দশঘরা বিশ্বাস পরিবারের পুজো
Durga Utsav 2019

ঐতিহ্য অমলিন দশঘরা বিশ্বাস পরিবারের পুজোয়

দশঘরার দেববিশ্বাস পরিবারের বাস ছিল আগে হরিদ্বারে।

Advertisement

সায়ন্তনী সেনগুপ্ত

শেষ আপডেট: ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ১৭:০১
Share:

টলটলে দিঘি ঝকমক করছে পড়ন্ত দুপুরের আলোয়। পাশের বিরাট জমিদার বাড়ির ছায়া পড়েছে দিঘিতে। সারা বছরের জমে থাকা ধুলো আর অন্ধকার সরিয়ে সেজে উঠছে বাড়িটা। লাল মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে শিউলি, আল্পনায় মিশে গিয়েছে সাদা কমলা ছোপ। গোপীসাগর দিঘির পাড়ে ভিড় জমিয়েছে মেয়ে বউরা। কাপড় কাচছে, গল্প করছে। পুজোর কেনাকাটা, হাটের জামা শাড়ি, আরও কত কিছু নিয়ে। ছেলের দল ঝাঁপ দিচ্ছে পুকুরে। ছলাৎ করে উঠছে দিঘির জল। খুশির বাতাসে ভেসে যাচ্ছে বিশ্বাস পাড়া। পুজো আসছে।

Advertisement

দশঘরার দেববিশ্বাস পরিবারের বাস ছিল আগে হরিদ্বারে। সেখান থেকে ওড়িশা হয়ে বাংলায় আসা। বলা হয় জগমোহন বিশ্বাস নামে এই পরিবারের এক ধনাঢ্য ব্যক্তি দশঘরায় জমিদারির পত্তন করেন। দশটি বিরাট গ্রাম নিয়ে তাঁর জমিদারি ছিল। যদিও অনেকে বলেন, জগমোহন বিশ্বাসের প্রপিতামহ ছিলেন জমিদারির প্রতিষ্ঠাতা। বিশ্বাসদের টেরাকোটার পঞ্চরত্ন মন্দিরটি দেখার মতো। ১৭২৭ খ্রিস্টাব্দে সদানন্দ বিশ্বাস মন্দিরটির প্রতিষ্ঠা করেন। মন্দিরের কষ্টিপাথরের গোপীনাথ জিউ আর অষ্টধাতুর রাধারানিকে নিত্যপুজো করা হয়। বহুমূল্য এই মূর্তি দু’টি নিয়ে সুন্দর এক গল্প প্রচলিত রয়েছে। বস্তুত, এই দুই মূর্তির সঙ্গে জড়িয়ে আছে বিশ্বাসবাড়ির দুর্গাপুজোর ইতিহাসও। নিধিরাম দেব বিশ্বাস নামে এই পরিবারের এক ছেলে খুব অল্পবয়সে মারা যান। শোকে-দুঃখে তাঁর মা যখন প্রায় উন্মাদিনী, সেই সময় হরিদ্বারের এক যোগীর কাছ থেকে মূর্তি দু’টি নিয়ে আসা হয়। মূর্তি দু’টিকে সন্তানস্নেহে আঁকড়ে ধরেন নিধিরামের মা। সুস্থও হয়ে ওঠেন দ্রুত। এর পর ধুমধাম করে পুজো শুরু হয় গোপীনাথ জিউয়ের। এই বাড়িতে আগে প্রতি বছর দেবী চণ্ডীর পুজো হত। কিন্তু চণ্ডী আর গোপীনাথ জিউয়ের পুজো একসঙ্গে এক বাড়িতে করতে অরাজি হন পুরোহিতরা। তখন চণ্ডীপুজো বন্ধ করে দিয়ে চণ্ডীমণ্ডপ স্থানান্তরিত করা হয়। পরে সেইখানে দুর্গাদালান তৈরি করে শুরু হয় দুর্গাপুজো।

বিশ্বাসবাড়িতে কাঠামো পুজো হয় উল্টোরথের দিন। মহালয়ার পরের দিন বোধন হয়। চণ্ডীবেদীতে দেবীর বোধনের পর শুরু হয়ে যায় চণ্ডীপাঠ। পঞ্চমীর দিন দেবীকে সাজ পরানো হয়। আগে প্রায় ৪০ ভরির গয়না পরানো হত দেবীকে। ঢাল, তরোয়াল সবই ছিল রূপোর। এখন গয়না খানিকটা কম পরানো হয়। দেবীর চার হাত এই বাড়িতে। ডান হাতে থাকে বল্লম, বাঁ হাতে সাপ। আর থাকে ঢাল তরোয়াল। একচালার মূর্তিতে কার্তিক গণেশের মূর্তি থাকে ওপরে, দুর্গার দুই পাশে। লক্ষ্মী সরস্বতী থাকেন চালার নীচের দিকে। এই বাড়ির গণেশঠাকুর নির্মিত হয় ওড়িশি কায়দায়। ষষ্ঠীর দিন বিল্ববরণ হয়। সপ্তমীর দিন কলাবউ স্নান করানোর পর দেবীর চক্ষুদান করা হয়। পুজো শুরু হলে এই বাড়ির তিন বংশের তিন জন গৃহলক্ষ্মীকে দুর্গাদালানে নিয়ে এসে দেবীর পাশে রাখা হয়। দুর্গার সঙ্গে সঙ্গে পুজোর দিনগুলিতে পূজিত হন এঁরাও। অষ্টমীর দিন তিন পরিবারের মঙ্গলার্থে ১০৮টি করে মোট ৩২৪টি প্রদীপ সুন্দর করে সাজিয়ে দেওয়া হয় ঠাকুরদালানে। পুজোর তিন দিন পাঁঠা বলি হয় এই বাড়িতে। এ ছাড়াও নবমীর দিন আঁখ, ছাঁচিকুমড়ো, লেবু বলি দেওয়া হয়। পুজো শাক্ত মতে হয় বলে প্রতি দিন পুজো শুরুর একটু আগেই গোপীনাথ জিউ এবং রাধারানির মূর্তি পুজো করে তাঁদের কানে তুলো দিয়ে শয়ন করিয়ে দেওয়া হয়। পুজোর সময় বন্ধ করে দেওয়া হয় মন্দিরের দরজাও। পুজো শেষ হলে এঁদের তুলে সন্ধ্যারতি দেওয়া হয়। বিশ্বাসবাড়িতে প্রতি দিন ঠাকুরকে ৩০ থেকে ৪০ রকমের নৈবেদ্য দেওয়া হয়। সন্ধিপুজোর সময় এক মন চালের নৈবেদ্য হয়। এ ছাড়াও বিভিন্ন রকম ফল, ক্ষীর, ছানা, দই, লুচি, বাতাসা, সন্দেশ দেওয়া হয় ঠাকুরের উদ্দেশে।

Advertisement

আরও পড়ুন: প্রাচীন এই পুজোয় কুমারীদেরও হাতে পরতে হয় শাঁখা!

দশমীর দিন দুপুরে বাড়ির সদস্যরা বাড়ির গোপীনাথ মন্দির, রাসমঞ্চ, দোলমন্দির, দুর্গাদালান ঘুরে সব দেব দেবীর আশীর্বাদ নেন। একে বলে ‘যাত্রা’। পরিবারের লোকেরা বিশ্বাস করেন এই আচার পালন করলে সারা বছরের সব বিঘ্ন কেটে যাবে। সন্ধ্যাবেলা বরণ এবং সিঁদুর খেলার পর দেবীকে বিসর্জন দেওয়া হয় বাড়ির সামনের গোপীসাগর দিঘিতে। কিছু দিন পর সেই কাঠামো পুকুর থেকে তুলে পরিষ্কার করে তুলে রাখা হয়। পরের বছর সেই কাঠামোতেই পুজো করা এই বাড়ির নিয়ম। বিশ্বাস বাড়ির দুর্গাপুজো আর তিরলের কালীপুজোর মধ্যে যোগ রয়েছে অদ্ভুত ভাবে। এই বাড়িতে বিসর্জনের আগেই ঠাকুরের মুকুট খুলে নেওয়া হয়। কালীপুজোর দিন সেই মুকুট আর ফল মিষ্টির তত্ত্ব নিয়ে বিশ্বাস বাড়ি থেকে লোক যায় তিরলের বিখ্যাত কালীপুজোয়। সেই দিন পুজোর সময় কালীঠাকুর দশঘরার এই পরিবারের দুর্গাঠাকুরের মুকুট মাথায় পরেন।

বিশ্বাসবাড়ির নহবতখানায় ষষ্ঠীতে মিঠে তান ধরত সানাই। জলসাঘরের ঝাড়বাতিগুলি জ্বলে উঠত। হয়তো বা কোনও এক নর্তকীর ঘুঙুরের বোল গোপনে ছুঁয়ে যেত দর্শকের হৃদয়। সেই নহবতখানা এখন শূন্য পড়ে থাকে পুজোর সময়। কবেই নিভে গিয়েছে জলসাঘরের বাতি। তবে আজও ঠাকুরদালানের টুকটুকে লাল মেঝেতে আল্পনা আঁকে শরতের আলো, সে আলো এসে পড়ে দেবীর মুখে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement