লাকি আকন্দ। ছবি: রফিয়া আহমেদ।
আমায় ডেকো না-ফেরানো যাবে না-ফেরারি পাখিরা কুলায় ফেরে না। নিজের গানের সুর ধরেই আজ না-ফেরার দেশে পাড়ি দিলেন লাকি আকন্দ। তিনি তাঁর গানে বলেছিলেন, ‘বিবাগী এ মন নিয়ে জন্ম আমার-যায় না বাঁধা আমাকে কোনও কিছুর টানের মায়ায়।’ সত্যিই তাই হল, ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কোটি ভক্তের টানের মায়া হেরে গেল। ৬১ বছর বয়সে প্রয়াত হলেন বাংলা গানের জনপ্রিয় এই শিল্পী। শুক্রবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় পুরনো ঢাকার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে (মিটফোর্ড) শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন এই শিল্পী। লাকি আকন্দের সুহৃদ এরশাদুল হক টিংকু সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, ‘সন্ধ্যায় পুরনো ঢাকার আরমানিটোলায় নিজের বাড়িতে অসুস্থ হয়ে পড়েন লাকি। দ্রুত তাঁকে বাসার পাশের মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেই চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।’
আরও পড়ুন: বাংলাদেশ ব্যাঙ্কের রিজার্ভ চুরির ডলার ফেরাতে তৎপর হোক ফিলিপিন্স
২০১৫ সালে আচমকাই অসুস্থ হয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলেন লাকি আকন্দ। সে বছরের ১ সেপ্টেম্বর সেখানকার ডাক্তারেরা দেখেছিলেন তাঁর ফুসফুসে ক্যান্সারের কোষ। সেই শুরু ক্যান্সারের সঙ্গে যুদ্ধের। কয়েক বছর তিনি লড়েছেন। তাঁর সঙ্গে ছিল বাংলাদেশের গানপাগল মানুষের অগাধ ভালবাসা। ঢাকা থেকে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ব্যাংককের একটি হাসপাতালে।
মুক্তিযোদ্ধা এই গায়কের জন্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর তহবিল থেকে সহায়তা করেছিলেন। ব্যাংককের পিয়থাই হাসপাতালে যকৃতে অস্ত্রোপচারও করা হয়েছিল। দেশে এসে কিছু দিন থাকার পর ওই বছরের নভেম্বরে আবারও ব্যাংককে গিয়ে শরীরে ছয়টি কেমো নিতে হয়েছিল তাঁকে। কেমো শেষ করে ২০১৬ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে দেশে ফেরেন লাকি আকন্দ। তাইল্যান্ডে চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরে আসার পরও ঢাকাতে লাকি আকন্দের চিকিৎসা চলেছে। ঢাকার তিনটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি। কেমোথেরাপি শেষ হলে চিকিৎসকেরা তাঁকে বাড়িতে কিংবা পাহাড়ে গিয়ে থাকার পরামর্শ দিয়েছিলেন।
চিকিৎসা চলাকালীন মাঝে কিছুটা উন্নতিও হয়েছিল শিল্পীর শরীরের, সবার আশা ছিল আরও অনেক বছর তাঁকে পাওয়ার। তিনি নিজেও তেমনই ভেবেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্রের সড়ক দ্বীপটি তাঁর প্রিয় ছিল। ঘনিষ্ঠজনদের বলেছিলেন, তাঁর ইচ্ছা, এখানেই আবার কনসার্ট করার। একসময় লাকি আকন্দের ছোট ভাই হ্যাপি আকন্দ, কাওসার আহমেদ চৌধুরী, সামিনা, ফাহমিদা-সহ চমৎকার স্মৃতি ছিল তাঁর এখানে দ্বীপটি নিয়ে। সুস্থ হয়ে সেখানেই তুমুল আড্ডায় মাতার কথা ছিল লাকি আকন্দের। তাঁর ইচ্ছে ছিল পাহাড়ে বাড়ি বানানোর, সেখানেই বাকি দিনগুলো থাকার। ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত লাকি আকন্দ গত আড়াই মাস চিকিৎসা নিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে থেকে ৭ এপ্রিল আরমানিটোলার বাড়িতে ফিরেছিলেন তিনি।
বাংলাদেশে ’৮০-র দশক থেকে সবার প্রিয় শিল্পী লাকি আকন্দ ছিলেন সঙ্গীত পরিচালক, সুরকার ও গীতিকার। প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন অগ্রগণ্য। ’৮৪ সালে প্রথম অ্যালবাম বের হয় তাঁর। সেই অ্যালবামের ‘এই নীল মণিহার’, ‘আমায় ডেকো না’, ‘রীতিনীতি জানি না’, ‘মামনিয়া’, ‘আগে যদি জানতাম’— এই গানগুলি হয়ে উঠেছিল প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের মুখে মুখে ফেরা গান। ’৮৭ সালে ছোট ভাই হ্যাপি আকন্দ মারা যাওয়ার পরে গানের জগত থেকে কার্যত স্বেচ্ছা নির্বাসনে যান লাকি আকন্দ। দশ বছর পর ’৯৮ সালে ‘পরিচয় কবে হবে’ ও ‘বিতৃষ্ণা জীবনে আমার’ অ্যালবামের গানগুলোও পেয়েছিল ব্যাপক জনপ্রিয়তা।