পেনশনের পরিমাণ বেশিও হতে পারে, আবার কমও হতে পারে।
এ ছাড়াও
• বাজারে এমন প্রকল্পও রয়েছে, যেখানে প্রতি বছর নির্দিষ্ট হারে পেনশনের অঙ্ক বাড়ে।
• এ ছাড়াও রয়েছে এমন অ্যানুইটি, যেগুলিতে প্রকল্প কেনার পরেও পেনশনের অঙ্ক বাড়ানোর জন্য অতিরিক্ত লগ্নি (টপ আপ) করা যায়।
পেনশন কত দিন অন্তর
ইমিডিয়েট এবং ডেফার্ড, উভয় ক্ষেত্রেই পেনশন কী ভাবে পাবেন সে ব্যাপারে একাধিক বিকল্পযুক্ত প্রকল্প চালু আছে। তবে সাধারণ ভাবে—
• অ্যানুইটি প্রকল্পে পেনশন পাওয়া যায় প্রতি মাসে।
• কিছু প্রকল্প রয়েছে যেখানে তিন মাসে, ছ’মাসে অথবা বার্ষিক ভিত্তিতেও তা পাওয়া যায়।
• পেনশনের অঙ্ক ঠিক করার ক্ষেত্রেও কখন তা নেওয়া হচ্ছে, তা মাথা রাখে বিমা সংস্থাগুলি। যেমন, সাধারণত দেখা যায় মাসিক ভিত্তিতে পেনশন নিলে যে টাকা পাওয়া যায়, ছ’মাসে বা বছরে এক বার নিলে পাওয়া যায় তার থেকে বেশি টাকা।
গ্রাহকের মৃত্যু হলে
• পেনশন চালু হওয়ার পরে গ্রাহক মারা গেলে তাঁর নমিনি মূল টাকা ফেরত পাবেন।
• এমন অ্যানুইটি প্রকল্পও রয়েছে, যেখানে গ্রাহক মারা যাওয়া পর্যন্ত পেনশন পাবেন। আর তার পরে তাঁর স্ত্রী অথবা স্বামী নিয়মিত সেই টাকা পাবেন। স্ত্রী বা স্বামীর মৃত্যুর পরে নমিনি মূল টাকা ফেরত পাবেন। এই ধরনের প্রকল্পকে ‘জয়েন্ট লাইফ’ প্রকল্পও বলা হয়।
• আবার অনেক প্রকল্পের ক্ষেত্রে পেনশন চালুর পরে গ্রাহক মারা গেলে তাঁর নমিনি ৫, ১০, ১৫ বা ২০ বছর পর্যন্ত পেনশন পেতে পারেন। কত
দিন ধরে সেই টাকা পাওয়া যাবে, পলিসি কেনার সময়েই তার মেয়াদ ঠিক করে দিতে হয়।
কিন্তু মনে রাখতে হবে, এ ক্ষেত্রে প্রকল্পে উল্লিখিত সময় পর্যন্ত শুধু পেনশনই পাওয়া যাবে। নমিনি মূল টাকা ফেরত পাবেন না। যদিও দেখা যায় সাধারণত এই সব প্রকল্পে পেনশনের অঙ্ক তুলনামূলক ভাবে অন্যান্যগুলির চেয়ে বেশি হয়।
আয়কর
• আয়কর আইন অনুসারে অ্যানুইটি প্রকল্পে পেনশন বাবদ পাওয়া টাকার উপরে কর দিতে হয়।
• আলাদা করে এ ক্ষেত্রে আয়কর হিসেব হয় না। বরং এই পেনশনের টাকা গ্রাহকের বছরে মোট আয়ের সঙ্গে যুক্ত করা হয়। সেই মতো ঠিক হয় করের হার।
• পেনশন প্রাপক যদি ভারতের নাগরিক হন, তা হলে কোনও উৎস কর (টিডিএস) কাটা হয় না। কিন্তু নিয়ম অনুসারে অনাবাসী ভারতীয়দের ক্ষেত্রে অ্যানুইটি প্রকল্পে টিডিএস কাটা হয় ৩১.২০% হারে।
• তবে ডেফার্ড অ্যানুইটি অথবা নির্দিষ্ট সময় ধরে নিয়মিত টাকা জমা দিয়ে তার পরে অ্যানুইটি কেনার ক্ষেত্রে প্রতি বছরে ওই জমা টাকার উপরে আয়করের ৮০ ধারা অনুযায়ী পাওয়া যায় কর ছাড়।
তথ্য সহায়তা: জীবনবিমা নিগম, টাটা এআইএ লাইফ ইনশিওরেন্স, ইউটিআই মিউচুয়াল ফান্ড