ছবি: সংগৃহীত
দীর্ঘ কারাবাসের পরে মুর্শিদাবাদের দরবার থেকে ফিরে আসছেন মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র। নদীর ঘাটে ঘাটে তখন মা দুর্গার বিসর্জন-পর্ব চলছে। চোখ ভিজে যায় কৃষ্ণচন্দ্রের। “মাগো খাজনা দিতে পারিনি বলে কারাবাস হয়েছে; সে আমার দুর্ভাগ্য। কিন্তু রাজরাজেশ্বরীর বিসর্জন হচ্ছে আর আমাকে ছেলে হয়ে সে দৃশ্য দেখতে হচ্ছে। এর থেকে বড় কষ্ট আর কিছু নেই! বছরে তুমি এক বার বাপের বাড়ি আসো, অথচ তোমায় দেখতে পারলাম না এ বার!” হেমন্তের শুকনো বাতাসে হু হু করে ফেরে কৃষ্ণচন্দ্রের হাহাকার।
তার পরে এক দিন মধ্যরাত্রে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র স্বপ্ন দেখলেন রক্তবরণ, যোদ্ধাবেশ, অশ্বারোহী মাকে। দেবী বললেন, “বেশ, তোর যখন এতই দুঃখ, তবে দীপান্বিতা গতে কার্তিক শুক্লে আমার পূজা করিস! আমার এই রূপ জগদ্ধাত্রী নামেই খ্যাত হবে।“ শুরু হল তোড়জোড়। সে প্রায় ১৭৫০-৬০-এর কথা।
কৃষ্ণচন্দ্র দেব নদিয়ার সিংহাসনে থাকাকালীন ভয়ঙ্কর বন্যা কবলিত হয় এলাকা। প্রজাদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। ঋণ মকুব করেন তিনি। সেই বছর তাই নবাব আলিবর্দি খাঁকে খাজনা দিতে পারেননি কৃষ্ণচন্দ্র। কর অনাদায়ে নবাব তাঁকে গ্রেফতার করে নিয়ে গিয়ে বন্দি করে রাখেন। দিবারাত্রি মা-কে ডেকে, মায়ের অনুগ্রহে বন্দিদশা থেকে তিনি মুক্তি পেলেন বটে, কিন্তু তত দিনে শারদোৎসব শেষ। দশমী বিসর্জন চলছে। তার পরে বাকিটা এত ক্ষণে সকলের জানা। সেই শুরু। আস্তে আস্তে এর পরে জগদ্ধাত্রী পুজো ছড়িয়ে পড়ল চতুর্দিকে।
রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের মা
মায়ের রূপকল্পনা -
❝ কার্তিকে শুক্লপক্ষেঽহনি ভৌমবারে জগৎপ্রসূঃ।
সর্বদেবহিতার্থায় দুর্বৃত্তশমনায় চ।।
আবিরাসীৎ জগচ্ছান্ত্যৈ যুগাদৌ পরমেশ্বরী।। ❞ -দুর্গাকল্প
দেবগণের হিত, দুর্বত্তের প্রশমন এবং জগতের শান্তি-বিধানের জন্য যুগের প্রারম্ভে কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের মঙ্গলবারে (ভৌমবার) পরমেশ্বরী জগদ্ধাত্রী রূপে আবির্ভূতা হলেন। সদ্যোজাতের ন্যায় টালমাটাল, শিশুসুলভ জগৎকে তারণ ও ধারণপূর্বক সুস্থির করলেন তিনি। দেবী জগদ্ধাত্রী সিংহবাহিনী। তাঁর গলায় থাকে নাগযজ্ঞোপবীত। দেবীর দুই বাম হাতে থাকে শঙ্খ ও শার্ঙ্গধনু। আর, দুই ডান হাতে থাকে চক্র ও পঞ্চবাণ।
দেবী করীন্দ্রাসুরনিসূদিণী। করী অর্থ হস্তী। করীন্দ্রাসুর অর্থাৎ মহা হস্তীরূপ লোভ, মোহ প্রভৃতি যাবতীয় স্থূলকায় চিন্তাভাবনাকে বধকারী মা জগদ্ধাত্রী, মানব অন্তরকে শুদ্ধ ও স্বচ্ছ করছেন।
আর একটি কথা বলা হয়। দেবী দুর্গা তখন মহিষাসুরের সঙ্গে যুদ্ধ করছেন। মহিষাসুর একের পর এক রূপ পরিবর্তন করে দেবীর সঙ্গে ছলনায় রত। তেমন ভাবেই একটি পর্যায়ে মহিষাসুর হাতির রূপ ধরেন। তখন দেবী তাঁর চক্র দিয়ে সেই হাতির শুঁড় কেটে তাকে পরাস্ত করেন।
শাস্ত্রানুসারে, প্রতি বছর কার্তিক মাসের শুক্লা নবমী তিথিতে দেবী জগদ্ধাত্রীর আরাধনা করা হয়। কেউ দুর্গাপুজোর মতো সপ্তমী থেকে নবমী পর্যন্ত মহাসমারোহে জগদ্ধাত্রী পুজো করেন। কেউ আবার কেবল নবমীতেই তিন বার আয়োজন করে সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী পুজো শেষ করেন।
এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের একটি অংশ।