আমরা ভাল নেই। কারণ আমাদের মেয়ে, বোন, মা কেউ ভাল নেই। কিন্তু এমনটা কী হওয়ার ছিল? সেই কোন সুদূর অতীতে এমন একটি কালকে অনুভব করেই পূর্বপুরুষেরা লিখে গিয়েছিলেন আমাদের কর্তব্যের হ্যান্ডবুক। সেখান থেকেই জানব নবদুর্গার কথা।
নবদুর্গা: মা দুর্গার নয়টি রূপ বা প্রকাশ। নবদুর্গার যোগ-সাধন ও শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা নিয়ে বিশদে বহুবার বহু জন আলোচনা করেছেন। গত বছর আমারও একটি প্রতিবেদন ছিল। কিন্তু বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে নবদুর্গা যে ভীষণ প্রাসঙ্গিক, সেই নিয়ে আলোচনা বড় কম। এই পর্বে নবদুর্গাকে জানলে বুঝলে বুঝতে পারব,
এই নবরূপ আদতে এক বালিকার বধূ থেকে মা এবং মা থেকে পরমাতৃত্বে উত্তরণের যাত্রাপথ— এক নারীর জীবন আলেখ্য। অর্থাৎ শাস্ত্রের সঙ্গে ব্যবহারিক ব্যাখ্যা ও উপলব্ধি দ্বারা নারীর লড়াই, নারীর সংগ্রামকে প্রতিষ্ঠিত করা, সিদ্ধ করা এবং পুরাণে তার ছাপ রেখে যাওয়া। তাই হল নবদুর্গা। জানলে অবাক হবেন
প্রথমা / মা শৈলপুত্রী - সতীর দেহত্যাগের পরে পুনর্বার জন্মগ্রহণ করেছেন হিমালয়দুহিতা পার্বতী রূপে। এই রূপে তিনি কেবলই ষোড়শী, শ্যামাঙ্গী বালিকা। গিরিরাজ তাকে বড় স্নেহে পালন করছেন। তাই তো করতে হয়। কন্যা যখন বালিকা, তখন তাকে স্নেহের প্রশ্রয়ে রাখতে হয়, তাকে আগলে রাখতে হয়। এবং এ শুধু পিতামাতার কর্তব্য নয়, যাঁরা আশপাশে রয়েছেন, তাঁদেরও এটি কর্তব্য। তার ক্ষতি আগামীকালের এক মায়ের ক্ষতি।
দ্বিতীয়া/ মা ব্রহ্মচারিণী - এই বার কন্যা শিক্ষার অঙ্গনে প্রবেশ করছে। শিক্ষা কঠিন সাধন। বিদ্যাচর্চার অন্যতম হল ব্রহ্মচর্য যাপন। অর্থাৎ মনকে বিক্ষিপ্ত না করে শুধুমাত্র বিদ্যার সাধনের দিকেই নিবিষ্ট করতে হবে। মা তাই এই রূপে ব্রহ্মচারিণী। তিনি শিবকে পেতে কঠিন তপস্যায় রত। অর্থাৎ নারী-পুরুষ যখন নিজের সাধনায় সিদ্ধি লাভ করে, সফল হয়। সে কিন্তু আর্থিক ও মানসিক ভাবে স্বাধীন। তার কিন্তু নিজের জীবন বাছার, নিজের জীবনসঙ্গী বাছার পূর্ণ অধিকার।
তৃতীয়া/ মা চন্দ্রঘণ্টা - কন্যার বিবাহ হচ্ছে। মস্তকে চন্দ্রস্বরূপ তার স্বামী অবস্থান করছেন। অর্থাৎ একটি নববিবাহিত দম্পতির পূর্ণ ছবিও আঁকা হচ্ছে। এবং অদ্ভুত ভাবে চন্দ্রঘণ্টার রূপ বর্ণনার সঙ্গে শিব-পার্বতীর বিয়ের কাহিনি ওতপ্রোত ভাবে জড়িত।
চতুর্থী / মা কুষ্মাণ্ডা - বধূ রূপে কন্যার বিবাহ জীবনের দ্বিতীয় পর্যায়, মাতৃত্ব। এখানে অণ্ড অর্থাৎ ডিম। এই মহাজগৎ সৃষ্টি হয়েছে ডিম থেকেই। তাই তো আমরা বলি ব্রহ্মাণ্ড। মানুষ থেকে প্রাণী ডিম্বাণু বা রেণুর নিষেক– বীজ বা ভ্রুণ, এই তো সার। মা নারী। তাঁর গর্ভাশয় সেই মস্ত মহাজাগতিক প্রজনন ক্ষেত্র। পক্ষান্তরে ডিম্ব তাই মায়ের এই রূপ কুষ্মাণ্ডা।
পঞ্চমী/ মা স্কন্দমাতা - মায়ের মাতৃত্ব পূর্ণ হয়েছে। মায়ের কোলে শিশু স্কন্দ অর্থাৎ কার্তিক। এই শিশু ষড়ানন। এর অন্তর্নিহিত উপলব্ধিটি হল ভয়ানক দুষ্ট। ছয় দিকে সে দৌড়ে বেড়ায়। ছয় দিকে তার মাথা কাজ করে। মা হিমশিম খান তাকে নিয়ে। তাকে শাসন করেন, আবার তাকেই কোলে বসিয়ে রাখেন, আগলে রাখেন।
ষষ্ঠী / মা কাত্যায়নী - মা এখানে নারী হয়েছেন। সংসারে বধূমাতা এবং সর্বোপরি এক নারীরূপে তাঁর প্রকাশ। এই রূপে মা মহিষাসুরকে বধ করছেন। অর্থাৎ সংসারের ভিতর-বাহিরের যাবতীয় অশান্তি, সমস্যা তিনি বিচক্ষণ নারীর ন্যায় মোকাবিলা করছেন ও সমাধান করছেন।
সপ্তমী/ মা কালরাত্রি - মা এখানে ভয়ঙ্করী এবং ক্রোধে কৃষ্ণবর্ণা। অর্থাৎ কেউ যদি তাঁর সংসারের ক্ষতি করে, তাঁর সন্তানকুলের ক্ষতি করে, তবে তিনি কিন্তু প্রয়োজনে অস্ত্র ধারণ করতে পারেন। সেটি সকলের বুঝে নিতে হবে। নারী মানে তিনি কেবল স্নেহদাত্রী নন। প্রয়োজনে তিনি নির্মম ভাবে শাসনও করতে পারেন।
অষ্টমী/ মা মহাগৌরী - মা মহা গৌরী রূপে কৃষ্ণবর্ণা থেকে গৌরী হচ্ছেন। অর্থাৎ সংসারে তিনি সামঞ্জস্য ফিরিয়ে এনেছেন। সংসারকে সুস্থিত করেছেন। নারী, মা এবং বধূ হয়ে সব কিছুকে তিনি আপন নিয়ন্ত্রণের মধ্যে দৃঢ় ভাবে ধরে রেখেছেন। কর্তৃত্বের স্বর্ণালী আভা তাঁকে গৌরাঙ্গী, গৌরী করে তুলেছে।
নবমী / মা সিদ্ধিদাত্রী - নবমীর এই রূপটি হল মায়ের প্রবৃদ্ধা রূপ। অর্থাৎ অভিজ্ঞতায়, নিয়ন্ত্রণে তিনি সাক্ষাৎ পরমা। তাঁর থেকে সবাই শেখে, বোঝে কী ভাবে জীবনে এগিয়ে চলতে হবে। তিনি সকলকে শিক্ষা বা সিদ্ধি দান করেন।
অতএব বুঝতে পারছেন তো, আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে আছি? কী আমাদের কর্তব্য ছিল আর কতটুকু আমরা সম্পাদন করতে পেরেছি... বালিকা থেকে ব্রহ্মচারিণী, কাউকেই আমরা টিকিয়ে রাখতে পারিনি। এ আমাদের বড় খেদ।তথ্য ঋণ ~ শ্রী সুসঙ্গীত দাস, এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের একটি অংশ।