”শ্রীহরির বাক্য শুনি আনন্দিত মনে।
মর্তে চলিলেন লক্ষ্মী ব্রত প্রচারণে।
অবন্তী নগরে লক্ষ্মী হ’ল উপনীত।
দেখিয়া শুনিয়া হ’ল বড়ই স্তম্ভিত।”
মাতা লক্ষ্মী হলেন ঐশ্বর্যের নিয়ন্তা দেবী। বস্তু ধন-সম্পত্তি হোক বা অন্তঃশ্রী সব কিছুরই অধিষ্ঠাত্রী তিনি।
আশ্বিন পূর্ণিমার লক্ষ্মী পূজাটি হল কোজাগরী লক্ষ্মী পূজা।
কোজাগরী অর্থ — কে জেগে আছো? প্রাচীন বিশ্বাস অনুযায়ী, মা এই দিন গৃহে গৃহে গিয়ে ভক্তকে দর্শন দেন। তাঁর গৃহে শ্রী প্রদান করে আসেন। তাই গৃহের দরজা খুলে মায়ের আসার অপেক্ষায় জেগে থাকতে হয়। তাই এই আরাধনার নাম, কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো।
লক্ষ্মীপুজোর সঙ্গে দু'টি জিনিস অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত, এক নাড়ু আর দুই আলপনা। আজ আসুন আলপনা নিয়ে জানি। আলপনার তত্ত্বকথা ও ইতিহাস নয়, লৌকিক বিশ্বাস আর ভক্তির কথা জানি আসুন।
পদ-চিহ্ন আলপনা :
যেমন বললাম, মাতা লক্ষ্মী গৃহে এসে দেখেন, কোন গৃহে তাঁর ভক্ত আলো জ্বেলে দুয়ার খুলে তাঁর জন্য অপেক্ষা করছে, সেই গৃহে তিনি প্রবেশ করেন। তাই আঁকা থাকে পদচিহ্নের আলপনা। ঠিক, যেমন বর্ষা কালে উঠানে পা ফেলার জন্য বিছানো থাকে ইট। তেমনি ওই পদ চিহ্ন ধরে মা প্রবেশ করেন ভক্তের ঘরে।
শ্রী আলপনা :
আলপনা মানেই মাঙ্গলিক— অন্তরের সৌন্দর্য দিয়ে রেখার পর রেখা তুলে, তাতে সুন্দরের প্রতিষ্ঠা করা। আলপনা মানেই স্থির একাগ্র চিত্তে অঙ্কন। অর্থাৎ কাজের প্রতি ভক্তি ও সমর্পণ।
মধ্যবর্তী শ্রী আলপনা বা মণ্ডলাকার বৃত্ত আলপনাটি তাই একাগ্রতা ও সমর্পণের প্রতীক; সাক্ষাৎ লক্ষ্মী শ্রী। অর্থাৎ গৃহস্থ এক মনে, মনের সবটুকু ভক্তি ও সৌন্দর্য দিয়ে এই আলপনা আঁকছেন, তাঁর লক্ষ্মী আসবে বলে।
এই মণ্ডলই আদতে মণ্ডপের দ্বিমাত্রিক রেখাচিত্র।
মিথ ও ব্যবহারিক ব্যাখ্যা :
আলপনা বিষয়টি ভীষণ রকম ব্যবহারিক। হরপ্পা, মেহেরগড়, মহেঞ্জোদারো থেকে সুমের, ক্রেটের বিভিন্ন অলংকৃত নকশা এবং মৃৎপাত্রাদি সর্বত্রই প্রায় আলপনার নিদর্শন পাওয়া যায়। এক রৈখিক, সুষমামণ্ডিত চিত্রকলা গোছের।
পদচিহ্ন আলপনার ক্ষেত্রে দু'টি বিষয় লক্ষ্য করা যায়। পদচিহ্ন আলপনায় যেখানে মাতা লক্ষ্মীর আগমনকে সূচিত হচ্ছে ; সেখানে আগুপিছু পা আঁকা থাকেন কারণ মানুষ ওই ভাবেই হাঁটেন। আর ’জোড়া পা’ হল লক্ষ্মী স্থিতির লক্ষণ।
কারণ লক্ষ্মীর বিবিধ পাঁচালীতে আমরা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, গৃহের বধূর লক্ষী ব্রত বা পূজনের কথা বলা হচ্ছে। অর্থাৎ অন্তরের বা অন্তঃপুরের লক্ষ্মীস্থিতির কথা তিনি বলছেন। প্রতিটি নারীলক্ষ্মীকে সূচিত করা হচ্ছে ওই জোড়া পা দিয়ে। তাঁরা ঘরেই থাকেন।
বিবিধ আলপনা :
ধান্য আলপনা হল ধান গাছের রূপক। গোলা ঘরে, ভাঁড়ার ঘরের চৌকাঠে এই আলপনা দেওয়া হয়। মা লক্ষ্মীর পদচিহ্নের পাশাপাশি ধান্য আলপনা সূচিত করে — শস্যসমৃদ্ধ অঙ্গন। অর্থাৎ ঘরের বধূ যখন খড়ায় করে ধান নিয়ে যান তখন দু চারটি ধান ছড়িয়ে পড়ে তার অঙ্গনে। সে ধান পরে তুলে নেওয়া হয়, কিন্তু ওই ছবিটি শাশ্বত। ওইটিই পল্লি বাংলার প্রাচুর্যের ছবি। তাই, ধান্যবতী হোক, আমার অঙ্গন।
মৎস্য আলপনা:
সুপ্রাচীন কাল থেকেই আমরা প্রকৃতিকে পুজো করে আসছি। বর্তমান দেবদেবীদের প্রায় প্রত্যেকের সঙ্গেই পুষ্টি, শস্য, রোগহর ছবিটি সংযুক্ত। এমনিভাবে ধান যদি ভূমি যত সহ্য হয় তাহলে মৎস্য হলো পুস্করিনীর শস্য। তাই লক্ষ্মীপূজায় মৎস্যসূচিত অলংকরণ করা হয় অর্থাৎ শষ্যকে প্রাধান্য দেওয়া হয়।
ঠাকুর ঘরে আঁকা হয় শঙ্খ- পদ্ম- শাঁখা- পলা অর্থাৎ শঙ্খধ্বনি দ্বারা দেবীকে আবাহন করা হচ্ছে। পদ্ম হলেন সাক্ষাৎ দেবী বা বোধ। ঋগ্বেদ হতে শতপথ ব্রাহ্মণ সর্বত্রই দেবীর চতুর্দশাক্ষর তিনি। কাজেই প্রস্ফুটিত দল আদতে জাগ্রত বোধ তথা অন্তরের লক্ষ্মী শ্রী।
মা লক্ষ্মী বিষ্ণু বক্ষস্থলস্থিতাম অর্থাৎ তিনি এয়োস্ত্রী। তা ছাড়া গৃহের প্রতিটি বধূনারীকেই যদি লক্ষ্মী কল্পনা করা হয়। তাই শাঁখা-পলা দিয়ে তার চিরায়ত শৃঙ্গারকে সূচিত করা।
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, আলপনা মানুষের সুন্দর কল্পনা। ঠিক তাই, মানুষ তার সুন্দর কল্পনা সবটুকু শ্রী, সৌন্দর্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবী লক্ষ্মীকে নিবেদন করছে বলেই লক্ষ্মী পূজায় আলপনার এত সমাহার।
সব শেষে একই কথা বলার, মাতা লক্ষী হলেন বিষ্ণু বক্ষস্থলস্থিতাম অর্থাৎ হৃদয়ের সুকুমারী সৌকর্য হলেন মাতা লক্ষ্মী। তেমনই আমাদের বাসগৃহকে যদি ছত্রধর, পালক বিষ্ণু ধরা হয়, তা হলে তার অন্তঃপুরে বাস করেন মাতা লক্ষ্মী আর এই আলপনা হল তার শৃঙ্গার বা স্ত্রী।
তথ্যসূত্র:
বাঙালীর ইতিহাস— নীহাররঞ্জন রায়, বাংলার ব্রত — অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বাগেশ্বরী— অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বাংলার ব্রত ও পার্বণ— লীলা বসাক, কেয়াপাতা সাপ্তাহিক পত্রিকা