কাঁচা রাস্তা, ধুলোমাখা পথ বেয়ে সারাদিন বেচাকেনার পর ঘরফেরতা ক্লান্ত হাটুরের দল, বেলাশেষে পুকুর থেকে কলসি ভরে জল তুলতে এসেছে মেয়ে বউরা। গোবিন্দপুর গ্রামে প্রদীপ জ্বলে উঠছে একটা দুটো করে। কংসবণিকদের এই গ্রামটা অন্যান্যবার এই সময়ে খুশিতে মাতোয়ারা থাকে। দুর্গাপুজো শেষ। গ্রামের বাসিন্দারা এলাকায় কালীপুজো করেন প্রতিবছর। সেই পুজোটা এবার বোধহয় আর করা যাবে না। পয়সার অভাব চলছে কয়েকবছর ধরেই। সম্পন্ন গ্রামের অবস্থা এখন একটু পড়তির দিকেই। পুজো বন্ধ করে দিলে দেবী কুপিত হতে পারেন। সেই ইচ্ছা বা সাহস কারওরই নেই। কাছেই প্রামাণিকদের সাত জ্ঞাতি নিয়ে একটি পরিবার আছে। অনেকেই চান এই ‘সাতঘর প্রামাণিক’ পরিবারকে এবার থেকে পুজোর দায়িত্ব দিয়ে দিতে। বক্রেশ্বর প্রামাণিকের ঠাকুরবাড়িতে জগদ্ধাত্রী পুজো হয়। কালীপুজোর ভারও নিশ্চয়ই নেবেন তাঁরা। হলও তাই। পরিবারটি সানন্দে রাজি হয়ে গেল এই প্রস্তাবে। এই বাড়ির এক গৃহবধূ কিছুদিন আগেই স্বপ্ন দেখেছিলেন আজানুলম্বিত চুলের শ্যামবর্ণা একটি বাচ্চা মেয়ে নূপুর পরা রাঙা পায়ে তাঁদের সদর দরজা দিয়ে ছুটে ঘরে ঢুকে ঠাকুরদালানে মিলিয়ে গেল। মেয়েটির নূপুরের ঝুমঝুম শব্দ গভীর ঘুমে আরও অনেকেই শুনেছিলেন সেদিন। মা আসতে চান এই বাড়িতে। এই স্বপ্ন হয়ত তারই ইঙ্গিত। সেই বছর থেকেই প্রামাণিকদের মাটির ঠাকুরদালান আলো করে দেবী এলেন। পারিবারিক সূত্রে দাবি, তাঁদের পুজো প্রায় চারশো বছরের প্রাচীন।
প্রথা অনুসারে কুমোরটুলি থেকে দো- মেটে করে পুজোর কিছুদিন আগে ঠাকুর নিয়ে আসা হয় তারক প্রামাণিক রোডের ঠাকুরবাড়িতে। এখানে আসার পর ঠাকুরের গায়ে রং হয়। পুজোর আগের দিন ভেজানো পাঁচকলাই আর ধান বিছিয়ে দেওয়া হয় ঠাকুরের চৌকির তলার মাটিতে। এরপর ঠাকুরকে চৌকিতে তোলা হয়। পুজোর আগে থেকেই সমস্ত উপকরণ তৈরি করার কাজ শুরু করেন বাড়ির মেয়েরা। মঙ্গলঘট, বরণডালা সাজানো হয়। ১০৮ টা দুর্বা আর ১০৮ টা চাল তুলোর মধ্যে দিয়ে লাল সুতো দিয়ে সিঁদুরে মাখিয়ে অর্ঘ্য তৈরি হয় । দেবীকে অর্পণ করার পর সেটি তুলে নেওয়া হয়। এই বাড়িতে অর্ঘ্যের বিসর্জন হয় না। বহু মানুষ আসেন এই বাড়ি থেকে অর্ঘ্য নিতে। ঠাকুরের আশীর্বাদী হিসাবে নিজেদের কাছে রাখেন তাঁরা প্রিয়জনের অসুস্থতা সারাতে বা মনস্কামনা পূর্ণ করতে। পুজোর দিন সকাল থেকে বাড়ির মেয়ে বউরা ঠাকুর সাজান। সাতটি জ্ঞাতি ঘর থেকে পাওয়া সোনা রুপোর গয়না, রুপোর মুকুট , সোনার মুকুট খাঁড়া-সহ বেশ কিছু অলংকার আছে । সেগুলি সবই পরানো হয় দেবীকে। কাচের কিছু পুরনো ফানুস এখনও আছে বাড়িতে। পুজোর সময় সেগুলিও জ্বালানো হয় ঠাকুরদালানের দু’পাশে। ঠাকুরমশাই পুজোর সময় নিজের বাড়ির নারায়ণ এই বাড়িতে নিয়ে এসে ঠাকুরদালানে বসান। তাঁর পাশে বসেন প্রমাণিক বাড়ির নিত্যপূজিতা ধান্যলক্ষ্মী। পুজোর সময় ১৬ থেকে ১৭ টি নৈবেদ্য চাল, কলা , মিষ্টি , নারকেলের মণ্ডা পানের খিলি দিয়ে সাজিয়ে দেওয়া হয়। এ ছাড়াও ছোট ধামায় দেওয়া হয় পাঁচকলাই আর ছোলা ভিজানো। নুন ছাড়া পাঁচরকম ভাজা, লুচি দেওয়া হয় ঠাকুরকে। নারকেলের মণ্ডা, ছাপা মিষ্টি, রসকড়াই, চন্দ্রপুলি , দই দেওয়া হয়। আশেপাশের বহু মানুষ আসেন পুজো দিতে শিষ সহ ডাব আর গুঁড়ো চিনি নিয়ে। এই বাড়ি থেকেও ঠাকুরকে ডাব আর বাটা চিনি দিতে হয়। চিনির ওপরে নারকেলের মণ্ডা দিয়ে চারপাশে চন্দ্রপুলি সাজিয়ে এই ডাব আর চিনির নৈবেদ্য দু’পাশে রাখা হয় ঠাকুরের চৌকির ওপরে।
এই বাড়িতে পুজোর সময় যাঁদের মনস্কামনা থাকে তাঁরা দণ্ডী কেটে আসেন । বুক চিরে রক্ত দেন অনেক ভক্তই। এছাড়াও নারী পুরুষ নির্বিশেষে যাঁরা মানত করেন পুজোর দিন তাঁরা ধুনো পোড়ান। এর পর দালানের সামনে ২৮ টি প্রদীপ খড় দিয়ে সাজিয়ে দেওয়া হয়। তারপর শুরু হয় হোম। আগে পুজোতে পাঁঠাবলি আর মোষবলি হত। স্থানীয় মানুষ বিশ্বাস করতেন বলির সময় দেবী এগিয়ে আসতেন। তাই পুরোহিতের বিধানে বিগ্রহকে বলির সময় সোনার শিকল দিয়ে আটকে রাখা হত। বলি হয়ে যাওয়া মাত্র বলির সামগ্রী তাঁর সামনে সাজিয়ে দেওয়া হত। এখন অবশ্য এই বাড়িতে আর বলি হয় না। কালীপুজোর পরে তিথি অনুযায়ী এখানে যন্ত্র পুজো হয়। লোহার জিনিস ঠাকুর দালানে সাজিয়ে সেগুলিকে পুজো করা হয়। যন্ত্রপুজোর পর প্রামাণিকদের ঠাকুরদালানে বিজয়ার কোলাকুলি এবং মিষ্টিমুখ হয়।
আরও পড়ুন: বউবাজার হালদার বাড়ির কালীপুজো
বিসর্জনের আগে কালী ঠাকুরকে উঠোনে নামিয়ে বরণ করা হয়। পানের পাতার অংশ কেটে একাধিক খিলি পাকিয়ে বরণে বিশেষ ধরণের পান ব্যবহার হয়। এই পানকে বলা হয় ঝাড়খিলি পান। বরণের পর সিঁদুর খেলা হয়। বহু আগে দেবীকে সমস্ত গয়না পরা অবস্থায় পঞ্চাশ লেঠেল নিয়ে সিংহাসন-সহ বিসর্জন দিতে নিয়ে যাওয়া হত। গঙ্গার ঘাটে নোয়া ছাড়া বাকি গয়না খুলে তারপর বিসর্জন দেওয়া হত। এখন আর সে প্রথা নেই। তবে আগের মত এখনও বিসর্জনের সময় দেবীর কপালের অর্ধচন্দ্র আর হাতের নোয়া পরানো থাকে।
ছবি সৌজন্য: অর্পিতা প্রামাণিক