পণ্ডিচেরী, অধুনা পুদুচেরি। বললেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে নির্জন সমুদ্র, ফরাসিদের সাজানোগোছানো ছোট্ট শহর আর ঋষি অরবিন্দের স্মৃতি। একটা কাগজে কাটাকুটি খেলার মতো দাগ টানলে যেমন দেখায়, শহরটা অনেকটাই সে রকম। ফরাসি প্রভাব বেশ স্পষ্ট। শোনা যায়, বেলাঙ্গের নামে এক ফরাসি প্রথম এসেছিলেন এখানে। আর শহর বানানোর কাজ শুরু হয় গভর্নর ফ্রাঙ্কোয়েস মার্টিনের আমলে।
পুদুচেরি মানেই শ্রী অরবিন্দ। বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষে কীভাবে ঋষি অরবিন্দ হলেন এ ইতিহাস খুঁজতে হলে আপনাকে অবশ্যই যেতে হবে সাগরপারের এই শহরে। শ্রীঅরবিন্দ জীবনের শেষ চল্লিশ বছর কাটিয়েছিলেন এই পুদুচেরিতেই। যখন তিনি প্রথম আসেন তখন পণ্ডিচেরী ছিল শ্মশান। আর রাজনৈতিক বন্দিদের আখড়া।
পণ্ডিচেরীতে অরবিন্দ প্রথম উঠেছিলেন শঙ্করা চেট্টিয়ারের বাড়িতে। কয়েক বছর আগে দক্ষিণ ভারত পরিক্রমার সময়ে সেই বাড়িতে ছিলেন স্বামী বিবেকানন্দও। এখানেই রাজনৈতিক প্রচারে আসা পল রিসারের সাথে আলাপ হয় অরবিন্দের। পল রিসারের স্ত্রী 'মীরা'র সঙ্গে আলাপ সেই সূত্রে। এই মীরাই পরে প্রসিদ্ধ হন 'শ্রীমা' নামে।
ঋষি অরবিন্দের বাসভবনে মীরাই গড়ে তোলেন শ্রী অরবিন্দ আশ্রম। তৎকালীন পণ্ডিচেরীর একাধিক বাড়ি কিনে নেন শ্রীমা। বাড়িগুলি দেখলেই চেনা যায় তার বিশেষ ছাই রঙের কারণে। তার কোনওটিতে রয়েছে আশ্রমের ছাপাখানা,অফিস কিংবা অতিথিশালা।
এই আশ্রমে চিত্তরঞ্জন দাশ এক বার গিয়েছিলেন অরবিন্দকে ফিরিয়ে নিয়ে আসতে। এবং ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে পুনরায় যোগদানের অনুরোধ করতে। অরবিন্দ ফেরেননি। কারণ তিনি তখন শ্রী অরবিন্দ, ঋষি অরবিন্দ। বিপ্লবী অরবিন্দ নন!
স্বাধীন পুদুচেরির প্রধান আকর্ষণ এই অরবিন্দ আশ্রম এবং অরবিন্দের সমাধি মন্দির। ১৯৫০-এর ৫ ডিসেম্বর মহানির্বাণ লাভ করেন শ্রীঅরবিন্দ। আশ্রমেই তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়। প্রতিদিন সকালে ফুল দিয়ে সাজানো হয় শ্বেত পাথরের সমাধি বেদী। তাতে মাথা ঠেকানোর রেওয়াজ রয়েছে আজও। আশ্রম জুড়ে সব সময়ে বিরাজ করে অপার এক শান্তি।
শ্রীঅরবিন্দের মৃত্যুর পর আশ্রমের দায়িত্ব নেন শ্রীমা। ১৯৭৩-এ ৯৫ বছর বয়সে প্রয়াত হন তিনি। তাঁকেও সমাধিস্থ করা হয় এই শ্রীঅরবিন্দ আশ্রমে।
আশ্রমে শ্বেতপাথরের সমাধি বেদির উপর জ্বালানো ধূপের গন্ধে আমোদিত হন শত শত পর্যটক। তার সামনে ধ্যানে বসে শ্রদ্ধা জানান ভক্ত ও দর্শনার্থীরা। শহরের একেবারে কেন্দ্রে এই অরবিন্দ আশ্রম এবং সমাধি মন্দির। প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১২টা এবং দুপুর ২ টো থেকে সন্ধ্যে ৬ টা অবধি সমাধি মন্দির খোলা থাকে।
অরবিন্দ আশ্রমে দেখা মেলে অরবিন্দের পড়ার ঘর, লাইব্রেরি ছাড়াও সে সময়ের আরও বেশ কিছু সামগ্রীর, যা অত্যন্ত যত্ন নিয়ে সংরক্ষণ করা হয়েছে। যে ঘরে শ্রী অরবিন্দ সিদ্ধিলাভ করেছিলেন সেটি বিশেষ অনুমতি নিয়ে দেখা যায়। শ্রীঅরবিন্দ ও শ্রীমার জন্মদিন, তাঁদের তিরোধান দিবস, পূর্ণ সিদ্ধিলাভের বিশেষ দিনগুলিতে অরবিন্দ আশ্রমে চলে নানা অনুষ্ঠান।
কী ভাবে যাবেন: হাওড়া থেকে পুদুচেরি ট্রেন রয়েছে। কাছের বিমানবন্দর পুদুচেরি। সড়কপথে চেন্নাই থেকে পুদুচেরির দূরত্ব প্রায় তিন ঘণ্টার মতো।