মহালয়ায় যেমন পিতৃপুরুষদের উদ্দেশ্যে খাদ্য ও জল দান করা হয়, তেমনই কার্তিক মাসের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশী তিথিতে বা এক কথায় বলতে গেলে কালীপুজোর ঠিক আগের দিন পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে প্রদীপ জ্বালানোর বিধান রয়েছে আমাদের শাস্ত্রে।
বাঙালি হিন্দুদের কাছে এই তিথি ‘ভূত চতুর্দশী’, অন্য দিকে পশ্চিম ও দক্ষিণ ভারতের একাংশে এই তিথিকেই ‘নরক চতুর্দশী’ বলে।
পৌরাণিক বিশ্বাস অনুসারে, কার্তিক মাসের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশীতে নরকাসুরকে বধ করেছিলেন শ্রী কৃষ্ণ। সে কারণেই বাঙালির ‘ভূত চতুর্দশী’, পশ্চিম ও দক্ষিণ ভারতের একাংশে ‘নরক চতুর্দশী’।
এ ছাড়াও ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে, এই দিনটি ছোট দিওয়ালি, রূপ চৌদাস, নরকা চৌদাস, রূপ চতুর্দশী বা নরকা পূজা নামেও পরিচিত।
কোথাও কোথাও এই দিনে যমরাজ ও শ্রী কৃষ্ণের পুজো করা হয়। অনেকেই দীর্ঘজীবন এবং স্বাস্থ্য সুরক্ষার উদ্দেশ্যে এই তিথিতে যমরাজের পুজো করেন।
ভূত চতুর্দশী পালনের একটি বিশেষ রীতি হল বাড়িতে ১৪টি প্রদীপ জ্বালানো।
প্রায় একই সময়ে (প্রতি বছর ৩১ অক্টোবর) পরলোকগত আত্মাদের স্মরণ করে পশ্চিমি দুনিয়ায় পালিত হয় হ্যালোইন ইভ।
২০০০ বছরেরও বেশি প্রাচীন এই ভূতুড়ে উৎসবের ইতিহাস। হ্যালোইন ইভের অর্থ হল ‘পবিত্র সন্ধ্যা’।
কেন জ্বালানো হয় ১৪টি প্রদীপ?
প্রাচীন শাস্ত্র, পুরাণ, কল্পকথা অনুসারে এই রীতির নেপথ্যে নানাবিধ ব্যাখ্যা রয়েছে। যেমন, একটি মত হল, ১৪ জন প্রেত অনুচরকে সঙ্গী করে, কার্তিক মাসের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশী তিথিতে অশুভ শক্তির বিনাশ করেন দেবী চামুণ্ডা। অন্য মত অনুসারে, এ দিন স্বর্গ ও নরকের দ্বার কিছুক্ষণের জন্য খুলে দেওয়া হয়। সেই দরজা দিয়ে পরলোকগত আত্মারা মর্ত্যে ফিরে আসেন। পিতৃকুল ও মাতৃকুলের চোদ্দ পুরুষের অশরীরী আত্মা নেমে আসেন গৃহস্থের বাড়িতে।
এই তিথিতেই নাকি রাজা বলি অসংখ্য অনুচরসহ ভূত, প্রেত নিয়ে মর্ত্যে নেমে আসেন পুজো নিতে।
বলি রাজা, পূর্বপুরুষের প্রেতাত্মা ছাড়াও নানান বিদেহী আত্মারা এদিন মর্ত্যলোকে নেমে আসে।
ভূত, পিশাচ, প্রেত থেকে বাঁচতে, অতৃপ্ত আত্মাদের অভিশাপ থেকে বাঁচতে ও 'নেগেটিভ' এনার্জি বা অশুভ শক্তিকে বাড়ি থেকে তাড়াতেই ১৪টি প্রদীপ জ্বালানো হয়।
ভূত চতুর্দশীর সঙ্গে বলিরাজার সম্পর্ক কী?
পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে, শ্রীবিষ্ণুর ভক্ত প্রহ্লাদের পৌত্র দৈত্যরাজ বলি, সাধনবলে শক্তি অর্জন করে স্বর্গ, মর্ত্য ও পাতাল জয় করে ক্রমশ অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছিলেন, এমনকি দেবতারাও তাঁর হাত থেকে রেহাই পাচ্ছিলেন না। স্বর্গরাজ্য দখল করে দেবতাদের বিতাড়িত করার পরিকল্পনা করেছিলেন বলি। এমত অবস্থায় শ্রীবিষ্ণুর দ্বারস্থ হলেন দেবতারা। বলির তাণ্ডব থামাতে, বামন রূপ ধারণ করে আবির্ভূত হলেন শ্রীবিষ্ণু। দানব রাজ বলির কাছে তিনটি চরণ রাখার জায়গা ভিক্ষা চাইলেন।
ভিক্ষা দিতে রাজি হলেন বলি। দু’পা দিয়ে স্বর্গ ও মর্ত্য দখল করে নিলেন বামন রূপী শ্রীবিষ্ণু। তৃতীয় পা কোথায় রাখবেন, তা জিজ্ঞাসা করা মাত্র প্রতিশ্রুতি রক্ষায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ বলি, নিজের মাথা পেতে দিলেন বামন অবতারের চরণে।
বলির মাথায় পা রেখে, তাঁকে পাতালে প্রবেশ করান বামন অবতার।
সেই থেকে পাতালই হল দৈত্যরাজ বলির আবাস। তবে, তাঁর এই আত্মাহুতি দেখে শ্রীবিষ্ণু বলিকে অমরত্ব প্রদান করেছিলেন। সেই সঙ্গে বছরে একটি দিন তাঁকে ভূত- প্রেতাত্মা- পিশাচ- অশরীরীর সঙ্গে এই পৃথিবীতে আসার অনুমতি দেন।
সেই দিনটিই হল ভূত চতুর্দশী।
এই দিনই যম দীপ দান করার বিধান রয়েছে। এ ছাড়াও এ দিন ধর্মরাজ, মৃত্যু, অন্তক, বৈবস্বত, কাল, সর্বভূতক্ষয়, যম, উড়ুম্বর, দধ্ন, নীন, পরমেষ্ঠী, বৃকোদর, চিত্র ও চিত্রগুপ্ত, যমলোকের এই ১৪ জনের উদ্দেশ্যে তর্পন করার রীতিও প্রচলিত রয়েছে।
এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের একটি অংশ।