দুর্গাপুজো বাঙালির কাছে কতখানি তা ভাষায় বোঝানো কঠিন। ধমনীতে বয়ে চলা রক্ত স্রোতের মতোই দুর্গাপুজোর আনন্দ স্রোত বাহিত হয়, সময় স্বাক্ষী প্রবল দুর্ভিক্ষে, অসময়ে সামান্য সংকুলানেও মানুষ মা দুর্গার আরাধনা করেছেন, আসলে বাঙালির দুর্গাপুজোর বোধটি মহিষাসুর মর্দিনীর চেয়েও বেশি ঘরের মেয়ের সন্তানসন্ততি নিয়ে বাপের বাড়ি আসা।
এক গভীর আত্মীয়তা আছে এই পুজোটির সঙ্গে... না হলে, কুখ্যাত মান্দালয় জেলে গুটিকয় বাঙালি রাজবন্দির দ্বারা বিনা পুরোহিতে কেবল সদিচ্ছা ও ঐকান্তিক চাওয়ায় দুর্গাপূজা হয়! প্রখ্যাত সাহিত্যিক হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায় এ কথা লিপিবদ্ধ করেছেন। শৈশবে মান্দালয় জেলের তৎকালীন সুপারের সঙ্গে জেল ভ্রমণকালে পূজারত অবস্থায় সুভাষচন্দ্রকে দেখেছিলেন। সময়কাল ১৯২৫। তাঁর কথায়, ‘‘পুরোহিত ছিল কিনা মনে পড়ছে না। গৌরবর্ণ, সৌম্য চেহারার একটি প্রাণবন্ত যুবক মন্ত্রোচ্চারণ করে চলেছেন। মাঝে মাঝে অঞ্জলি থেকে কুসুম ছুঁড়ে দিচ্ছেন দেবীর চরণে। আমরা পিছনে গিয়ে দাঁড়ালাম। কোথাও সামান্য শব্দ নেই। সান্ত্রীরা পর্যন্ত সার দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক পাশে। সুপার বাবার কানে মৃদুস্বরে বললেন, যিনি মন্ত্র পড়ছেন উনিই সুভাষচন্দ্র বসু।’’ (স্মৃতি-বিস্মৃতি, রাখাল বেণু, শারদীয়া সংখ্যা, ১৩৮৯)
অবন ঠাকুর অর্থাৎ অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর স্মৃতিচারণায়, ধরা পড়ে আস্ত শৈশব। সেখানে জুতোর মাপ নিতে আসা চিনা মানুষ। কিংখাপের থানের পুটুলি আর ফিতে নিয়ে আসা দর্জির দল। আতর বেচতে আসা ইহুদি গ্যাব্রেল সাহেবের কথা আসত। দুর্গাপুজো এমনই ভাব যে, চাকর-বাকর বোধ উবে যেত। পার্বণীর টাকা পেয়ে চাকরও মালিক পুত্রের জন্য বেলি ফুল কিম্বা খেলনা নিয়ে আসতেন। মায়ের আগমনে সবাই এক হয়ে যেতেন।
তাঁর কথায়, ‘‘বড় দা (গগনেন্দ্রনাথ) পার্বণী পেতেন এক টাকা, মেজ দা (সমরেন্দ্রনাথ) আট আনা আর আমি পেতুম চার আনা।’’
নবমীর দিন কয়লাহাটায় মস্ত যাত্রা বসত। ফরাসে গুরুজনেরা, দো’তালা টানা বারান্দার খড়খড়ি দেওয়া অংশে অন্তঃপুরবাসিনীরা, বৈঠকখানার বারান্দায় ছোকরাবাবুরা, বাচ্চারা এক কোণে। যাত্রায় প্যালা অর্থাৎ বকশিস দেওয়া হত রুমালে বেঁধে। অধিকারী পয়সা বের করে আবার ফেরত দিতেন রুমাল। তেলবাতির ফরাশ এসে বাতিতে তেল ঢেলে যেত। সে এক মস্ত কর্মযজ্ঞ!
সিমলের মহেন্দ্র দত্ত (স্বামীজির কনিষ্ঠ ভ্রাতা) এর স্মৃতিচারণায়, ‘‘শাক্ত বাড়ি সিংহারূঢ়া দেবী আর গোঁসাই ঘরে অশ্বারূঢ়া। বড় বাজারে কলকাতার সব চেয়ে ছোট্ট প্রতিমাটি দেখতুম। আমরা কইতুম পুতুল দুর্গা। তখনও ডাকের সাজ আসেনাই, মাটির গহনায় মা অপরূপা। নীল মাখানো কোরা কাপড় পরে ঢুলির সাথে নাচ ছিল বড় আমোদের...।’’
এ তো গেল কলকাতার পুজো।
প্রখ্যাত প্রতিবেদক, ন্যাশানাল গার্ডিয়ানের সম্পাদক শ্রী শশীভূষণ মুখোপাধ্যায় তার শৈশবের (১৮৭০ আনুমানিক) একেবারেই গন্ডগ্রামের দুর্গাপুজোর ছবিটি ধরেছেন।
‘‘ পরবাসী মানুষরা ঘরে এলেই তৃতীয়া, চতুর্থী থেকে কাপড় কেনার ধূম পড়ত। সিমলা, শান্তিপুর, ফরাসডাঙ্গা বাগেরহাটের তাঁতিরা ব্লু দেওয়া কাপড় আনত। গ্রামের পূজায় জাতি ধর্ম নির্বিশেষে যেই আসত, সরায় করে চিড়া, মুড়কি, চারটি রসকরা (নারিকেল ও চিনির সন্দেশ) দেওয়া হত। ব্রাহ্মণ ভোজনে এক একজন ব্রাহ্মণ ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ রকমের ব্যঞ্জন, মৎস্য, পায়েসের পরেও দুইসের সন্দেশ, এক সের দধি খাইতে পারতেন। শুধু ব্রাহ্মণ না কাঙালি ভোজনেও কেউ কার্পণ্য করত না। উল্টো আশে-পাশের গৃহ হতে তরিতরকারি রেঁধে মানুষ দিয়ে যেত। পল্লীগ্রামের আনন্দোৎসবের বৈশিষ্ট্য ছিল এমনধারাই... বিজয়ার পরে জাতিধর্ম, শত্রুমিত্র নির্বিশেষে সবাই সবাইকে আলিঙ্গন করতে পারত। মায়ের আগমন এতখানি তরল করে দিত সর্বস্তরের মানুষকে। বাঙালির কাছে মা বড় আপন। তার প্রাণের আকুতি, ” মাগো, সম্বৎসর স্বামী, পুত্রদিগকে বাঁচাইয়া রাখিও, আবার যেন আগামী বছর এমনি সময় তোমাকে দেখতে পাই।’’
আনন্দবাজার পত্রিকার পত্তনি সদস্য এবং দেশ পত্রিকার প্রথম সম্পাদক বঙ্কিমচন্দ্র সেন ভারী সুন্দর একটি কথা বলেছেন, ‘‘ শ্রীরামচন্দ্রের দুর্গোৎসব অকালবোধন, কিন্তু প্রভুর এই দুর্গোৎসব (মাতৃ পূজা) সর্বকালীন এবং সর্বজনীন।’’
তথ্যসূত্র: দশপ্রহরণধারিণী (প্রবন্ধ সংকলন, সংকলক: প্রশান্ত সেন, প্রকাশক: বইদেশিক)
এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের একটি অংশ।