অলঙ্কার পরিহিত মা দুর্গা (বাঁ), অলঙ্কারহীন প্রতিমা (ডান)
অলঙ্কার নেই প্রতিমার গায়ে। পুরুলিয়ার নামোপাড়ার চট্টোপাধ্যায় পরিবারের পুজোয় এ ভাবেই ধরা দিল প্রতিবাদের ছায়া।
আরজি করের ডাক্তারি পড়ুয়ার ধর্ষণ-হত্যার ঘটনায় উৎসববিমুখ বাঙালিদের একাংশ। বেরিয়ে এসেছে পিতৃতন্ত্রের নৃশংসতার কুৎসিত চেহারা। এদিকে, বছরের এ সময়টায় দেবী পুজোয় মুখর হয় সারা বাংলা। অথচ মেয়েদের উপর নারকীয় অত্যাচারের পরে দেবীর পুজোয় হয়তো শামিল হয় অধরা অপরাধীও। তারই তীব্র প্রতিবাদ জানাতে উদ্যোগী পুরুলিয়ার এই পরিবার।
তাঁরা উৎসবে নেই। কিন্তু পুজোয় আছেন। তাই মায়ের পুজো থেকে বিরত থাকবেন না। অথচ তারই মাধ্যমে বিদ্রোহে কথা বলবেন। সেই সিদ্ধান্ত থেকেই দেবী প্রতিমার চিরাচরিত রূপে এ বছর বদল ঘটিয়েছেন চট্টোপাধ্যায় পরিবারের সদস্যেরা। একচালা ডাকের সাজে অলঙ্কারমণ্ডিত দুর্গাকেই প্রতি বছর বরণ করতেন সকলে। কিন্তু এ বার সোনা-রূপার কোনও গয়নাই পরানো হয়নি প্রতিমাকে। সালঙ্করা নন, এ পুজোয় দেবী দুর্গা অলঙ্কারহীন।
মুঘল আমলে শুরু হয় এই পুজো। মন্দির স্থাপন হয় ১৯৩০ সালে। সেই থেকে এক ভাবেই প্রতিমাকে দেখতে অভ্যস্ত ছিলেন সবাই। কিন্তু এই প্রথম বার প্রথা ভেঙে রীতিনীতিতে পরিবর্তন ঘটল। মা দুর্গা দেখা দিলেন বিদ্রোহী রূপে। গায়ে তুললেন না অলঙ্কার। পরলেন কেবল লালপেড়ে সাদা শাড়ি। যা আগে কখনও ঘটেনি।
পরিবারের সদস্য রাজর্ষি চট্টোপাধ্যায় আনন্দবাজার অনলাইনের কাছে এই পুজোর ইতিহাস তুলে ধরেন। রাজা প্রতাপাদিত্যের সেনাপতি ছিলেন বংশের পূর্বপুরুষ শঙ্কর চট্টোপাধ্যায়। বংশধররা এই পুজো করে চলেছেন এখনও। আকবর এবং জাহাঙ্গীর বারো ভুঁইয়ার প্রতাপাদিত্যকে পরাজিত না করতে পেরে রাজা মান সিংয়ের সাহায্য নেন। তাঁর সহায়তায় যুদ্ধজয় করে প্রতাপাদিত্য এবং শঙ্কর চট্টোপাধ্যায়কে বন্দি করে তাঁদের সেনাবাহিনী। পথে বারাণসীর কাছে প্রতাপাদিত্য মৃত্যুবরণ করেন। একা পড়ে যান শঙ্কর। আগরা ফোর্টের অন্ধকার কারাগারে বন্দি করে রেখে দেওয়া হয় তাঁকে। দিনের পর দিন চলে যায়। তর্পণের সময় এলে শঙ্কর যমুনা নদীতে তর্পণের আর্জি জানান। রাজারা তাঁর অনুরোধ রাখেননি। প্রতিবাদে অনশনে বসেন শঙ্কর।
অনশনের খবর পেয়ে আকবরের স্ত্রী রানি যোধাবাঈ তাঁর সঙ্গে দেখা করেন। তিনি বলেন, ‘‘ব্রাহ্মণের সন্তানকে এ ভাবে বন্দি করে রাখা যাবে না। বরং আমাদের প্রাসাদের মন্দিরে ওঁকে পুজো করতে দেওয়া হবে।’’ পরে শঙ্করের সঙ্গে কথা বলে তাঁকে জায়গীর দেওয়া হয়। তখনই বারাসতে এই পুজোর সূত্রপাত।
রাজর্ষির কথায়, ‘‘এই পুজোরই ধারা বহন করছে আমাদের পরিবার। বর্ধমানে সেই পুজো হয়। কিন্তু আমাদের পরিবারের সকলে আইনজীবী বলে বর্ধমান থেকে পুরুলিয়ায় চলে যান প্র্যাক্টিস করার জন্য। তখন পুরুলিয়া ছিল বিহারের অংশ। বিহার তখন বেশ উন্নত একটি জায়গা। পুরুলিয়াতেই এখন এই পুজো হয়। ১০০ বছরের পুরনো ইতিহাস তার। আমার প্রপিতামহ নীলকণ্ঠ চট্টোপাধ্যায় ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং আইনজীবী। আমাদের পুরনো বাড়িতে নেতাজি সুভাষচন্দ্রের পা পড়েছে। শোনা যায়, কোনও এক অষ্টমীতে এই পুজোয় দেবীর দর্শন করে গিয়েছিলেন নেতাজি।’’
কিন্তু এ বছর আরজি করের ঘটনার প্রতিবাদে সমস্ত প্রথায় বদল আনা হয়েছে। রাজর্ষি জানালেন, সোনা-রূপার প্রচুর অলঙ্কার দুর্গা, সরস্বতী এবং লক্ষ্মীকে পরানো হয়। এ বার তার মধ্যে একটিও প্রতিমাকে পরানো হয়নি। লালপেড়ে সাদা শাড়িতেই নিরাভরণ রূপে তাঁদের পুজো করা হচ্ছে।
রাজর্ষির কথায়, ‘‘আমাদের এই সিদ্ধান্ত কোনও দলীয় রাজনীতির অংশ নয়। শুধুমাত্র প্রতিবাদের জন্যেই করা। খুব পুরনো মন্দির আমাদের। গ্রামের মানুষের এখানকার মা দুর্গার প্রতি অটুট বিশ্বাস। আমার মনে হয়েছে বারবার, যদি মায়ের সত্যিই প্রাণ থেকে থাকে, তা হলে নিশ্চয়ই তিনিও অত্যন্ত ব্যথিত হয়েছেন এই ঘটনায়। সালঙ্কারা হতে নিশ্চয়ই তারও মন চাইবে না। সেই থেকেই পরিবারের সকলে মিলে এই সিদ্ধান্ত।’’
এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের একটি অংশ।