‘ফিনটেক’ — শব্দটি চারদিকে ব্যাপকভাবে শোনা যাচ্ছে। যদি সংজ্ঞার দিক দিয়ে দেখা যায় তা হলে এর অর্থ প্রযুক্তির প্রয়োগে আর্থিক সমস্যার সমাধান। এক কথায় যা নতুন কিছুই নয় কিন্তু! ১৯৬০ সাল থেকে ক্রেডিট কার্ড, ব্যাঙ্ক কম্পিউটারাইজেশন এবং এটিএমের মাধ্যমে ব্যাঙ্কিং ইত্যাদির মাধ্যমে অর্থনীতি পুনর্নিমাণের কাজ চলছে। বর্তমানে ফিনটেক পরিষেবাগুলি শুধুমাত্র ব্যাঙ্কিং বা পেমেন্টের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। বরং অর্থনীতির সম্পূর্ণ পরিষেবা জুড়ে রয়েছে।
আমরা যদি আর্থিক সিস্টেমের সমস্যাগুলি বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করি তা হলে এই সমস্যাগুলি এড়ানো যায় না:
এ ক্ষেত্রে বিশাল সার্চিং কস্ট থাকে। আর পুরনো দিনে মধ্যস্থতাকারী অথবা সাধারণ বাংলায় যাকে দালাল বলা হয়, কমিশনের বিনিময়ে দুই প্রতিপক্ষের মধ্যে মধ্যস্থতা করে এই সমস্যার সমাধান করত।
এ ক্ষেত্রে বাড়তি সমস্যা হল চুক্তি এবং লেনদেনের খরচ। অথচ মধ্যস্থতাকারীদের মধ্যে তুমুল প্রতিযোগিতা থাকলে তবেই লেনদেনের খরচ কম হবে।
এর পরে ঝুঁকি ভাগাভাগির কথায় আসা যাক। যদি এক জন ঋণদাতা শুধুমাত্র এক জন ঋণগ্রহীতাকেই ঋণ দেয়, তা হলে সে ক্ষেত্রে ঝুঁকি কিন্তু অনেকটাই বেশি। একাধিক ঋণগ্রহীতাকে ঋণ দিলে সে ক্ষেত্রে ঝুঁকি কম।
শেষ বিষয়টি হল তথ্যের অসমতা। ঋণদাতার কাছে ঋণগ্রহীতা সম্পর্কে অপর্যাপ্ত তথ্য থাকলে, ঋণদাতা ঋণগ্রহীতার প্রতিটি কাজ অথবা উদ্দেশ্য অনুমান করতে পারে না। আর ঋণগ্রহীতা যদি ইচ্ছাকৃতভাবে চুক্তির খেলাপ করে যাকে নৈতিক বিপত্তি বলা হয়, তা হলে ঋণদাতা অর্থ হারায়। বিক্ষিপ্ত ও ব্যায়বহুল তথ্যের যুগে ঋণদাতা সম্পর্কে তথ্যের ব্যবহার আসলে মনিটরিং খরচে যোগ হয়।
অর্থনীতিতে ডিজিটাল প্রযুক্তি বা ফিনটেক এই ধরনের সমস্যা সমাধানের উদ্দেশ্যেই ব্যবহার করা হয়। ফিনটেককে এক কথায় বিশ্লেষণ করলে বলা যেতে পারে এটি সর্বোত্তম খরচে এক অ-মানব মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় কাজ করে যা সঠিক ফলাফল দেয়।
ফিনটেক কী ভাবে এই সমস্যাগুলি সমাধান করে তা বোঝার জন্য ফিনটেকের পিয়ার-টু-পিয়ার ঋণের বিষয়টি ধরা যাক। এই ধরনের ঋণে এক জন সাধারণ মানুষ অপরকে ঋণ দেয়।
ওয়েব ২.০ এবং সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে ফিনটেক সুরক্ষিত ক্রেতা ও বিক্রেতা অথবা ঋণদাতা এবং ঋণগ্রহীতাকে এক জায়গায় নিয়ে আসতে পারে যাতে খুব সহজেই মধ্যস্থতা করা যায়।
এই পরিস্থিতিতে একজন ঋণদাতা বিভিন্ন ঋণগ্রহীতাদের মধ্যে থেকে নিজের পছন্দ অনুযায়ী ঋণগ্রহীতা বাছাই করতে পারে। এবং ঝুঁকি থাকলে তা একাধিক ঋণগ্রহীতার মধ্যে ভাগ করে নিতে পারে। উচ্চতর অংশগ্রহণের সঙ্গে কমে ‘বিড-আস্ক’ যা কম খরচের লেনদেনের পাশাপাশি প্রক্রিয়ায় প্রয়োজনীয় লিকুইডিটি নিয়ে আসে।
প্রযুক্তি ব্যবহার করে চুক্তির খরচ আরও কমিয়ে নেওয়া যায়। পূর্বলিখিত চুক্তিপত্রে উভয় পক্ষ ডিজিটাল স্বাক্ষর করতে পারে যদি কেওয়াইসি শংসাপত্র ডিজিটাল মাধ্যমে চুক্তিতে যোগ করা থাকে। এর ফলে আদালত থেকে স্ট্যাম্প পেপার সংগ্রহ, চুক্তির নথি মুদ্রণ এবং আইনজীবীর সহায়তায় রেজিস্ট্রেশন করা ইত্যাদি বিস্তৃত প্রক্রিয়ার প্রয়োজন পড়ে না।
সার্চিং কস্ট এবং লেনদেনের খরচ একবার কমিয়ে নিলে, এক জন ঋণদাতা সহজেই কম খরচে অনেক ঋণগ্রহীতাকে ঋণ দিতে পারে। পাশাপাশি ঝুঁকি ভাগাভাগিতেও সুবিধা হয়। এর ফলে ঋণদাতাদের যে সব ঝুঁকির মুখোমুখি হতে হয় তা অনেকটাই কমে যায়।
প্রযুক্তির হাত ধরে মনিটরিং আরও সহজ হয়ে উঠেছে। একটি পিটুপি ঋণদানকারী ফিনটেক রেকর্ডে ঋণদাতা ও ঋণগ্রহীতার প্রোফাইল, কেওয়াইসি ভেরিফিকেশন, ব্যবহারকারীর ক্রেডিট রেটিং ইত্যাদি থাকে। প্রয়োজনে এটি অন্যান্য ব্যবহারকারীদের সঙ্গেও ভাগ করে নিতে পারে ঋণদাতা বা ঋণগ্রহীতা।
কোনও রেস্তরাঁয় খাওয়ার আগে বা ই-কমার্স সাইটে কেনাকাটা করার আগে আমরা ব্যবহারকারীর রেটিং পরীক্ষা করে থাকি। ঠিক একইভাবে, ঋণ দেওয়ার আগে ঋণগ্রহীতার ক্রেডিট রেটিং পরীক্ষা করা যেতে পারে।
এক জন বুদ্ধিমান ঋণদাতা ঋণের চাহিদা সরবরাহের ব্যবধানের মাধ্যমে নিম্নমানের ঋণগ্রহীতাদের উচ্চ হারের ঋণ দিয়ে প্রচুর অর্থ উপার্জন করতে পারে। যেহেতু রেটিং সর্বজনীন ঋণের অপ্রদানে তাই ভবিষ্যতে ঋণ ব্যয়বহুল হতে পারে অথবা আর কোনও ঋণ নাও পাওয়া যেতে পারে। সুতরাং, নৈতিক বিপত্তির সম্ভাবনা কমে।
গ্রামীণ ক্ষুদ্র ঋণে সামাজিক নিয়ন্ত্রণের মতোই ফিনটেক সোশ্যাল মিডিয়ার নিয়ন্ত্রণ ঋণের অপ্রদান হওয়ার সম্ভাবনাকে অনেকাংশেই কমিয়ে দেয়। এবং খুব কম খরচে, সহজেই মনিটরিং করা যায়। যেহেতু সমস্ত অংশগ্রহণকারীদের সঙ্গে পর্যবেক্ষণের ফলাফল ভাগ করা হবে, তাই তথ্যের অসমতার সমস্যাও কমে যাবে।
উপসংহারে এটা বলে রাখা ভাল যে আমাদের পিয়ার-টু-পিয়ার ঋণদানকারী ফিনটেক এখনও আরবিআই দ্বারা আইনিভাবে স্বীকৃত নয়। তবে আগামী বছরগুলিতে ক্রাউডফান্ডিং, ক্রাউড-ইনভেস্টমেন্ট, স্টার্ট-আপ-ফান্ডিং, ফার্মার-ফিনান্স এবং এমএসএমই –এর মত অনেক ফিনটেক সংস্থা দেখতে পাব আমরা।
ভারত এমন একটি দেশ যেখানে আর্থিক অন্তর্ভুক্তি কম, তাই ভারত এই ধরনের পরীক্ষা নিরীক্ষার কেন্দ্রস্থল হয়ে উঠতে পারে। যাই হোক, সেই অ্যাপগুলির মাধ্যমে বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করতে হবে যেমন সার্চিং কস্ট, লেনদেনের খরচ, ঝুঁকি ভাগ করে নেওয়া, তথ্যের অসাম্যতা, নিয়ন্ত্রণ খরচ ইত্যাদি।
ফিনটেক সেক্টরে পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত দু’টি উপায়ে কর্মসংস্থানের সুযোগ আসবে। যাঁদের নতুন আইডিয়া রয়েছে, তাঁরা বিভিন্ন নতুন ফিনটেক সমাধান তৈরি করার চেষ্টা করবে। বর্তমানে যে ফাঁকগুলি রয়েছে তার উপর কাজ করতে পারবে তারা। অন্য দিকে, যাঁদের প্রযুক্তিগত দক্ষতা রয়েছে তারা প্রকৃত সমাধান এবং অ্যাপ্লিকেশন তৈরির কাজ করবে।
অধ্যাপক সায়ন্তন কুন্ডু প্র্যাক্সিস বিজনেস স্কুলের সহযোগী অধ্যাপক। প্র্যাক্সিস বিজনেস স্কুলে দুই বছরের পিজিডিএম প্রোগ্রামে প্রোজেক্ট ফিনান্সিং এবং ক্রেডিট রিস্ক ম্যানেজমেন্টের উপর স্পেশালাইজেশন করানো হয়। প্রযুক্তির মাধ্যমে ডিজিটাল দুনিয়ায় নতুন যুগের সমাধান তৈরি করতে সক্ষম, এমন আর্থিক পেশাদারদের তৈরির উপরে জোর দিচ্ছে প্র্যাক্সিস বিজনেস স্কুল।
এই প্রতিবেদনটি ‘প্র্যাক্সিস বিজনেস স্কুল’-এর সঙ্গে আনন্দবাজার ব্র্যান্ড স্টুডিয়ো দ্বারা যৌথ উদ্যোগে প্রকাশিত।