ঠিক একমাস আগে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার অভিজাত এলাকা গুলশনের হলি আর্টিজান রেস্তরাঁতে হানা দিয়েছিল জঙ্গিরা। হত্যা করেছিল ১৭ বিদেশি নাগরিক-সহ ২২ জনকে। পরে সেনা-কমান্ডো অভিযানে ছয় জঙ্গি মারা যায়। আটক করা হয় একজনকে। উদ্ধার হওয়া পণবন্দিদের দু’জন হাসানাত করিম ও তাহমিদ হাসিব খানকে সন্দেহভাজন হিসেবে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল পুলিশ। তাঁদের ছেড়ে দেওয়ার কথা পুলিশ জানালেও এর পর থেকে দু’জনেই নিখোঁজ। এগিয়েছে তদন্ত। ব্লগার, পুরোহিত, পীর, যাজকের হত্যা-কাণ্ডের পরে পুলিশের যে তৎপরতা ছিল, গুলশন হামলার পরে সেই গতি বেড়েছে অনেক গুণ।
অন্য দিকে, আস্তিক-নাস্তিক বা অন্য যে বিভাজনগুলো কম-বেশি ছিল— সেটাও উধাও হয়ে গিয়েছে সমাজ থেকে। গত এক মাসে প্রান্তিক গ্রাম থেকে রাজধানী ঢাকাতে শত শত কর্মসূচির মধ্যে দিয়ে সাধারণ মানুষ জেগে উঠেছে। সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ এগিয়ে এসেছে অন্ধকার রুখতে। এর মধ্যে আর কোনও জঙ্গি হানাও হয়নি। সাহস বেড়েছে জনগণের।
গুলশন হামলার পরেই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ইদের জমায়েত কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়াতে হামলার চেষ্টা করে জঙ্গিরা। কয়েক লাখ মানুষের ওই জমায়েতে জঙ্গি হানা পুলিশ রুখতে পেরেছে। তার পরে নতুন কোনও হামলা হয়নি। বরং ঢাকার কল্যাণপুরে বড় একটা জঙ্গি ঘাঁটিতে হানা দিয়ে পুলিশ বড় সাফল্য পেয়েছে। পুলিশের সঙ্গে তাদের রাতভর গুলি বিনিময় শেষে নয় জঙ্গির মৃত্যু হয়েছে। পুলিশের ওই অপারেশন ‘স্ট্রম ২৬’ সাহসী করেছে সাধারণ মানুষকে। ভরসা বেড়েছে পুলিশের প্রতি।
আরও পড়ুন: সাবেক গভর্নরের নাতি নিহত জঙ্গি
গুলশনের ঘটনার পরে বাংলাদেশের পুলিশ ও অনান্য সংস্থা অভিযান চালাতে শুরু করে। ঢাকার বসুন্ধরা ও শেওড়াপাড়ায় হামলাকারীদের দু’টি আস্তানার খোঁজ মেলার পর ফ্ল্যাটগুলোর দুই মালিক-সহ চার জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এদের মধ্যে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসিও আটক হয়েছেন। তিনি সরকারি নিয়ম না মেনে নিবরাস ও তার সঙ্গীদের বাড়ি ভাড়া দিয়েছিলেন। নরসিংদী, কুমিল্লা এবং ঢাকার আশুলিয়া থেকে এক মহিলা-সহ অন্তত চার জনকে আটকের খবরও সংবাদ মাধ্যমে এসেছে। কল্যাণপুরে জঙ্গি আস্তানার অভিযানে নিহত রায়হান কবির তারেক গুলশান হামলাকারীদের প্রশিক্ষক ছিলেন বলেই ঢাকা পুলিশের দাবি।
গুলশনের হলি আর্টিজান বেকারিতে মৃত জঙ্গিদের বাইরেও ওই হামলায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে জড়িত আট থেকে নয় জন সম্পর্কে তথ্য মিলেছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। ঢাকা পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেছেন, “ওই জঙ্গিদের বিষয়ে প্রমাণ সংগ্রহের কাজ চলছে।” তদন্তের স্বার্থে এখনই প্রকাশ তাদের পরিচয় জানাতে চাননি তিনি। গুলশনের হামলায় ব্যবহৃত অস্ত্রের উৎস সম্পর্কেও পুলিশ জানে বলে কয়েক দিন আগে জানিয়েছিলেন আইজিপি এ কে এম শহিদুল হক। রবিবার অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মনিরুল জানালেন পরিকল্পনাকারীদের শনাক্ত করার কথা। তিনি বলেন, “মাস্টারমাইন্ড কারা, তাদের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের কাজ চলছে। এই ঘটনায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে জড়িত রয়েছেন এমন আট-নয় জনের নাম আমরা জানতে পেরেছি।’’ অন্য দিকে, গুলশন হামলার পর আইএস-এর দায় স্বীকারের বার্তা ও হামলাকারীদের ছবি সাইট ইন্টেলিজেন্সে এলেও বাংলাদেশ পুলিশ বরাবরই বলেছে, হামলাকারীরা জেএমবির সদস্য। মনিরুলের সাফ কথা, “হামলাকারীরা বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় বাড়ি ভাড়া নিয়েছিলেন। তারা নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জেএমবির সদস্য বলে গোয়েন্দারা নিশ্চিত।” বাংলাদেশে গত দু’বছরে রাজীব হায়দার হত্যা এবং তার পরের বিভিন্ন জঙ্গি কার্যকলাপের জন্য জেএমবি, আনসারুল্লাহ বাংলাটিম কিংবা হরকাতুল জিহাদকেই দায়ী করে এসেছে পুলিশ।
মনিরুলে আরও দাবি, ২০১৩ সালের দিকে আনসারুল্লাহ বাংলাটিমের নেতা জসীমউদ্দিন রাহমানির নেতৃত্বে কয়েকটি জঙ্গি সংগঠনের নেতা-কর্মীরা একত্রিত হয়েছিলেন। তাঁরা যৌথ ভাবে নিজেদের মতাদর্শ প্রচারে একমত হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার কিছু দিনের মধ্যেই রাহমানী গ্রেফতার হওয়ার পরে তাঁদের যৌথ কাজ করার পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। পরে ‘জিহাদি গ্রুপ অব বাংলাদেশ’ নামে আনসারুল্লাহ, জেএমবি ও হুজির নেতা-কর্মীরা এক হওয়ার চেষ্টা করেও সফল হয়নি বলে দাবি করেন ওই গোয়েন্দাকর্তা। তাঁর কথায়, “পারস্পরিক অবিশ্বাস ও মতপার্থক্যের কারণে তাঁরা এক হয়ে কাজ না করতে পেরে বর্তমানে আলাদা ভাবে নিজেদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে অস্তিত্ব জানান দেওয়ার ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে এক ধরনের প্রতিযোগিতা সব সময় কাজ করে।”
গুলশন হামলার পরে ব্যবসা-বাণিজ্য আর বিনিয়োগে প্রভাব পড়েছে অনেকটাই। এখনও বনানী গুলশনের নামীদামি হোটেল রেস্তরাঁতে ক্রেতার সংখ্যা আগের চেয়ে অনেক গুণ কম। ইদানীং তা বাড়তে শুরু করেছে। ভয়কে জয় করে দেশি বিদেশি নাগরিকেরা আবারও আসতে শুরু করেছেন। পথঘাটও একদম স্বাভাবিক। স্কুল কলেজ চলছে। তবে, নিয়মিত অঘটনের পরেও পাকিস্তানে চালু থাকলেও ঢাকাতে সাময়িক ভাবে ব্রিটিশ কাউন্সিলের কার্যক্রম স্থগিত রাখা হয়েছে। তবে এ লেভেল এবং ও লেভেলের পরীক্ষা এখন না থাকায় এর তেমন কোনও সরাসরি প্রভাব চোখে পড়ছে না।
নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়-সহ বেশ ক’টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এখনও আলোচনার কেন্দ্রে। রাজীব হায়দারকে যারা হত্যা করেছিল তারা নর্থ সাউথের ছাত্র। তখন বিষয়টি আলোচনায় এলেও গুরুত্ব পায়নি। কিন্তু গুলশন, শোলাকিয়া ও পরে কল্যাণপুরের জঙ্গি ঘাঁটির মধ্যে দিয়ে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে শুধু মাদ্রাসা নয়, গরিবের ঘরও নয়, জঙ্গি তরুণরা সমাজের সব শ্রেণি, সব ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকেই উঠে আসছে। উচ্চবিত্ত পরিবারের নর্থ সাউথ বা মালয়েশিয়ার মনাসে পড়া ছাত্রের সঙ্গে বগুড়ার গ্রামের মাদ্রাসায় পড়া গরিব পরিবারের সন্তানের একত্রিত হওয়ার বিষয়টিও সবাইকে চিন্তায় ফেলেছে। কল্যাণপুরে পাওয়া পেন ড্রাইভের কয়েকটা ছবি থেকে পরিষ্কার, মৃত জঙ্গিরা হয়তো নতুন কোনও অপারেশনের জন্য ফটোসেশন করেছিল।
বাংলাদেশে কয়েক বছরের ব্লগার, লেখক, অধ্যাপক, পুরোহিত-সহ বিভিন্ন মানুষকে খুন করছিল জঙ্গিরা। তবে গুলশন হামলার পরে অনেকটাই বদলেছে সেই পরিস্থিতি। এখন মানুষ পথে নেমেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানিয়ে দিয়েছেন, জঙ্গি দমন না করা পর্যন্ত সরকার পিছিয়ে যাবে না। গুলশন ও শোলাকিয়াতে পুলিশ জীবন দিয়ে প্রমাণ করেছে তারা কতটা উদ্যোগি। প্রধানমন্ত্রীর এই দাবির পাশাপাশি প্রশাসনের তৎপরতাও চোখে পড়ছে। আশা করি, বাংলাদেশে আর কোনও গুলশন হবে না। জনগণের রুখে দাঁড়ানোটা অন্তত সে কথাই বলছে।