ছবি: সংগৃহীত
সে বার পুজোটা নন্দন তার বন্ধু উপশমের বাড়িতেই কাটাবে ঠিক করেছিল। গ্রামের বাড়িতে বহু বছরের পারিবারিক পুজো ওদের। নন্দন খাস কলকাতার ছেলে। গ্রামের সাবেক পুজো দেখার সাধ তার বহু দিনের। হোস্টেলের বন্ধু উপশম বলতেই তাই এক কথায় রাজি! একছুটে চলে এসেছে তার গ্রামের বাড়ির পুজোয়। আর এসেই থ!
এ কী কাণ্ড! “মাঝখানে মাকে রেখে চার ভাইবোন মিউজিকাল চেয়ার খেলেছে নাকি!” হতবাক নন্দন বলেই ফেলল সে কথা! কারণ ঠাকুরদালানে মা দুর্গার বাঁ দিকে গণেশ দাদা আর সরস্বতী ঠাকরুন! ডান দিকে লক্ষ্মী দিদি আর কার্তিকদা! আবার কার্তিক দাদার পাশেই বসিয়েছ নবপত্রিকা!
“এ যে পুরো উল্টো গো ভাই উপশম!” নন্দনের বিস্ময় কাটতে চাইছে না। উপশমের বৃদ্ধ দাদামশাই বসে ছিলেন সেখানে। তিনিই ভাঙলেন রহস্যটা। “দাদুভাই, এটা খানিকটা পারিবারিক প্রথা। তবে প্রথার শাস্ত্রীয় ব্যাখাও আছে। পূর্ববঙ্গের প্রাচীন পূজা আমাদের। সেখান থেকেই এই রীতি আমরা বহন করে নিয়ে এসেছি।”
কার্তিক-গণেশের প্রচলিত অবস্থান থেকে এই বিপরীত অবস্থানকে সাধারণ মানুষ উল্টোই মনে করেন। ধরে নেন, নিছকই পারিবারিক রীতি বা স্বপ্নাদেশ। তবে প্রকৃত অর্থে এটাই কিন্তু সঠিক। এর সূক্ষ্ম বা লুপ্ত অর্থ এটাই যে, এই রীতির প্রতিমা পূজাকারী বংশ বা ব্যক্তি প্রকৃতপক্ষে শৈব। শৈব ধারায় শিবাংশ কার্তিক তাঁর মায়ের দক্ষিণে থাকেন। এ ছাড়াও সর্ব ক্ষেত্রেই পূজোর শুরুতে আসন পূজার পর নিজ দক্ষিণে গণেশ ও নিজ বামে অর্থাৎ দেবী/দেবতার ডানে গুরুকে প্রণাম করা হয়। সেই অর্থে শিব হলেন জগৎগুরু, আর কার্তিক নিজেও গুরুমূর্তি, যাঁর অপর নাম স্বামীনাথ। তাই তত্ত্বগত ভাবে দেখতে গেলে, এই মূর্তি বিন্যাসই সঠিক। বরং যা সচরাচর দেখা যায়, সেটিই পরবর্তীতে পরিবর্তিত মূর্তি বিন্যাস। তবে, এটি মূলত পূর্ববঙ্গীয় রীতি ধরা হয়, কারণ এখনও পূর্ববঙ্গীয়দের মধ্যেই তা প্রচলিত রয়েছে।
আর একটি ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ কথা, যে কোনও বিদ্যায় সিদ্ধির প্রয়োজন হয় সর্বদা। বিদ্যা সিদ্ধ না হলে, সে বিদ্যা কাজে দেয় না। অর্থাৎ বিদ্যাকে আত্মস্থ করতে হবে। বিদ্যাকে তুমি বহন করবে না, তাকে বাহন করবে। বুদ্ধি এবং বিচার প্রস্ফুটিত হবে। তবেই তো বিদ্যা সার্থক– এ কথা আধ্যাত্মিক ও সাংসারিক, উভয় দিকেই সমান প্রযোজ্য। বিদ্যা সিদ্ধ হলেই তবে মা লক্ষ্মী আসেন। আর অর্থ বা বিত্তে দরকার সুরক্ষা। তাই সাংসারিক দিক দিয়েও দক্ষিণে( ডান) মা লক্ষ্মীকে রেখে এই মূর্তি বিন্যাস অনেক বেশি যৌক্তিক।
তথ্য ঋণ~ শাস্ত্রবিদ অরিজিৎ মজুমদার
এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের একটি অংশ।