ভয়াবহ: কান্নায় ভেঙে পড়েছেন মৃতদের পরিজন (উপরে)। আগুন নেভাচ্ছেন দমকলকর্মীরা। বৃহস্পতিবার ঢাকায়। ছবি: এএফপি।
যানজটে ঠাসা সঙ্কীর্ণ গলিতে একের পর এক গ্যাস সিলিন্ডারের বিস্ফোরণ। আগুনের তাপে ফেটে যায় রাস্তার পাশে থাকা বিদ্যুতের ট্রান্সফর্মারও। তা থেকে আগুন ছড়ায় একটি বহুতলে। এ ভাবেই বুধবার রাত ১০টা নাগাদ লঙ্কাকাণ্ড বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার চকবাজার চুড়িহাট্টায়। দেড় কিলোমিটার দূরে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে যখন একুশের ভাষা দিবস স্মরণের তোড়জোড়ে শেষ মুহূর্তের ব্যস্ততা, দমকল বাহিনীর শ’দুয়েক সদস্য প্রাণ বাজি রেখে লড়াই শুরু করেছেন লেলিহান অগ্নিশিখার বিরুদ্ধে। পাশাপাশি চলে উদ্ধার কাজ। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ৮১টি মৃতদেহ উদ্ধার হয়েছে। অন্তত ৫০ জন হাসপাতালে, যাঁদের বেশ কয়েক জনের অবস্থা খুবই আশঙ্কাজনক।
পুরনো ঢাকার চকবাজার অনেকটা কলকাতার বড়বাজারের ক্যানিং স্ট্রিট বা খ্যাংরাপট্টির মতো। সঙ্কীর্ণ গলিতে মানুষের যাতায়াতের ভিড় ঠেলে এগোয় ছোট ছোট গাড়ি, মোটরবাইক, পিকআপ ভ্যান। একের পর এক বহুতলের এক তলায় প্লাস্টিকের সামগ্রী থেকে নানা রাসায়নিক, কাপড় ও প্রসাধনীর দোকান। তার পিছনে সে সব জিনিস মজুতের গুদাম। নানা ধরনের কারখানাও, যার একটা বড় অংশই বেআইনি ও নকল সামগ্রী বানানোর বলে অভিযোগ। আর ওপরের তলাগুলিতে গরিব মানুষের বসবাস, অধিকাংশই ঢাকার বাইরে থেকে আসা শ্রমিকেরা। এক একটি ঘরে এক একটি পরিবার। পুরকর্তাদের অভিযোগ, এর আগে নিমতলিতে ৫২টি প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল এমন একটি আগুনের ঘটনা। তার পরে প্রচার কম হয়নি। গত সপ্তাহেও বাহিনী নিয়ে খোদ মেয়র এসে এই সব এলাকা থেকে রাসায়নিকের গুদামগুলি সরিয়ে নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে গিয়েছেন।
কিন্তু মানুষ যে সচেতন হননি, নিদর্শন চুড়িহাট্টা।
হতাহত হওয়া অধিকাংশই পথচলতি মানুষ বলে জানিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শী ও দমকলের আধিকারিকেরা। আতঙ্কিত হয়ে বেরিয়ে আসতে গিয়ে মারা গিয়েছেন বেশ কিছু আবাসিক। আগুনের গ্রাসে সব চেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ‘ওয়াহিদ ম্যানসন’ নামে একটি বহুতল। সেটিতেই প্রথম আগুন লাগার পরে ছড়িয়ে পড়ে পাশের চার-পাঁচটি বাড়িতে। গাড়ির সিলিন্ডার ফেটে প্রথমে আগুন ছড়ায় ‘ওয়াহিদ ম্যানসন’-এর সামনে থাকা রেস্তরাঁয়। একের পর এক বিস্ফোরণ হয় সেখানে মজুত পাঁচ-ছ’টি এলপিজি গ্যাস সিলিন্ডার। তত ক্ষণে রাস্তার ধারে পোস্টের ওপরের ট্রান্সফর্মারটিও প্রচণ্ড শব্দে বিস্ফোরিত হয়েছে।
আগুন নেভাচ্ছেন দমকলকর্মীরা। বৃহস্পতিবার ঢাকায়। ছবি: এপি।
খবর পেয়েই দমকল বাহিনীর ১০টি ইঞ্জিন চলে এলেও সংকীর্ণ গলিতে ঢুকে কাজ শুরু করতে হিমশিম খায়। তার পরে একে একে আসে আরও ২৭টি ইঞ্জিন। গভীর রাতে একটা সময়ে মনে হয়েছিল আগুন নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু তার পরে একটি গুদামে রাখা সিএনজির কয়েকটি জার একের পর এক ফেটে ফের দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে আগুন। পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিমান বাহিনীর চারটি হেলিকপ্টার নামে। আকাশ থেকে জলের ফোয়ারা ছড়ানো হয়। অবশেষে বৃহস্পতিবার দুপুর ১১টায় আগুন নিভেছে বলে ঘোষণা করে দমকল বাহিনী।
মৃত অসংগঠিত শ্রমিকদের পরিবারগুলিকে আপাতত ১ লক্ষ টাকা করে সাহায্য দেওয়ার ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ সরকার। আহতদের ৫০ হাজার টাকা সাহায্যের পাশাপাশি নিখরচায় চিকিৎসার বন্দোবস্ত করা হয়েছে। ঘটনার তদন্তে দু’টি কমিটিও গড়া হয়েছে।