বৈশাখী মজুমদার
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলেছে অনেক কিছুই। বিশ্ব জুড়ে নারীরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাবলীল ভাবে তুলে ধরছেন নিজেদের। দৃষ্টান্ত হয়ে থাকছেন আগামী প্রজন্মের কাছে। এমনই এক নারী বৈশাখী মজুমদার। যিনি একাধারে সংবাদ পাঠিকা, নৃত্যশিল্পী এবং এক জন সফল ব্যবসায়ী। তাঁর পথ চলার গল্প বহু নারীকে অনুপ্রেরণা জোগায়।
বৈশাখী মজুমদার -এর কর্মজীবনের শুরুটা হয়েছিল দূরদর্শনের হাত ধরে। এর পরে একে একে বিভিন্ন বেসরকারি চ্যানেলে সংবাদ উপস্থাপকের ভূমিকায় থেকেছেন তিনি। তাঁর উপস্থাপনের ভঙ্গিমা, কথোপকথন ও টিভির ওপার থেকে দর্শকদের কাছে টেনে আনার প্রবণতা এক কথায় মুগ্ধ করেছিল সকলকেই। তবে কোথায় কী ঘটছে, তা এক লহমায় দর্শক, শ্রোতাদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার পাশাপাশি আরও একটি বিষয়ে তিনি বহু মানুষের নজর কেড়েছেন। তা হল নৃত্যকলা। ঠিক যেমন ভাবে টিভির পর্দায় তাঁর ভাষ্য সকলের মন মজিয়ে দিত, ঠিক তেমনই তাঁর নাচেও ছড়িয়ে যেত মুগ্ধতার রেশ।
নাচের শখ বরাবরই ছিল বৈশাখীর। বহু দিন ওড়িশি নাচের স্বনামধন্য গুরু পদ্মবিভূষণ কেলুচরণ মহাপাত্রের অনুগামী হিসাবে সময় কাটিয়েছেন। থেকেছেন গুরুজির আশ্রমেও। প্রসঙ্গত, আশ্রমে থাকার সময়েই নাচের প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করেন তিনি। শখ বদলে যায় ভালবাসায়। শহর থেকে দেশ, তাঁর ঘুঙুরের ঝঙ্কারের সাক্ষী থেকেছে বহু মঞ্চ। মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাতে হারিয়ে গিয়েছেন দর্শকও।
বৈশাখীর এই কৃতিত্বে ক্রমশ ভারী হয়েছে তাঁর পুরস্কারের ঝুলি। নৃত্যকলায় অসামান্য পারদর্শিতার জন্য ১৯৯৫ সালে উত্তমকুমার পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। পাশাপাশি, একাধিক বর্ষসেরা নৃত্যশিল্পীর খেতাবও রয়েছে তাঁর। বাংলাদেশ জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন থেকে পেয়েছেন ‘সংবাদ পত্রিকা’ অ্যাওয়ার্ড। রয়েছে টিওওয়াইপি অর্থাৎ আউটস্ট্যান্ডিং ইয়ং পার্সন অফ ইন্ডিয়ার সম্মান। এমনই নানা পুরস্কারের ঔজ্জ্বল্যে ঝলমলে তালিকা।
বৈশাখীর বড় হয়ে ওঠার গল্পে অনেকটা জুড়ে রয়েছেন তাঁর বাবা রথীন মজুমদার। কলকাতার এক অভিজাত, সমৃদ্ধ পরিবারে জন্ম। শৈশব থেকে কৈশোর হয়ে যৌবন — বাবার হাত ধরেই ধীরে ধীরে সংস্কৃতিমনস্ক হয়ে ওঠেন বৈশাখী। রথীনবাবু যুক্ত ছিলেন চলচ্চিত্র নির্মাণ এবং অন্যান্য সাংস্কৃতিক চর্চার সঙ্গে। ফলত, বৈশাখীর সংস্কৃতির প্রতি ঝোঁকের অনেকটাই ছিল সহজাত। সেই কারণেই শিল্পের সঙ্গে নিজেকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেলার পাশাপাশি তিনি যখন কর্মজগতে প্রবেশ করেন, তখনও তিনি সফলতার মুখ দেখেন খুব কম সময়েই।
জ্যাসপার বাই বৈশাখী
ফেলে আসা দিনগুলিকে পাশে রেখেই পরবর্তীতে বৈশাখী শুরু করে ছিলেন তাঁর ব্যবসা। কোথাও একটা লুকোনো ইচ্ছে তো ছিলই। তাকেই আস্কারা দেওয়া আর কী! আর সেখানেও সফল। তাঁর বুটিক ‘জ্যাসপার বাই বৈশাখী’র নাম হয়তো অনেকেই শুনেছেন। এক জন গ্রাহকের সমস্ত প্রয়োজনীয়তার কথা মাথায় রেখেই বিভিন্ন নকশা তৈরি হয় এখানে। নৃত্য জগত এবং সংবাদমাধ্যমে বহুদিন থাকার ফলে গ্ল্যামার ইন্ডাস্ট্রিকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন বৈশাখী। ফলে তাঁর কাছে প্রথম থেকেই পরিষ্কার ছিল যে, বাজারে আধুনিক ফ্যাশনের কোন কোন দিকগুলিতে এখনও খামতি থেকে গিয়েছে। এবং বলা বাহুল্য প্রথাগত ধারণা থেকে খানিকটা বেরিয়ে এসে নকশায় সেই বিষয়গুলিকেই ফুটিয়ে তুলেছেন বৈশাখী। নিয়ে এসেছেন নতুন ধরনের পোশাক। যা সাদরে গ্রহণ করেছে আমজনতা। বেনারসি থেকে শুরু করে পৈঠানি — ভারতীয় ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির নানা নিদর্শন রয়েছে তাঁর সংগ্রহে।
অতিমারির সময়ে গোটা বিশ্ব যখন আমূল পরিবর্তনের সাক্ষী ছিল, সেই সময়েই অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে তিনি শুরু করেছিলেন বুটিকের ব্যবসা। খুব কম সময়ের মধ্যে জনপ্রিয়তার শিখর ছুঁয়ে ফেলে তাঁর এই উদ্যোগ। দেশ পেরিয়ে বিদেশের মাটিতেও গ্রহণযোগ্যতা বাড়তে থাকে ‘জ্যাসপার বাই বৈশাখী’র নজরকাড়া সংগ্রহের। বর্তমানে তিনি কলকাতা শহরের প্রথম সারির একজন ব্যবসায়ী।
একটা বিষয় লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, বৈশাখী মজুমদার -এর জীবনের সঙ্গে ভীষণ ভাবে ‘সফলতা’ শব্দটি জড়িয়ে। ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্য থেকে সংবাদ উপস্থাপন এবং সব শেষে ব্যবসা — প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি সফল। পাশাপাশি, তিনি জাতীয় স্তরের রাইফেল শ্যুটারও। জীবন ও যাত্রাপথ নিয়ে কী মত বৈশাখীর? উত্তরে, বললেন, “কাজই একমাত্র জিনিস, যা আমাদের অভ্যন্তরীণ সম্ভাবনাগুলিকে নিজের মতো করে ফুটিয়ে তুলতে পারে। আমি সেই সম্ভাবনাগুলিকেই ফুটিয়ে তুলেছি। সাম্প্রতিক সময়ে ডিজিটাল মাধ্যম বিশ্বব্যপী যোগাযোগকে যে ভাবে উন্নত করেছে, তা আমার এই ব্যবসাকে বড় হতে সাহায্য করেছে। চেষ্টা করছি আগামী দিনে এই ব্যবসাকে যেন এক অন্য পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারি।”
বৈশাখী মজুমদারের এই তাঁর পথ চলার গল্প আজকের বহু নারীকেই হয়তো প্রেরণা জোগাবে। তিনি যে ‘সর্বজয়া’!
এই প্রতিবেদনটি 'উই মেক আস' -এর সঙ্গে আনন্দবাজার ব্র্যান্ড স্টুডিয়ো দ্বারা যৌথ উদ্যোগে প্রকাশিত।