ছবি সৌজন্যে: নিলয়
ছেলেবেলায় প্রথম প্রেম ছিল মিউজ়িক, তার সঙ্গে ছবি আঁকা। এই দুই প্রেমের টানেই হেভি মেটাল ব্যান্ডের ড্রামার থেকে ভারত তথা বিশ্বের অন্যতম সেরা ‘ট্যাটু আর্টিস্ট’— ঠিক এমনই এক রূপকথার উড়ান নিলয় দাসের। তবে তার শুরুর দিকটা কিন্তু মোটেই সহজ ছিল না। সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের ছাত্র নিলয় প্রথমে ছিলেন হেভি মেটাল ব্যান্ডের ড্রামার। কিন্তু ব্যান্ড চালানোর খরচ আসবে কী ভাবে? তার সমাধান করতে গিয়েই মাথায় আসে ট্যাটু-র আইডিয়া। ছোটবেলা থেকেই ছবি আঁকার হাত খুব ভাল ছিল নিলয়ের। ছবি আঁকার প্রতিযোগিতায় রাজ্যের মধ্যে দ্বিতীয় হয়েছিলেন। এ ছাড়াও জিতেছেন অসংখ্য সম্মান। সেই দক্ষতাকেই কাজে লাগিয়ে ট্যাটু আঁকায় হাতেখড়ি হয় নিলয়ের। তবে, ট্যাটুর প্রতি একটা আগ্রহ নিলয়ের বরাবরই ছিল। বন্ধুর থেকে ধার করে জীবনের প্রথম ট্যাটু করেছিলেন তিনি।
ছবি সৌজন্যে: নিলয়
সেই সময়ে ‘মায়ামি ইঙ্ক’ ও ‘এলএ ইঙ্ক’-এর মতো আমেরিকান রিয়্যালিটি শো ট্যাটুর প্রতি নিলয়ের আকর্ষণকে আরও বাড়িয়ে তোলে। একুশ শতকের গোড়ায় কলকাতায় তখন না ছিল ট্যাটু আঁকা শেখার স্কুল, আর না ছিল সোশ্যাল মিডিয়ার রাজপাট। ট্যাটু মেশিনও ছিল দুর্লভ। জানলে অবাক হবেন, জীবনের প্রথম ট্যাটু মেশিনটি কিন্তু নিজের হাতেই তৈরি করেছিলেন নিলয়। আর তা দিয়েই শুরু হয়েছিল তাঁর ট্যাটু আঁকার কাজ। এমনকি প্রথম ট্যাটু নিজের শরীরেই করেছিলেন নিলয়। তার পরে বন্ধুরা তাঁর কাছে ট্যাটু করানো শুরু করেন। সে ভাবে পয়সা জমিয়ে বিদেশ থেকে ট্যাটু কিট কিনে আনেন নিলয়। বাড়িতেই ছোটখাটো করে কাজ করতে থাকেন।
এ দিকে এত কাল মিউজ়িক আর ট্যাটুকে দুই-ই আঁকড়ে দিন কাটছিল নিলয়ের। এ বার কেরিয়ারের টানে ট্যাটুকেই পেশা হিসেবে বেছে নিতে বাধ্য হলেন তিনি। মিউজ়িক থেকে গেল নেশা হয়েই। কিন্তু ট্যাটুকে জীবিকা করতে গেলে স্টুডিয়োর একান্ত প্রয়োজন। তাই ২০১০-এ লেক গার্ডেন্সে ১০০ স্কোয়্যার ফিট জায়গায় শুরু হল আজকের আইকনিক ট্যাটু ব্র্যান্ড ‘লিজ়ার্ডস স্কিন ট্যাটুজ়’-এর পথচলা। হু হু করে বাড়তে থাকল নিলয়ের ট্যাটুর চাহিদা। পরে ২০১২-য় অনেকটা বড় জায়গা নিয়ে সাউথ সিটি মলের উল্টো দিকে এখনকার ঠিকানায় চলে আসে ‘লিজ়ার্ডস স্কিন ট্যাটুজ়্’ (Lizard's Skin Tattoos)।
ছবি সৌজন্যে: নিলয়
ট্যাটু স্টুডিয়োর এমন নাম কেন? নিলয়ের কথায়, “গিরগিটি নিজের শরীরের রং ইচ্ছেমতো বদলাতে পারে। তেমনই ট্যাটু মানুষকে নিজের শরীর পছন্দমতো সাজাতে সাহায্য করে। আর নিলয়ের প্রিয় ফ্রেঞ্চ হেভি মেটাল ব্যান্ড ‘গজিরা’র এক জনপ্রিয় গান ‘লিজ়ার্ড স্কিন’। এই দুই ভাবনার মিশেলেই স্টুডিয়োর নাম রাখা হয় ‘লিজ়ার্ডস স্কিন ট্যাটুজ়’।”
এরপর শুধুই এগিয়ে চলার গল্প। ২০১৩-য় ট্যাটু ইন্ডাস্ট্রির এক বিরাট ট্যাটু মেশিন আর সরঞ্জাম প্রস্তুতকারক, জার্মানির সংস্থা ‘শ্যেন’ (Cheyenne) প্রথম ভারতীয় ট্যাটু শিল্পী হিসেবে নিলয়কে স্পনসর করে। এগিয়ে আসে আমেরিকার ‘রেডিয়ান্ট কালার্স (Radiant Colors)’ এবং জার্মানির ‘স্কুইডস্টার (Squidster)’-ও। এখন বছরে তিন মাস নিলয় ইউরোপের বিভিন্ন দেশে অতিথি শিল্পী হিসেবে কাজ করেন। এ পর্যন্ত পঞ্চাশটিরও বেশি দেশি-বিদেশি ট্যাটু কনভেনশনে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেছেন নিলয়। ঝুলি ভরেছে অজস্র সেরার শিরোপায়। বহু আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বিচারকের দায়িত্বও পালন করেছেন নিলয়।
একই সঙ্গে ডালপালা মেলে বড় হয়েছে ‘লিজ়ার্ডস স্কিন ট্যাটুজ়’ও। দরজা খুলেছে তার একের পর এক নতুন শাখা। হাওড়ায় অবনী মল, সল্টলেকের সেক্টর ওয়ানে সিএফ ব্লক এবং কল্যাণীতে সেন্ট্রাল পার্কের কাছে শাখা রয়েছে তাদের। ২০২৪-এর ফেব্রুয়ারিতে রাজ্যের বাইরে পা রাখে ‘লিজার্ডস স্কিন ট্যাটুজ়’। বেঙ্গালুরুর এইচএসআর লে আউট(HSR Layout)-এ খোলা হয় নতুন শাখা, যা এখন ওই শহরে ট্যাটুর হটস্পট। সঙ্গে শুরু হয়েছে আরও নতুন উদ্যোগও।
‘লিজ়ার্ডস স্কিন ট্যাটুজ়’-এর ছাদের নীচে এখন আরও দুই সংস্থা। ‘আইব্রো মাইক্রো ব্লেন্ডিং’, ‘লিপ কারেকশন’ এবং লেজার ট্যাটু রিমুভালের মতো পরিষেবার জন্য রয়েছে ‘ফেসলিফ্ট পার্মানেন্ট বিউটি ক্লিনিক’। এ ছাড়াও রয়েছে ট্যাটু টেকনিক শেখানোর অ্যাকাডেমি ‘লিজ়ার্ডস স্কিন আর্টডেমি’। ‘লিজ়ার্ডস স্কিন ট্যাটুজ়’-এর ক্লায়েন্টের তালিকায় রয়েছেন বহু তারকাও- নামী অভিনেতা থেকে ক্রিকেটার বা অলিম্পিয়ান তিরন্দাজ, বিজ়নেস ম্যাগনেট থেকে সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার— সবারই ট্যাটু করানোর একমাত্র ঠিকানা এখন ‘লিজ়ার্ডস স্কিন ট্যাটুজ়’।
ছবি সৌজন্যে: নিলয়
ছবি যেমন বিভিন্ন রীতিতে আঁকা হয়, ট্যাটুরও তেমন নানা বিভাগ রয়েছে। যেমন রিয়েলিস্টিক, মাওরি, অর্নামেন্টাল, অ্যাবস্ট্রাক্ট, নিউ স্কুল ইত্যাদি। ‘লিজার্ডস স্কিন ট্যাটুজ়’-এ এমন বিভিন্ন রীতিতে দক্ষ সতেরো জন শিল্পী রয়েছেন। আপনার চিন্তাভাবনার উপরে ভিত্তি করে তাঁরা এঁকে দেবেন আপনার স্বপ্নের ট্যাটু।
ট্যাটু করতে গেলে কী কী জিনিস মাথায় রাখতে হবে? নিলয়ের কথায়, “আপনি আপনার শরীরের কোথায় কী ট্যাটু করবেন, সেটা প্রথমেই ঠিক করে নিতে হবে। এর জন্য আর্টিস্টের সঙ্গে আলোচনা করে নেওয়া খুব জরুরি। তা ছাড়া আপনি যেখানে ট্যাটু করবেন বলে ঠিক করেছেন, শরীরের সেই জায়গা ডি-ট্যান করে নিলে ভাল হয়। ট্যাটু করার আগের দিন এবং ট্যাটু করার দিন অ্যালকোহল নিষিদ্ধ। আর ট্যাটু করার দিনে অবশ্যই ভরপেট খেয়ে যাবেন। খাবারের মধ্যে মিষ্টি জাতীয় খাবার থাকলে ভাল হয়। এটা আপনাকে ব্যথা সহ্য করতে সাহায্য করবে। তা ছাড়া বলে দেওয়া পদ্ধতি মেনে ট্যাটুর যত্নও নিতে হবে।“
ছবি সৌজন্যে: নিলয়
ট্যাটু মেশিন এবং সরঞ্জামও এখন অনেক উন্নত। ওয়্যারলেস এআই ভিত্তিক মেশিন বাজারে এসে গেছে। যার সাহায্যে আর্টিস্টের হাত কিংবা ক্লায়েন্টের শরীর, দুইয়ের উপরেই চাপ অনেক কম পড়ে। তা ছাড়া উন্নত মানের সরঞ্জামের কারণে ট্যাটু চলাকালীন স্বাস্থ্যবিধি এখন অনেক বেশি সুরক্ষিত। ট্রেন্ডিং ট্যাটুর তালিকায় বড় ট্যাটুর মধ্যে এ মুহূর্তে রয়েছে শিব, সিংহ বা বাঘের ট্যাটু। নিজের পছন্দের তারকার ছবিও অনেকে নিজের শরীরে অক্ষয় করে রাখেন। ছোট ট্যাটুর মধ্যে জনপ্রিয় ইনফিনিটি, মিউজ়িক্যাল নোট, প্রজাপতির মতো ট্যাটু। ‘লিজ়ার্ডস স্কিন ট্যাটুজ়’ ক্লায়েন্টের কল্পনার ওপরে ভিত্তি করে কাস্টম ট্যাটু তৈরিতে বিশ্বাস করে।
ছবি সৌজন্যে: নিলয়
নিলয়ের ভাষায়, “ট্যাটু শুধুমাত্র ছবি আঁকা নয়, এটি ছবির মাধ্যমে কোনও গল্পকে চিরস্থায়ী করে তুলে ধরা। নিজের মনের মতো ট্যাটুতে তাই তুলে ধরুন আপনার নিজস্ব গল্প।” নিজের গল্পকে নিজেরই শরীরে আঁকায় ফুটিয়ে তুলতে চাইলে আপনারও গন্তব্য হোক ‘লিজ়ার্ডস স্কিন ট্যাটুজ়’।
এই প্রতিবেদনটি ‘ লিজ়ার্ডস স্কিন ট্যাটুজ়’—এর সঙ্গে আনন্দবাজার ব্র্যান্ড স্টুডিয়ো দ্বারা যৌথ উদ্যোগে প্রকাশিত।