Dashamahavidya

সতীর থেকে কী ভাবে সৃষ্টি হল দশমহাবিদ্যার? চিনে নিন দেবীর দশটি রূপ

মেয়ে সতীকেও এমন স্বামী বাছার জন্য চিরতরে ত্যজ্য করেছেন। তাই নিজ গৃহে বিশাল যজ্ঞের আয়োজন করেও নিজের মেয়ে- জামাইকে ডাকেননি। এ দিকে বাপের ঘর মেয়েদের বরাবরই ভীষণ প্রিয়।

Advertisement

তমোঘ্ন নস্কর

শেষ আপডেট: ০৭ অক্টোবর ২০২৪ ১২:৪৩
Share:

ছবি: সংগৃহীত

সকল প্রজাতি পালনের দায়িত্ব পেয়ে দারুণ অহঙ্কারী হয়ে উঠলেন দক্ষ। তিনি ব্রহ্মার উত্তরসূরি হয়ে প্রজাপতি অর্থাৎ সকল প্রজাদের প্রভু বা পতি হওয়ার অধিকারী হয়েছেন। অর্থ আর যশের মোহে অন্ধ দক্ষ জামাতা শিবকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেন। উপার্জনের নাম নেই, শ্মশানে-মশানে ভূতের মতো কিম্ভুৎকিমাকার নোংরা সব স্যাঙাৎ নিয়ে সারাদিন ঘুরে বেড়ায়!

Advertisement

মেয়ে সতীকেও এমন স্বামী বাছার জন্য চিরতরে ত্যজ্য করেছেন। তাই নিজ গৃহে বিশাল যজ্ঞের আয়োজন করেও নিজের মেয়ে- জামাইকে ডাকেননি। এ দিকে বাপের ঘর মেয়েদের বরাবরই ভীষণ প্রিয়। সতী ভাবলেন, না-ই বা ডাকলেন বাবা! তিনি গিয়ে দাঁড়ালে বাবা কি তাকে উপেক্ষা করতে পারবেন? যেমন ভাবা তেমন কাজ! মা চললেন পিতৃগৃহে। কিন্তু তার আগে মহাদেবের কাছে গেলেন।

এ দিকে মহাদেব অনুমতি দেবেন না কিছুতেই। মা যতই বলেন, "আসছি...", মহাদেব শান্ত নির্লিপ্ত হয়ে বসে থাকেন। শেষে মা ক্রোধে অগ্নিশর্মা। মহাদেবের এত সাহস হয় কী করে যে তিনি স্বয়ং আদ্যাকে অনুমতি দেবেন? মহাদেব যেইখানটিতে বসেছিলেন, তার দশ দিক হতে মা ভিন্ন রূপে প্রকট হলেন। কখনও মা ভয়ঙ্করী, তো কখনও কোমলা। মুহুর্মুহু ভিন্ন ভিন্ন রূপ পরিগ্রহ করে মহাদেবকে এক মুহূর্তে মূর্ছিত এবং পর মুহূর্তে শান্ত করতে লাগলেন!

Advertisement

নারদ মুনি এসে মূর্ছিত মহাদেবকে আবিষ্কার করেন এবং বীণার টঙ্কারে তাঁর জ্ঞান ফেরান। ত্রস্ত মহাদেব পরমশ্রদ্ধায় আদ্যাশক্তির মহাবিদ্যাতত্ত্বসার তাঁকে শুনিয়ে চললেন, " আমি সকলি বুঝেছি। এ তাবড় বিশ্বের সকল ভয়ঙ্করী, মহারৌদ্রবিনাশিনী সতী। আবার পরমেশ্বরী, স্নেহময়ী মা-ও সতী। মা শক্তিই আদি এবং অন্ত। তাই মাকে অনুমতি দেওয়ার ক্ষমতা আমার নাই। মায়ের এই জগৎব্যপ্ত দশ রূপ হল দশমহাবিদ্যা। এ ভাবেই দশরাশিকে নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন আদ্যা।"

দেবীর সেই দশমহাবিদ্যা রূপ হল:

কালী — তারা — ষোড়শী — ভুবনেশ্বরী —ভৈরবী — ছিন্নমস্তা — ধূমাবতী — বগলা — মাতঙ্গী — কমলা।

১. কালী

দশমহাবিদ্যার প্রথম রূপ কালী। সর্বসংহারকারিণী, জন্ম ও শক্তির দেবী। কালীকুল সম্প্রদায়ের সর্বোচ্চ দেবী। শুম্ভ -নিশুম্ভ বধার্থে দেবীর জন্ম।

২. তারা

মা তারা দশ মহাবিদ্যার দ্বিতীয় রূপ। মা চতুর্ভুজা। কপোলপাত্র, খর্পর , নীলপদ্ম এবং খড়গ হস্তে জ্বলন্ত চিতামধ্যে শবের উপরে পা রেখে দাঁড়িয়ে আছেন। জটাজুটধারিণী মা সর্পালঙ্কার পরিহিতা ও স্ফীতোদরা।

মা তারাই সমুদ্র মন্থন কালে ভীষণ হলাহল পান করে, আচ্ছন্ন মহাদেবকে আপন স্তন্যসুধা পান করিয়ে তাঁকে তথা তাবড় জগতকে উদ্ধার করেছিলেন। ব্রহ্মাণ্ডের বোধ, শক্তি ও জীবন-মৃত্যুর মহাশূন্যের প্রতীক।

৩. ষোড়শী

মা তারার দর্শনের পর মহাদেবের সামনে এলেন অপরূপা ষোড়শী যুবতী হয়ে। উদীয়মান সূর্যের মতো লাল তাঁর গাত্রবর্ণ। দেবী চতুর্ভুজা, ত্রিনয়না, চারহাতে পাশ, অঙ্কুশ ও ধনুর্বাণ ধারণ করে আছেন। প্রস্ফুটিত রক্তপদ্মে মা অধিষ্ঠিতা। পদ্মটি আধশোয়া মহাদেবেরই নাভি হতে উদ্ভূত!

মা রজঃগুণ প্রধানা ও সত্ত্বগুণাত্মিকা অর্থাৎ মায়ের এই রূপ কল্যাণীয়া ও ভক্তপ্রাণা। এই রূপ বিবিধ নাম তথা ত্রিপুরসুন্দরী, ত্রিপুরা ভৈরবী নামে পূজিতা।

৪.ভুবনেশ্বরী

মায়ের চতুর্থ অভয়প্রদা রূপটি হল ভুবনেশ্বরী। ভুবন অর্থাৎ পৃথিবীর যাবতীয় পার্থিব জিনিসের যে শক্তি, তা হলেন তিনি। দান, ধ্যান, জীবে দয়া প্রভৃতি শুভ কর্মের যে শক্তি, তা মাতা ভুবনেশ্বরীর অধীন।

মা ত্রিনয়নী, মস্তকে চন্দ্র, স্তন্য হতে স্নেহসুধা ক্ষরিত হচ্ছে প্রতিক্ষণ। চারিহস্তে বর, অভয়, পাশ, অঙ্কুশ ধারণ করে আছেন। ত্রিপুটা, জয়দুর্গা, বনদুর্গা, কাত্যায়নী, মহিষঘ্নী, দুর্গা, শূলিনী, মেধা, রাধা ইত্যাদি বিবিধ নামে তাঁর প্রকাশ।

৫. ভৈরবী

মা ভৈরবী পঞ্চম মহাবিদ্যা। ইনিও মা ষোড়শীর প্রতিবিম্ব মূর্তি।

ভৈরবের গূঢ় হল আত্মশক্তি। দেবী ভৈরবী শিবের হৃদয় স্থিতা নারীশক্তি ত্রিপুরাভৈরবী । মা এই রূপে জীবের দুঃখ নাশ করেন। মা রক্তাভা, আবার পরিধানেও রক্তবর্ণের পট্টবস্ত্র । পদ্মাসনে মাথায় চন্দ্র ধরে, বসে আছেন মা। চার হাতে জপমালা, পুস্তক, বর ও অভয় মুদ্রা। বক্ষস্থল ও কণ্ঠ, নরমুণ্ডমালার রক্তে রঞ্জিত।

৬. ছিন্নমস্তা

মন্দাকিনী সরোবরে স্নান ও জলকেলি করতে করতে ক্ষুধায়-তৃষ্ণায় ক্লান্ত ও কাতর হয়ে পড়লেন মা ও তাঁর সখীরা। কিন্তু কৈলাস না পৌঁছনো অব্দি এই নির্জন বনে খাদ্যের জোগাড় অসম্ভব।

সময় যায়, দাউদাউ করে জ্বলে উঠে জঠর থেকে মস্তিষ্ক অব্দি জ্বালিয়ে দেয়। ভীষণ ক্ষুধায় কাতর হয়ে, জয়া-বিজয়ার মতো সুদর্শনা সখীরাও বিকট ‘ডাকিনী- বর্ণিনী’ রূপ পরিগ্রহণ করলেন। মা-ও এদিকে ক্ষুধায় গৌরী থেকে কৃষ্ণাঙ্গী হয়ে পড়েছেন।

অতএব সন্তান ও নিজের ক্ষুধা মেটাতে, নখের আঁচড়ে আপনার মুণ্ডছিন্ন করলেন মাথা পার্বতী। আপনার রক্ত দিয়ে তৃষ্ণা মেটালেন দুই সহচরীর। সেই সঙ্গে এর একটি ধারা তৃষ্ণা মেটাল তাঁর কর্তিত মুণ্ডেরও । মায়ের এই রূপই ছিন্নমস্তা।

ত্রিকোণ যন্ত্রে শায়িত এক বদ্ধ নারী-পুরুষের উপর স্থাপিত পদ্মে বাম পা সামনে রেখে ষোড়শবর্ষীয়া দেবী দণ্ডায়মানা। মা দিগম্বরী, ছিন্নমস্তা। ছিন্নমস্তক দেবীর বাম হস্তে ধৃত। আপন রুধির আপনিই পান করে চলেছেন। ডান হস্তে কাটারি, কণ্ঠে হাড়ের মালা ও সর্প যজ্ঞোপবীত। মায়ের বামে সখী ডাকিনী( পীত), দক্ষিণে বর্ণিনী ( রক্তবর্ণা)। এরাও ঊর্ধ্বমুখী হয়ে দেবীর ছিন্নকণ্ঠ হতে উৎক্ষিপ্ত রুধির ধারা পান করে চলেছেন।

৭. ধূমাবতী

কাকধ্বজরথে( চারটি কাক) উপবিষ্টা দেবীর গায়ের রং ফ্যাকাশে। তাঁর চক্ষু চঞ্চল, দৃষ্টি তীব্র ও কর্কশ। তিনি সদাই ক্রুদ্ধ। মলিন শ্বেতবস্ত্র পরিহিতা, দীর্ঘদেহী, দেবী স্বামীহীনা, দন্তহীনা এক বৃদ্ধা! কম্পমান শিথিল হস্তের একটিতে কুলো, অন্যটিতে বরমুদ্রা। দেবী সদাই ক্ষুধার্ত এবং তৃষ্ণার্ত। ক্ষুধাবোধ সদাই কলহ জাগরুক করছে। মহাদেব এ বার ভীত নয়, বিভ্রান্ত হয়ে গেলেন, “পত্নী সতীর জায়গায় এ কোন বৃদ্ধ, কোপনস্বভাবা বিধবা ! ” দেবী বললেন তিনি ধূমাবতী। দেবী তমঃপ্রধানা, অন্তরের কালোকে টেনে এনে তাকে নাশ করেন। তিনি ভয়ঙ্কর পাপকে ভয়ঙ্কর রূপেই নাশ করে থাকেন।

৮. বগলামুখী

হলুদবরণ মা সিংহাসনে উপবিষ্টা। মায়ের পরিহিত বস্ত্র হলদেরঙা। গলার মাল্য হরিদ্রাভ এবং অলঙ্কার স্বর্ণাভ হলুদ।

মা এক হাতে অসুরের জিভ ও অন্য হাতে গদা ধারণ করে আছেন। বাম হাতে তিনি শত্রু অসুরের জিভ টেনে ধরে, ডান হাতে তাকে কণ্টক মুগুর দিয়ে প্রহার করছেন।

জিহবা, পক্ষান্তরে মুখ / বাক / বগলাকে মা সংযম করছেন, তাই মায়ের এই রূপ বগলামুখী। এই রূপও তমোগুণ প্রধানা, অর্থাৎ ভয়ঙ্করী। কিন্তু মা জীবকে তার দারিদ্র দুঃখরূপ অসুরের হাত থেকে নিস্তার করেন। অশুভ, অলৌকিক অশান্তি দূর হয়। পক্ষান্তরে ঈর্ষা,ঘৃণা, নিষ্ঠুরতা প্রভৃতি তমোগুণ তিনি নাশ করেন। মায়ের হাতে সংহার হওয়া এই অসুর রুরুর গাত্র বরণ সবুজ ।

৯.মাতঙ্গী

মাতা মাতঙ্গী হলেন নবম রূপ। শ্যামবর্ণা, ত্রিনয়না, চতুর্ভূজা, রক্তাভ বসন পরিহিতা, কিরীটধারিণী মা রত্ন সিংহাসনে উপবিষ্টা। তরবারি ও মুগুর মায়ের অস্ত্র। মায়ের সন্তান হাতি। মাতঙ্গ মুনির আশ্রমে শুম্ভ এবং নিশুম্ভ ভয়ানক অত্যাচার শুরু করেন। মাতঙ্গ মুনির স্ত্রীর শরীর থেকে বার হয়ে দেবী শুম্ভ ও নিশুম্ভ দৈত্যদের নিরস্ত করেন। তাই মায়ের অপর নাম মাতঙ্গী।

১০. কমলা

দশমহাবিদ্যার এক এক করে নয়টি রূপ দেখে মহাদেব যখন ভীত-সন্ত্রস্ত ও বিস্মিত, তখন মা তাঁর অন্তিম রূপে ধরা দিলেন। সে রূপ অতি কোমল। এই রূপ ঐশ্বর্য লক্ষ্মী কমলা। রক্তবর্ণ পদ্মের উপর দেবী বসে রয়েছেন।

মায়ের দুই পাশ হতে দুইটি হস্তী শুঁড়ে কলস ধরে অমৃতবারি বর্ষণ করে মায়ের অভিষেক করছেন। মায়ের চারটি হাতে দু’টি পদ্ম, বর ও অভয় মুদ্রা। মা সাক্ষাৎ মূর্তিমতী কৃপা। ভাদ্রমাসের কৃষ্ণাষ্টমী তিথিতে কোলাসুরকে বিনাশ করেন তিনি।

সমুদ্র মন্থনকালে দেবীর উৎপত্তি। তাই দেবী, ক্ষীরোদ সমুদ্রজাতা । বিষ্ণু তাঁকে তাঁর বক্ষঃস্থলে স্থান দেন, পূজন করেন। তাই তো মা পদ্মাসনা, পদ্মা-পদ্মালয়া।

এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের একটি অংশ।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement