bangladesh

এই ডালিম হোটেলই ছিল ‘চট্টগ্রামের জল্লাদের’ মৃত্যুর কারখানা

মুক্তিযুদ্ধের সময়ে গুপ্তঘাতক আলবদর বাহিনীর অন্যতম শীর্ষ খুনী মির কাসেম আলি চট্টগ্রামে ত্রাসের রাজত্ব গড়ে তুলেছিলেন। ‘চট্টগ্রামের জল্লাদ’ হিসেবে পরিচিত মির কাসেমের নেতৃত্ব ও নির্দেশে মৃত্যুর কারখানা হয়ে উঠেছিল চট্টগ্রামে আল বদরের সদর দপ্তর ডালিম হোটেল।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ২১:১৮
Share:

মুক্তিযুদ্ধের সময়ে গুপ্তঘাতক আলবদর বাহিনীর অন্যতম শীর্ষ খুনী মির কাসেম আলি চট্টগ্রামে ত্রাসের রাজত্ব গড়ে তুলেছিলেন। ‘চট্টগ্রামের জল্লাদ’ হিসেবে পরিচিত মির কাসেমের নেতৃত্ব ও নির্দেশে মৃত্যুর কারখানা হয়ে উঠেছিল চট্টগ্রামে আল বদরের সদর দপ্তর ডালিম হোটেল।

Advertisement

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন চট্টগ্রামে আলবদর বাহিনীর প্রধান ও জামাতে ইসলামির কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য মীর কাসেম আলির বিরুদ্ধে ২০১৪ সালের ২ নভেম্বর দাখিল করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায়ের পর্যবেক্ষণে এ সব কথাই বলেছিল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল-২। এই ট্রাইবুনালই তাঁকে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন। আর ট্রাইবুনালের ৩৫১ পৃষ্ঠার রায়ে ৮৫০ বার ডালিম হোটেলের নামের উল্লেখ রয়েছে।

মহামায়া ডালিম ভবন থেকে ডালিম হোটেলে রূপান্তর

Advertisement

চট্টগ্রাম নগরের আন্দরকিল্লায় টিঅ্যান্ডটি কার্যালয়ের পিছনেই রয়েছে ডালিম হোটেলে। একাত্তরে হিন্দু পরিবারের মালিকানাধীন এই বাড়িটির নাম ছিল ‘মহামায়া ডালিম ভবন’। ‘মহামায়া ডালিম ভবন’ নামের এই বাড়িটির মালিক চন্দ্র মোহন নাথ বাড়িটির একটি ফ্ল্যাটে সপরিবারে থাকতেন। বাকি অংশটুকু ব্যবহৃত হতো বোর্ডিং হিসেবে। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ওই এলাকা ছিল আলবদর বাহিনীর অন্যতম প্রধান টার্গেট। কারণ, হাজারী গলিসহ আশপাশের লোকালয় ছিল সংখ্যালঘু অধ্যুষিত। প্রাণের ভয়ে অন্য অনেকের মতো চন্দ্র মোহন নাথও স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে খাগড়াছড়ির রামগড় হয়ে সীমান্ত অতিক্রম করেন। পরিবারটি ভারতে চলে যাওয়ার পর বাড়িটির দখলে নেয় তৎকালীন ছাত্রসংঘের অন্যতম শীর্ষনেতা মীর কাশেম আলির নেতৃত্বাধীন আলবদর বাহিনী। তারা ‘মহামায়া ডালিম ভবন’-এর নাম বদলে বাড়িটির নাম দেয় ‘ডালিম হোটেল’। আর এই ভবনেই তারা গড়ে তোলে ছাত্রসংঘ তথা আলবদর বাহিনীর কার্যালয় ও প্রধান টর্চার সেল।

ডালিম ভবনের সামনে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে আন্দোলনকারীরা। নিজস্ব চিত্র।

ডালিম হোটেলে ‘মৃত্যুর কারখানা’

উনিশশো একাত্তরে ডালিম হোটেলই ছিল চট্টগ্রামের আল-বদর বাহিনীর সব অপরাধের কেন্দ্রবিন্দু। মুক্তিযোদ্ধাদের আটকে রেখে নির্যাতন ও হত্যার ঘটনা ঘটেছে এখানেই। চট্টগ্রাম নগরীতে এরকম দুটি টর্চার সেল ছিল। একটি সাকা চৌধুরীর গুডস্ হিলের বাড়ি। অন্যটি মীর কাশেম আলির দখলে থাকা এই ডালিম হোটেল।

আল-বদর কমান্ডার মীর কাসেম ও তার সহযোগীরা একাত্তরে খোলা জিপ ও অস্ত্র নিয়ে চট্টগ্রাম শহর দাপিয়ে বেড়াতেন। শহরের কোথাও কোনও মুক্তিযোদ্ধা গোপনে আশ্রয় নিয়েছেন বলে খবর পেলেই, তার নেতৃত্বে বদর বাহিনী পাকিস্তানি সেনাদের নিয়ে অভিযান চালিয়ে তাদের ধরে ডালিম হোটেলে নিয়ে আসতেন। তাদের কাছ থেকে জোর করে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান ও মুক্তিযুদ্ধে জন্য মজুত করা অস্ত্রের বিষয়ে জানতে চাওয়া হত। মুক্তিযোদ্ধাদের উপর চলত অকথ্য অত্যাচার। তাদের কান্নার শব্দ শোনা যেত বহু দূর পর্যন্ত। নির্যাতনের পর বন্দিরা জল খেতে চাইলে প্রস্রাব খেতে দেওয়া হত। বদর বাহিনীর হাতে আটক এই মানুষগুলোকে ছাড়িয়ে নিতে প্রতিদিনই এই বাড়ির কাছাকাছি এসে অবস্থান করত তাঁদের স্বজনরা। কিন্তু বাবা-মায়ের চোখের জলে হৃদয় কখনও গলেনি পাকিস্তানের দোসর ঘাতকদের। ১৩৭৩ বঙ্গাব্দে নির্মিত ভবনটির এখন জরাজীর্ণ অবস্থা।

আরও পড়ুন: মির কাসেমের ফাঁসি যে কোনও সময়, বাংলাদেশের জেলে প্রস্তুতি তুঙ্গে

তবে এই ভবনের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রয়েছে অনেক বেদনার স্মৃতি। মুক্তিযুদ্ধের সময় ‘ডালিম হোটেল’ ও ‘মীর কাসেম আলি’ ছিলেন অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। এই হোটেলে ক্যাম্প করে মুক্তিযুদ্ধকালীন সমস্ত মানবতাবিরোধী অপরাধের নকসা তৈরি হত। আর তার তত্ত্বাবধানে ছিলেন এই আল-বদর নেতা। আর নৃশংসতার জন্য তার পরিচয় হয়েছিল ‘বাঙালি খান’ নামে।

ট্রাইবুন্যালের রায়ে উঠে আসে ডালিম হোটেলের নাম

মীর কাসেমের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে গঠন করা ১৪টি অভিযোগের মধ্যে ১২টি নির্যাতন এবং দুটি নির্যাতনের পর হত্যার অভিযোগ ছিল। আর এই ১৪টি ঘটনাই ঘটেছিল ডালিম হোটেলে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের রায়ের অনুলিপি থেকে জানা যায়, ডালিম হোটেলে বন্দিদের ওপর দিনের পর দিন নির্যাতন করা হতো। নির্মম নির্যাতন সইতে না পেরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তেন অনেকে। কিশোর মুক্তিযোদ্ধা জসিম, টুন্টু সেন ও রঞ্জিত দাশ এ ভাবেই প্রাণ হারান।

আসামিপক্ষের সাক্ষ্য থেকেও প্রমাণিত, ডালিম হোটেলে আল-বদর ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছিল। আল-বদর বাহিনীর ব্যবস্থাপনায় এটি ছিল কেন্দ্রীয় ও বিস্তৃত একটি নির্যাতন কেন্দ্রের মডেল। ট্রাইবুনালের অভিমত, একাত্তরে ডালিম হোটেল পদ্ধতিগত হত্যাকাণ্ডের আখড়ায় পরিণত হয়। চট্টগ্রামের এই টর্চার সেল নির্যাতনে প্রাণ হারিয়েছেন হাজারী গলি এলাকার রঞ্জিত দাশ, টুন্টু, সন্দ্বীপের মুক্তিযোদ্ধা জসিম উদ্দিনসহ সাতজন। খুন করে এঁদের লাশ কর্ণফুলী নদীতে ফেলে দেওয়া হয়। প্রতিদিন অন্তত অর্ধশত মুক্তিকামী মানুষকে ধরে এনে আটক ও নির্যাতন করা হতো ডালিম হোটেলে।

সেই ডালিম হোটেল এখন

চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের ভূমি বিভাগে যোগাযোগ করে জানা যায়, মহামায়া ডালিম ভবনের জায়গাটি চন্দ্র মোহন নাথের নামেই রয়েছে। তার নামে বিএস জরিপও হয়েছে। ফিরে পাওয়ার আবেদন করেছেন তার চার পুত্র বাবুল কান্তি নাথ, সুভাষ চন্দ্র নাথ, সুকুরঞ্জন নাথ ও অরুণ চন্দ্র নাথ।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement