কথাতেই রয়েছে, বাঙালির ‘বারো মাসে তেরো পার্বণ’। তাই বেশ কিছু বছর ধরেই ধনতেরাস উৎসবকে নিজের করে নিয়েছে বাঙালি। মূলত অবাঙালিদের মধ্যে এই উৎসব পালনের প্রথা ছিল এর আগে।
দোরগোড়ায় দীপাবলি। সেই সঙ্গে ধনতেরাসও কড়া নাড়বে বাড়ির দরজায়। দীপাবলির উৎসব পাঁচ দিনের, ধনতেরাসের হাত ধরেই তার উদযাপন শুরু হয়। লক্ষ্মী পুজোর ঠিক দিন দুই আগে পালিত হয় ধনতেরাস।
ধনতেরাস পরিচিত- ‘ধনাত্রয়োদশী’ বা ‘ধনবত্রী ত্রয়োদশী’ নামে। ‘ধন’ শব্দের অর্থ ‘সম্পদ’ এবং ‘তেরাস’ শব্দের অর্থ ‘ত্রয়োদশী’ অর্থাৎ তেরো। হিন্দু ক্যালেন্ডার অনুযায়ী কার্তিক মাসের তেরোতম দিনে, অর্থাৎ কৃষ্ণপক্ষের ত্রয়োদশ তিথিতে এই উৎসব পালিত হয় ঘরে ঘরে।
দেশ জুড়ে ভরে ওঠে আলোর রোশনাই। পরিবারের সকলে মঙ্গল, সুখ-সমৃদ্ধি ও ধনসম্পদ লাভের আশায় ধনদেবতা কুবেরের আরাধনা করেন। এই দিনে কিছু না কিছু মূল্যবান ধাতু বা সোনা, বাসনপত্র এবং নতুন পোশাক কিনে থাকেন প্রত্যেকেই।
ধনতেরাসকে ঘিরে রয়েছে অজস্র পৌরাণিক কাহিনী। শোনা যায়, রাজা হিমের ষোল বছর বয়সী পুত্রের জীবনে একটি অভিশাপ ছিল- বিয়ের চার দিনের মাথায় সর্প দংশনে তাঁর অকালমৃত্যু ঘটবে। ওই অভিশপ্ত রাতে তাই নববধূ স্বামীকে ঘুমোতে দেননি। নানা রকম কৌশলে তাঁকে জাগিয়ে রাখেন।
শোওয়ার ঘরের বাইরে প্রচুর ধন সম্পদ, সোনা-রুপোর গয়না, বাসন সাজিয়ে রাখেন নবপরিণীতা। ঘরেও সর্বত্র প্রদীপ জ্বালিয়ে দেন। যাতে সাপ কোনও ভাবেই তাঁদের ঘরে ঢুকতে না পারে। স্বামীকে জাগিয়ে রাখতে সারারাত গল্প আর গানও শোনান তিনি।
পরদিন মৃত্যুর দেবতা যম আসেন। ঘরের দরজায় অত গয়নার জৌলুস এবং প্রদীপের আলোয় তাঁর চোখ ধাঁধিয়ে যায়। রাজপুত্রের শোওয়ার ঘর পর্যন্ত না গেলেও ওই গয়নার উপর শুয়ে রানীর গান আর গল্প শুনতে শুনতে বিভোর হয়ে পড়েন যম। তার পরে দিকভ্রান্ত হয়ে নিজের আস্তানায় ফিরে যান।
এ ভাবেই বুদ্ধিবলে নববধূ স্বামীর প্রাণ রক্ষা করেন। এবং পরের দিন সেই আনন্দে সোনা-রুপো এবং আরও বিভিন্ন ধাতু কিনে ধনতেরাস উৎসব পালন করা শুরু হয় রাজপরিবারে।
এই দিন অনেকেই লক্ষ্মী দেবীর আরাধনা করেন। মা লক্ষ্মী যেহেতু ধন-সম্পদ নিয়ে আসেন গৃহস্থের ঘরে, তাই তাঁকেও পুজো করা হয়। ব্যবসায়ীদের জন্য এই দিনটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দীপাবলির দু’দিন আগে লক্ষ্মীদেবীর পুজো করা নিয়েও রয়েছে একটি পৌরাণিক গল্প।
পুরাণে বলা হয়েছে, এক সময় দুর্বাসা মুনির অভিশাপে সৌভাগ্যের দেবী লক্ষ্মী গৃহছাড়া হন, শ্রীহীন হয়ে পড়ে স্বর্গলোক। দেবতারা অশুভ শক্তি অসুরের সঙ্গে যুদ্ধ করে সমুদ্রমন্থনে আবার ফিরে পান লক্ষ্মীকে। সেই দিনটিই ছিল ধনতেরাসের দিন। তখন থেকেই দেবী লক্ষ্মীর উদ্দেশ্যে সূচনা করা হয় দীপাবলি উৎসব।
ধনতেরাসের পরে এবং দীপাবলির আগের দিন হল নরক চতুর্দশী বা ভূত চতুর্দশী। এই দিন বাড়িতে বিভিন্ন স্থানে মোট চোদ্দোটি প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখতে হয়। সেই সঙ্গে চোদ্দো রকমের শাক খাওয়ার প্রচলনও রয়েছে। এই দিনটিকে অনেকেই ছোটি দিওয়ালি বলে অভিহিত করেন।
দীপাবলির রাতে প্রদীপ জ্বালিয়ে শুভ শক্তির আরাধনা করা হয়। পরিবারের সমৃদ্ধি কামনায় যে যাঁর সাধ্য মতো ধাতু বা গয়না কেনেন। এই উপলক্ষে সোনার দোকানেও মেলে বিশেষ ছাড়। বেশ কিছু বছর ধরে বাঙালিদের মধ্যেও ধনতেরাস পালনের চল শুরু হয়েছে। তাঁরাও প্রদীপ জ্বালিয়ে ধনদেবীর পুজোয় মাতেন।