জ্ঞান সরস্বতী মন্দির
পুরাণে বলে, ৫০০০ বছর আগে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পর গোদাবরীর তীরে থাকতেন বেদব্যাস আর বিশ্বামিত্র। গোদাবরীর তীরেই ধ্যানে বসতেন তাঁরা। পরে রাজা বিজিয়ালুড়ু তাঁদের জন্য এক মন্দির তৈরি করে দেন। তেলঙ্গানার বাসারায় সেই মন্দিরেই বিরাজ করেন দেবী জ্ঞান সরস্বতী। প্রতিমা, তাঁর অনুষঙ্গ, জড়িয়ে থাকা কাহিনি, সবেতেই তিনি একেবারে অন্য রকম। এ বার পুজোয় পরিচয় করা যাক এই অন্য সরস্বতীর সঙ্গে।
নিজামাবাদ-মাল্লারাম অরণ্য, সারাঙ্গাপুর অরণ্য, চান্দুর অরণ্য, ধরপল্লী অরণ্য ঘিরে রেখেছে এই মন্দিরকে। শ্বেতশুভ্র মন্দিরের গর্ভগৃহে চতুর্ভূজা, পীতবস্ত্র-পরিহিতা, পদ্মলোচনা, বীণাপুস্তকধারিণী দেবী। শ্বেতবর্ণা নন, এখানে তাঁর গাত্রবর্ণ হরিদ্রাভ। কারণ প্রতিমার গায়ে প্রতিদিন দেওয়া হয় হলুদের প্রলেপ। সেই হলুদই দেওয়া হয় দেবীর প্রসাদ হিসেবে। ভক্তেরা বিশ্বাস করেন প্রসাদী হলুদ খেলে জ্ঞান ও মেধা বৃদ্ধি পায়। দেশের সব জায়গায় দেবী সরস্বতীর বাহন রাজহংস। কিন্তু জ্ঞান সরস্বতীর বাহন এক হরিদ্রাভ ময়ূর। এ ছাড়া মন্দির প্রাঙ্গণেই আছে বেদবতী নামের একটি পাথর। তাকে বিভিন্ন দিকে আঘাত করলে, ভেসে আসে আলাদা আলাদা সুরেলা আওয়াজ। লোকগাথা বলে, এই পাথরটি ছিল সীতার অলঙ্কার। মন্দির প্রাঙ্গণে থাকা একটি টিলার উপরে আছে দেবী সরস্বতীর বিশাল এক মূর্তি।
পুরাণ মতে, কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের বিয়োগান্তক ঘটনাক্রম বদরিকাশ্রমে থাকা ব্যাসদেবকে বিষণ্ণ করে তুলেছিল। শান্তির খোঁজে কিছু দিনের জন্য আশ্রম ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে তিনি এসে পৌঁছন দক্ষিণ ভারতের এক ঘন অরণ্যে। গোদাবরী নদী ও পাহাড়ে ঘেরা অরণ্যের শান্ত নির্জনতা, প্রজাপতিদের ওড়াউড়ি, পাখিদের কলকাকলি, হরিণদের নির্ভয় বিচরণ, ময়ূরদের পেখম নৃত্য তাঁকে মোহিত করেছিল। সেখানেই এক পাহাড়ি গুহায় ব্যাসদেব তপস্যা শুরু করেন। কেটে গিয়েছিল বহু যুগ। তপস্যা শেষে বসন্ত পঞ্চমীতে গোদাবরী নদীতে স্নান সেরে ব্যাসদেব হাতে তুলে নেন তিন মুঠো বালি। সেই বালি দিয়ে নদীতীরে তিনটি ঢিপি গড়ে বসেন ত্রিদেবের আরাধনায়।
দৈববলে তিনটি বালির ঢিপি পরিণত হয়েছিল দেবী সরস্বতী, মা মহালক্ষী ও মা মহাকালীর চন্দন কাঠের বিগ্রহে। তাঁদের তিন জায়গায় প্রতিষ্ঠা করে ব্যাসদেব শুরু করেছিলেন আরাধনা। দেবী সরস্বতীর বিগ্রহের সামনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতেন। দেবী জ্ঞানদার আশীর্বাদে কেটে গিয়েছিল মনে জমে থাকা হতাশা।
এর পরে কেটে গিয়েছিল কয়েক হাজার বছর। জনশ্রুতি বলে, দক্ষিণ ভারতের অরণ্যটিতে মহর্ষি বেসব্যাসের অবস্থানের কথা ছড়িয়ে পড়েছিল চার দিকে। তাঁর নামেই স্থানটির নাম হয় ব্যাসারা বা বাসারা। ষষ্ঠ শতকে এই বাসারা ছিল নন্দাগিরি রাজত্বের অধীনে। সিংহাসনে তখন রাজা বিজিয়ালুডু। সরস্বতী ও মহর্ষি ব্যাসদেবের কিছু অলৌকিক কাহিনি লোকমুখে শুনে মোহিত হয়ে তিনিই গোদাবরীর তীরে গড়ে তোলেন অপূর্ব কারুকার্যময় এক মন্দির। সেখানেই প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল ব্যাসদেব নির্মিত সরস্বতী বিগ্রহটিকে। মা সরস্বতীর নাম হয় ‘জ্ঞান সরস্বতী’।
দেবীর নিত্যপূজা শুরু হয়। দূরদূরান্ত থেকে আসতে শুরু করেছিলেন ভক্তেরা। এরপর মন্দির প্রাঙ্গণে চালুক্য রাজারা গড়ে তুলেছিলেন মা মহালক্ষী ও মা মহাকালীর মন্দির। স্থানীয় ইতিহাস বলে, আলাউদ্দিন খিলজির সেনাপতি মালেক কাফুরের দলবল নাকি ধুলিসাৎ করে দেয় প্রাচীন মন্দিরটিকে। তবে তার আগেই দেবী জ্ঞান সরস্বতীর বিগ্রহটিকে সরিয়ে ফেলেছিলেন পুরোহিতেরা। প্রায় চারশো বছর পর, ১৭ শতাব্দীতে দেবী জ্ঞান সরস্বতীর মন্দিরটির পুনর্নির্মাণ করেন নন্দাগিরি এলাকার উপজাতীয় প্রধানেরা। সেখানে ফের সাড়ম্বরে স্থাপন করা হয়েছিল ব্যাসদেব নির্মিত জ্ঞান সরস্বতী বিগ্রহটিকে।
কয়েক হাজার বছর ধরে একটি বিশেষ উৎসব পালিত হয়ে আসছে দেবী জ্ঞান সরস্বতীর এই মন্দিরে। যার নাম অক্ষরভ্যাসম। বসন্ত পঞ্চমীর দিনে দুই বছর বয়স পূর্ণ হওয়া শিশুদের দেবী জ্ঞান সরস্বতীর কাছে নিয়ে আসেন বাবা মায়েরা। দেবীর সামনেই তাদের হাতেখড়ি হয়। স্থানীয় মানুষের বিশ্বাস, যে শিশু দেবীর পদতলে বসে জীবনের প্রথম অক্ষর লেখে, সে জীবনে ব্যর্থ হয় না। তবে শুধু বসন্ত পঞ্চমীতেই নয়। বছরে আরও তিন দিন হয় এই অক্ষরভ্যাসম উৎসব। তার মধ্যে সবথেকে উল্লেখযোগ্য দিনটি হলো আষাঢ় মাসের গুরুপঞ্চমী বা ব্যাসপঞ্চমী। মহর্ষি বেদব্যাসের জন্মদিন।এই দিনটি ছাড়া শ্রাবণ পঞ্চমী (রাখি পুর্ণিমা) ও বিজয়া দশমীতেও হয় এই অক্ষরভ্যাসম উৎসব। প্রতি বছর দশ থেকে বারো লক্ষ শিশুর হাতেখড়ির সাক্ষী থাকেন দেবী জ্ঞান সরস্বতী।
অবস্থান/কী ভাবে যাবেন: হাওড়া থেকে তেলঙ্গানার বাসারের ট্রেন আছে। বাসার স্টেশন থেকে ৮ মিনিটের দূরত্বে মন্দির।। কাছের বিমানবন্দর রাজীব গাঁধী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর।
(এই মন্দির সম্পর্কে প্রচলিত কাহিনিতে জীবন যাপন নিয়ে যে দাবি করা হয়ে থাকে, তা নিয়ে আনন্দবাজার অনলাইন দায়ি নয়। )
এই প্রতিবেদনটি 'আনন্দ উৎসব' ফিচারের একটি অংশ।