ঢাকের আওয়াজ। নতুন জামাকাপড়ের গন্ধ। কার ক’টা ড্রেস হল, গোনাগুনতি করা। দৌড়ে গিয়ে বারান্দার কোণ থেকে দুর্গা ঠাকুরের মুখ দেখার চেষ্টা। বন্ধুদের সঙ্গে ঘোরা। মাসি-পিসিদের আদর। সেই শর্তহীন ভালবাসা। আর অবশ্যই ঠাকুরমার হাতের তৈরি পাউরুটির মিষ্টি আর নিমকি। ছোটবেলার পুজোয় এ সব কিছুই মাখামাখি করে ছিল। সে সব আন্তরিক দিনগুলো আর ফিরে আসবে না। সময় বদলেছে, তবে সেই স্মৃতিগুলো এখনও ভুলিনি।
পুজোর সময়েও রাত করে বাড়ির বাইরে থাকাটা বারণ ছিল ছোটদের। যেখানেই যাই না কেন, রাত সাড়ে ৮টার মধ্যে বাড়িতে ঢুকতেই হবে। এমনটাই বরাবরের নিয়ম ছিল আমাদের বাড়িতে। পুজোর রাতগুলোতেই ঠাকুর দেখে তাই তড়িঘড়ি বাড়ি ফিরে আসতে হত।
ষষ্ঠীর দিনটা ছিল আমার কাছে সবচেয়ে আনন্দের। সে সময়ে আমাদের স্কুলে পরীক্ষা হয়ে পুজোর ছুটি পড়ত। ষষ্ঠীতে ঢাকের আওয়াজে ঘুম ভেঙে যেত। তখনও বেশ ভোর। মনে আছে, দুর্গা পুজো শুরু হওয়ার আগে পাড়ার প্যান্ডেলে প্রতিমা বয়ে নিয়ে আসা হত। সেই ভোরবেলাতেই বারান্দার এককোণে ছুটে গিয়ে দুর্গার মুখ দেখার চেষ্টা করতাম। পুরোটা যদিও দেখা যেত না। তবে তাতেই বেজায় আনন্দ। প্যান্ডেলে প্রতিমার মুখ ঢাকা থাকত। তার ফাঁক দিয়েও দুর্গা ঠাকুরের মুখ দেখার চেষ্টা করতাম আমি।
আরও পড়ুন: ঘট আর ঘটার লড়াই দেখে মা মুচকি হাসলেন!
ভোরবেলাতেই বারান্দার এককোণে ছুটে গিয়ে দুর্গার মুখ দেখার চেষ্টা করতাম।
ষষ্ঠীর সকালে উঠে মনে হত, এই শুরু দুর্গা পুজোর! সামনের চার দিন ধরে দেদার মজা, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে ঘোরাঘুরি, খাওয়াদাওয়া। পুজো আসার আনন্দ। পিসি-পিসে, মাসি-মেসোদের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া। আমাদের বাড়িতে আত্মীয়স্বজনদের আসা।
সপ্তমী আবার আমার কাছে দুর্গাপুজোর ‘সেকেন্ড বেস্ট ডে’। তবে গ্ল্যামারাস! একে তো পরের দিন অষ্টমী। তার আগে যেন পুরোদমে ড্রেস রিহার্সাল চলত সপ্তমীতে। নতুন জামা পরে বন্ধুবান্ধব বা কাজিনদের সঙ্গে ঘোরাঘুরি। আড্ডা দেওয়া। মণ্ডপে নতুন চাউনির চোখে পড়া। সব কিছুই পুজোর জামার মতো নতুন গন্ধমাখা।
অষ্টমীতে অবশ্যই নতুন শাড়ি। সকাল সকাল উঠে স্নান করে নতুন শাড়িতে অঞ্জলি। তার পর প্রসাদ খাওয়া। আর রাতে দুর্দান্ত সাজতে হবে— এমনটা মনে মনে ঠিক করে নেওয়া। বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে যে একেবারে একা একা ঘুরতে পারতাম, ছোটবেলায় তেমনটা হত না। সঙ্গে অবশ্যই এক জন বড় কেউ অভিভাবক হিসেবে থাকতেন। কখনও বাবার বন্ধু, তো কোনও সময়ে পিসতুতো দাদা। অষ্টমীর রাতে গাড়ি করে সবাই মিলে ঠাকুর দেখতে বেরনো। মনে আছে, দক্ষিণ কলকাতায় ত্রিধারা, সুরুচি সঙ্ঘ, চেতলা অগ্রণীর মণ্ডপে যেতাম। বন্ধুদের সঙ্গে সারা রাত ধরে ঠাকুর দেখার প্রশ্নই নেই। বরং বড়দের সঙ্গেই সকলে মিলে যাওয়া হত। তবে বন্ধুদের সঙ্গে একেবারেই যে বেরোতাম না, তা নয়। বাড়িতে মিছিমিছি বলতে হত, আমাদের সঙ্গে অমুক থাকবেন বা তমুকও যাবেন। যাতে মা-বাবা চিন্তা না করেন।
আস্তে আস্তে সপ্তমী পেরিয়ে অষ্টমীও শেষ হয়ে যেত। নবমীতে আমার সবচেয়ে দুঃখ হত। আর মাত্র একটা দিন। দশমী গেলেই তো শেষ হয়ে যাবে দুর্গাপুজো। পুজোর শেষ রাতে যখন একটা একটা বাতি নিভে যেত, সে সময়টায় মন ভার হয়ে উঠত। আস্তে আস্তে এক একটা করে মণ্ডপও ফাঁকা হয়ে যেত।
তবে দুর্গাপুজোর চার দিন বেশ মজা করতাম আমরা। আমরা মানে বাড়ির বড়রা থেকে শুরু করে বন্ধুবান্ধব, কাজিনরা। বন্ধুদের সঙ্গে ফুচকা-আলুকাবলি খাওয়াটা এখনও খুব মিস করি। আরও একটা জিনিস মিস করি। তা হল, ঠাকুরমার হাতে তৈরি স্পেশাল মিষ্টিগুলো। মনে আছে, পুজোর সময় আমার ঠাকুরমা পাউরুটির মিষ্টি বানাতেন। সঙ্গে তৈরি করতেন নিমকি। সেগুলোর জন্য মুখিয়ে থাকতাম।
ছোটবেলার পুজো ছিল আন্তরিক ।
দশমীতে পাড়ায় গিয়ে বড়দের প্রণাম করা চলত। দেদার মিষ্টিমুখ করা তো হতই। সঙ্গে উপরি পাওনা ছিল উপহার। আর অবশ্যই টাকা হাতে পাওয়া। বড়দের পায়ে হাত দিয়ে প্রণামের পর জুটত টাকা। ভাইফোঁটার সময় তো প্রণাম করলেই ছোটদের সকলের হাতে হাতে দু’টাকার চকচকে নোট দিতেন ঠাকুরমা। সে সব কথা এখনও মনে পড়ে।
দুর্গাপুজোর সময়ে এক বার বেশ মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। উটি থেকে পঞ্চমীর দিন মিঠুন চক্রবর্তী ফোন করেছেন আমাকে। কী ব্যাপার? না, ষষ্ঠীতে ‘জখমি সিপাহি’ শ্যুটিংয়ের জন্য উটিতে যেতে হবে। পুজোতে কলকাতায় থাকতে পারব না- শুনেই মন ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছিল। তখন আমি ইন্ডাস্ট্রিতে নতুন। ফলে মুখ বেজার করে যেতে হয়েছিল উটি। সঙ্গে বাবাও গিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, সিনেমাও করবে আবার পুজোয় বাইরে যাবে না! তা তো হতে পারে না। যাই হোক! মনখারাপ হলেও উটিতে গিয়েছিলাম সে বার পুজোয়। তবে শ্যুটিংয়ের ফাঁকে উটিতে একটা পুজোর মণ্ডপে গিয়ে ঠাকুরও দেখে এসেছিলাম।
আরও পড়ুন: সন্ধিকাল
ছোটবেলার পুজো কী আন্তরিক ছিল। এত গ্যাজেট, টেকনোলজির বাড়বাড়ন্ত ছিল না বটে। তবে খুব ইনোসেন্ট ছিল। এক বার পুজোয় একটা মজার কাণ্ডও হয়েছিল। বন্ধুদের গ্রুপে একটি ছেলের আমার প্রতি ‘ক্রাশ’ ছিল। ঠিক হয়েছিল, পুজোয় এক বন্ধুর বাড়িতে পার্টি হবে আর তাঁর সঙ্গে আমার কথা হবে। সে বয়সে বেশ থ্রিলিং ব্যাপারস্যাপার। তবে সে সব মাটি হল। যে দিন পার্টিতে যাওয়ার কথা, তার আগের দিন রেস্তোরাঁয় গিয়ে দেদার প্রন খেয়েছিলাম। পরের দিন একেবারে ফুড পয়জন। ব্যস! সেই ঘটনার সেখানেই ইতি। সে বার ঠিক করেছিলাম, পুজোর সময়ে আর কখনও প্রন খাব না!
ছোটবেলার পুজোর সময়কার কথা বলতে গিয়ে কত কিছুই মনে পড়ছে। সঞ্জয়, আমার হাজব্যান্ডের সঙ্গে ওঁর মারুতি গাড়িতে করে ঘোরা, পিসতুতো দিদির সঙ্গে সময় কাটানো, গোলপার্কে পিসির বাড়ি যাওয়া, গড়িয়াহাটে বা পার্ক স্ট্রিটে গিয়ে ড্রেস কেনার জন্য মায়ের কাছে ঝুলোঝুলি করা। এক বার তো ড্রেস কিনে দেওয়ার বায়না করতে গিয়ে মায়ের আঁচল ধরে রাস্তাতেই বসে পড়েছিলাম। সে সব স্মৃতি এখনও ভেসে আসে। মনে আছে, এক বার পুজোয় টাইট জিন্স পরার খুব চল হয়েছিল। বায়না ধরলাম, আমারও জিন্স চাই। ডেনিমের কাপড় কিনে বানানো হল টাইট জিন্স। তবে এতটাই টাইট হয়েছিল সেই জিন্স, যে শত চেষ্টাতেও তাতে ঢুকতে পারলাম না। সব ইচ্ছেই মাঠে মারা গেল। এ সব টুকরো টুকরো কথা মনে রয়ে যায়।
প্রতি বছরের চেয়ে এ বারের পুজো একেবারে আলাদা। একে তো অতিমারির জেরে প্রায় ঘরবন্দি কমবেশি আমরা সকলেই। তায় মহালয়ার প্রায় এক মাস পরে পুজো। তবে তার মধ্যেও নিউ নর্ম্যালের রীতি মেনে চলতে হবে আমাদের সকলকে। করোনার ভ্রূকুটি এড়িয়ে সুস্থতা বজায় রেখে পুজোতেও আনন্দ করুন সকলে। তবে যতই নিউ নর্ম্যালের আধুনিকতা ঘিরে ধরুক না কেন, ছোটবেলাকার সেই শর্তহীন আদরমাখা পুজোর আনন্দ আর ফিরে পাওয়া যাবে না। সেই অতি সাধারণ আন্তরিকতারও ছোঁয়াও মুছবে না আমার মন থেকে!
অলঙ্করণ: তিয়াসা দাস।