বিভ্রান্তি ছাড়া কিছুই দিতে পারেনি বিএনপি জোট, এই মহাবিপর্যয় তারই ফল

বিএনপি এবং ঐক্যফ্রন্ট ভোটবিপ্লবের কথা বলেছিল। আহ্বান জানিয়েছিল, ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে যেতে। ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে গিয়েছেন। ভোটও দিয়েছেন। আর তার ফল, ভোটের প্লাবনে ভেসেছে নৌকা।

Advertisement

অঞ্জন রায়

ঢাকা শেষ আপডেট: ৩১ ডিসেম্বর ২০১৮ ২২:৪১
Share:

বেগম খালেদা জিয়া। ফাইল চিত্র।

বিএনপি এবং ঐক্যফ্রন্ট ভোটবিপ্লবের কথা বলেছিল। আহ্বান জানিয়েছিল, ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে যেতে। ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে গিয়েছেন। ভোটও দিয়েছেন। আর তার ফল, ভোটের প্লাবনে ভেসেছে নৌকা।

Advertisement

কিছু দিন আগে আনন্দবাজারকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন,“আমরাই আসছি”। বাংলাদেশের একাদশ সংসদের নির্বাচনের পর সেটাই সত্যি হয়েছে। শেখ হাসিনাই ফের ক্ষমতায় এলেন। তবে তাঁর জনপ্রিয়তার পারদ যে এতটা উঁচুতে সেটি বোধহয় ধারণাও করতে পারেনি কয়েকদফায় ক্ষমতায় থাকা বিএনপি। পারেনি বলেই তারা উৎসাহ দিয়েছে, ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে যেতে।

বাংলাদেশের এই ভোট-প্লাবনে এবার আর কোনও রাজনৈতিক দল দাড়াতেই পারেনি আওয়ামি লিগের নেতৃত্বের মহাজোটের সামনে। ভোটকেন্দ্রে ঘটে গেছে নীরব বিপ্লব। বাংলাদেশের বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা আনন্দবাজারকে বলেছেন,“এটা ভোট সুনামি।এমন ভোটের জোয়ার কল্পনাতীত।তবে এটিই স্বাভাবিক ছিল।” রেজার মতে, আওয়ামি লিগ কথা দিয়ে কথা রেখেছে। এই ভোট সুনামি তারই ফলাফল। রেজা মনে করেন, জনগণের সামনে বিএনপি বা ঐক্যফ্রন্ট বিভ্রান্তি ছাড়া তেমন কিছু দিতে না পারার ফলাফলেই এই ভোট সুনামি হয়েছে।

Advertisement

ভোটের দিন সকালেও বিএনপি ঐক্যফ্রন্ট নেতারা ভোটের বিষয়ে কিছু আপত্তির কথা মুখে বললেও তাঁদের মনে অনেক আশাছিল।কিন্তু সব হিসেব ওলটপালট করে দিলেন বাংলাদেশের ভোটাররা। উঠল ভোটের জোয়ার। সেই জোয়ার পরিণত হল সুনামিতে।ফলে আওয়ামি লিগ জোটের পক্ষে বাংলাদেশের ৩০০ সংসদীয় আসনের ২৮৮টি আসন। অন্যদিকে, বিএনপি এবং ঐক্যফ্রন্ট মিলে আসনের সংখ্যা ৭ও নির্দলেরা পেলেন ৪টি আসন। প্রার্থীর মৃত্যুর কারণে একটি আসনে নির্বাচন বাকি।

এগারোতম নির্বাচনের প্রচারের শুরু থেকেই ভোটারদের কাছে বিএনপি এবং ঐক্যফ্রন্টের আহ্বান ছিল—ভোটকেন্দ্রে যাবেন,ভোট দেবেন। প্রয়োজনে কেন্দ্র পাহাড়া দেবেন। ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে গিয়েছেন, ভোটও দিয়েছেন।ভোটের ফলাফল এক সংখ্যা বনাম তিন সংখ্যা। কেন এমন হল? প্রশ্নটা ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনউপাচার্য অধ্যাপক আরেফিন সিদ্দিকির কাছে।তিনি বলেন, “বিএনপি-কে যাঁরা ভোট দেন, তাঁরা আসলে সম্পূর্ণ দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন। বিএনপি-র নেতৃত্বে জামাতে-সহ যে কুড়ি দলীয় জোট কামালদের সঙ্গে ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে। কিন্তু, নির্বাচনের দু’দিন আগে কামাল জানান, জামাতে থাকবে জানলে তিনি জোট করতেন না।”

আরও পড়ুন: আওয়ামি প্লাবনে খড়কুটোর মতো ভেসে গেল বিএনপি-জামাত জোট, বাংলাদেশে ইতিহাস

অধ্যাপক সিদ্দিকি আরও বলেন, “এমন বক্তব্যে সমর্থকেরাও বিভ্রান্তিতে পড়ে যান। যার ফলাফল দেখা গিয়েছে ভোটে।নির্বাচন পরবর্তী সময়ে জোটটির পক্ষ থেকে কে প্রধানমন্ত্রী বা বিরোধী দলীয় প্রধান হবেন, তা নিয়েও দেখা দেয় অস্পষ্টতা।যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে বিএনপি এবং ঐক্যফ্রন্টের আলাদা ইশতেহার ঘোষণা ও ঐক্যফ্রন্ট গঠনের পর থেকে জোটটির নেতা এবং বিএনপি নেতাদের সামঞ্জস্যহীন কথাও বিভ্রান্ত করেছে জনগণকে। প্রচারাভিযানের সময়েও সরব ছিলেন না জোটের অনেকে নেতারা। যার প্রভাবে কর্মীদের সাথে দূরত্বতৈরী হয় তাঁদের। যে কারণে এই জোটের সমর্থকদের অনেকেই ভোট দিতে যাননি আর অল্প সংখ্যক সমর্থক ভোটকেন্দ্রে গেলেও সেটা তেমন প্রভাব ফেলতে পারেনি।”

বিএনপির নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ।ফাইল চিত্র

এবারের ভোটে বাংলাদেশে ইস্যু ছিল দু’টি।একদিকে, আওয়ামি লিগ ও মহাজোটের উন্নয়ন এবং মুক্তিযুদ্ধের ধারাবাহিকতার বাংলাদেশ। অন্যদিকে, সদ্য রেজিস্টার বাতিল করা জামাতেকে সঙ্গে নিয়ে বিএনপি এবং ঐক্যফ্রন্টের ইস্যু ছিল, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও খালেদা জিয়ার মুক্তি।ভোটের আগে ঐক্যফ্রন্টবেশ সরব ছিল। প্রায় প্রতিদিনই তারা জনগণকে ভোটকেন্দ্র পাহাড়া দিতে বলেছিল।কিন্তুজামাতের সঙ্গেকেন জোট করা হল তা নিয়েঐক্যফ্রন্টের প্রধান কামাল হোসেনকে গত ১৪ ডিসেম্বর সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে তাঁর আসহিষ্ণু হয়ে ওঠা এবং ‘খামোশ’বলে সাংবাদিকদের থামিয়ে দেওয়ার বিষয়টি সারা দেশে সমালোচনার ঝড় তোলে।পরে এ বিষয়ে কামাল লিখিত বিবৃতি দিয়ে দুঃখপ্রকাশ করলেও বিষয়টির ছাপ থেকে যায় জনতার মনে।

আরও পডুন: উৎসবের ভোটে হিংসার বলি ১৭

বিএনপি-সহ ঐক্যফ্রন্ট তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া জারি রাখার কথা বলেছিল। ওই ঘোষণার একদিন পরঐক্যফ্রন্টের সবচেয়ে বড় দল বিএনপিযে নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করে তাতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে কোন কথাই লেখা হয়নি। একই জোটের দুই ধারা বিভ্রান্ত করে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষকে। অন্যদিকে, তরুণ প্রজন্মের হাসির খোরাক হয়ে ওঠে ঐক্যফ্রন্টের ইশতেহারের একটি ঘোষণা। যেখানে লেখা হয়েছিল,“ সঠিক কক্ষপথে নতুন স্যাটেলাইট প্রেরণ করা হবে”। গত কদিন আগেই বাংলাদেশের সোশ্যাল মিডিয়ায় গুজব ছড়ানো হয়েছিল যে বাংলাদেশের উৎক্ষেপিত স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু-১ এর কোন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।এমন গুজবের পরপরই ঐক্যফ্রন্টের সঠিক কক্ষপথ বাক্যাংশটি বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের কাছে নতুন প্রশ্নের খোরাক জোগায়।

জয়ের পর আওয়ামি লিগ সমর্থকদের উল্লাস। ছবি: পিটিআই।

আর একটি প্রশ্নও সবার মুখে মুখে ছিল। ঐক্যফ্রন্ট এবং বিএনপি যে সরকার গঠন করার কথা বলছিল তাতে প্রধানমন্ত্রী কে হবেন? এর উত্তরে কামাল জানিয়েছিলেন, নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের মধ্যে থেকেই কেউ প্রধানমন্ত্রী হবেন।অন্যদিকে, বিএনপি এই ইস্যুতে স্পষ্ট কোন জবাব দেয়নি।ঐক্যফ্রন্টের আর এক শরিক দলের নেতা কাদের সিদ্দিকির হুঙ্কার ছিল,‘নির্বাচনের পর ২ জানুয়ারি তিনি জেল ভেঙে খালেদা জিয়াকে বের করে আনবেন’। এই গর্জনটিও ভোটারদের মনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।

এবারের ভোটে বাংলাদেশে বড় ফ্যাক্টর ছিলেন তরুণ প্রজন্মের ভোটারেরা।নবম সংসদ নির্বাচনের আগে ২০০৮ সালে ছবি-সহ ভোটার তালিকা প্রণয়নের পর থেকে গত ১০ বছরে বাংলাদেশে তরুণ ভোটার বেড়েছে ২ কোটি ২৫ লাখের বেশি।তাদের অধিকাংশের বয়স এখন ১৮-২৮ বছরের মধ্যে। এই তরুণদের বড় একটি অংশ ছিল শাহবাগ আন্দোলনের সঙ্গে।এঁরা বহু ইস্যুতে আওয়ামি লিগের সমালোচনা করলেও মুক্তিযুদ্ধ তাদের চেতনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল।

আরও পড়ুন: ভোটের ময়দানেও সুইংয়ের কারসাজি, নৌকায় চড়ে বিপুল জয় মোর্তাজার

যে কারণেই সাম্প্রতিককালের বাংলাদেশের দু’টি আলোচিত ঘটনা,কোটা আন্দোলন এবং স্কুলপড়ুয়াদের পথে নেমে আসার সময়েও তাঁদের সবার মুখে স্লোগান ছিল,‘জয় বাংলা’। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সময়ে এই ইস্যুতে বিএনপি-র নীরবতাও একই সঙ্গে ইন্ধন জুগিয়েছিল। একাদশতম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্যবিএনপি-রঘোষিত ইশতেহারে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ইস্যুটি এড়িয়ে যাওয়া বাংলাদেশের বহু তরুণকে আহত করেছে। যার প্রভাব পড়েছে এবারের নির্বাচনী ফলাফলে।

জয়ের পর আওয়ামি লিগের মহিলা সমর্থকদের বিজয় মিছিল। ছবি: পিটিআই।

একদশকের বেশি সময় ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটির প্রধান নেত্রী খালেদা জিয়া দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে কারাগারে।দলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণনেতাও গ্রেনেড হামলা-সহ কয়েকটি মামলায় দণ্ডিত হয়ে লন্ডনে রয়েছেন দীর্ঘ সময়। গ্রেনেড হামলা, দশট্রাক অস্ত্রের চালান, জঙ্গিবাদের সঙ্গে দলটির কয়েকজন নেতার সম্পর্ক, জামাতের রেজিস্টার বাতিলের পরও নিজেদের দলীয় প্রতীক ধার দিয়ে সেই দলটিকে রক্ষার চেষ্টা করা-সহ অনেকগুলো ঘটনার দায়ও বিএনপি-কে এবারের নির্বাচনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলবড়স়ড় প্রশ্নের মুখে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement