গিরিনন্দিনী উমা থেকে দানবদলনী দুর্গা— দেবীর এই যাত্রাপথটি খুব সহজ নয়। ‘বাংলার ঘরের মেয়ে’ হয়ে যে মাতৃকাশক্তির আশ্বিনের প্রাতে বোধন ঘটে, তিনি কে? কী তাঁর উৎস? পুরাণ, লোকবিশ্বাস আর কিংবদন্তির আড়ালে থেকে যায় নৃতত্ত্ব এবং সভ্যতার ইতিহাসের বেশ কিছু অচেনা কাহিনি।
প্রকৃতিকে দেবীশক্তি হিসাবে দেখার বিষয়টি শুরু হয়েছিল সভ্যতার প্রায় আদি লগ্নেই। ঋতুতে ঋতুতে ফলে-ফুলে-শস্যে ভরে ওঠা বসুন্ধরা আর গর্ভধারিণী নারীর মধ্যে একটি সাযুজ্য খুঁজে পেয়েছিলেন প্রকৃতি উপাসকরা। সেটি হল— মাতৃত্ব। এর প্রমাণ ছড়িয়ে রয়েছে বিশ্বের প্রাচীন সভ্যতাগুলির সর্বত্র। অস্ট্রিয়ার ভিলেনডর্ফ নামক স্থানে প্রাপ্ত এক নারীমূর্তিকে মাতৃকা-উপাসনার সব থেকে প্রাচীন নিদর্শন বলে ধরা হয়। এই মূর্তিটির বয়স আনুমানিক ২৫ হাজার বছর।প্রকৃতিকে দেবীশক্তি হিসাবে দেখার বিষয়টি শুরু হয়েছিল সভ্যতার প্রায় আদি লগ্নেই। ঋতুতে ঋতুতে ফলে-ফুলে-শস্যে ভরে ওঠা বসুন্ধরা আর গর্ভধারিণী নারীর মধ্যে একটি সাযুজ্য খুঁজে পেয়েছিলেন প্রকৃতি উপাসকরা। সেটি হল— মাতৃত্ব। এর প্রমাণ ছড়িয়ে রয়েছে বিশ্বের প্রাচীন সভ্যতাগুলির সর্বত্র। অস্ট্রিয়ার ভিলেনডর্ফ নামক স্থানে প্রাপ্ত এক নারীমূর্তিকে মাতৃকা-উপাসনার সব থেকে প্রাচীন নিদর্শন বলে ধরা হয়। এই মূর্তিটির বয়স আনুমানিক ২৫ হাজার বছর।
ভারতীয় সংস্কৃতিতে মাতৃকা-উপাসনা সিন্ধু সভ্যতার কালে প্রচলিত ছিল বলে এক দিকে যেমন প্রত্নতত্ত্ববিদরা জানান, তেমনই দেবী-প্রাধান্য যুক্ত সম্প্রদায় তন্ত্রের শিকড় খুঁজতে গিয়ে ইতিহাসকাররা পৌঁছন সিন্ধু সভ্যতাতেই। এই সভ্যতার বিভিন্ন সিলমোহর (আদতে তাবিজ) এবং উপাসিত নারীমূর্তি দেখে তেমনটাই অনুমান করা হয়।
পরবর্তীকালে বৈদিক যুগে প্রাকৃতিক শক্তির প্রতীক হিসেবে পুরুষ দেবতারা প্রধান্য পেলেও, ঊষা বা অদিতির মতো মাতৃকারাও পূজিতা হতেন বলে জানা যায়। তবে এ কথাও ঠিক, বসুন্ধরাকে কৃষিজীবী আর্যরা ‘মা’ হিসাবেই কল্পনা করেছিলেন, তার উল্লেখ ঋগ্বেদে রয়েছে। (সঙ্গের ছবিটি ঋগ্বেদের দেবীসূক্তের)
পুরাণগুলিতে দেবী একেবারেই স্বমহিমায় বিরাজ করছেন। শশিভূষণ দাশগুপ্তের মতো পণ্ডিত পৌরাণিক কালের বিশ্বাসে মহাশক্তিকে মাতৃকা হিসাবেই দেখেছেন এবং এই শক্তিকে পরবর্তীকালের দুর্গাকল্পের সঙ্গে অভিন্ন বলে বর্ণনা করেছেন।
কিন্তু হিমালয়-দুহিতা উমা আর অতি প্রাচীনকাল থেকে পূজিতা হয়ে আসা মাতৃকার মধ্যে সম্বন্ধ কোথায়? ‘উমা’ শব্দটিই রহস্যময়। কবি ভারতচন্দ্র ‘অন্নদামঙ্গল’-এ লিখেছিলেন, ‘উ’-এর অর্থ শিব এবং ‘মা’-এর অর্থ তাঁর ‘শ্রী’ বা শক্তি। কিন্তু কবি কালিদাস অন্য কাহিনি শোনান। ‘কুমারসম্ভব’-এ গৌরী যখন দেবাদিদেবকে পাওয়ার জন্য কঠোর তপস্যা আরম্ভ করলেন, তখন তাঁর মা তাঁকে ‘উ মা’ বলে সম্বোধন করে কৃচ্ছ্রসাধন থেকে নিবৃত হতে বলেন।
পুরাণ জানায়, দেবীর আসল পরিচয় ‘পার্বতী’। শশিভূষণ জানাচ্ছেন, আসলে নাকি দেবীকে পর্বতবাসিনী হিসাবেই কল্পনা করা হয়েছিল, পর্বত-দুহিতা হিসাবে নয়। সেই কারণেই তিনি ‘পার্বতী’। কিন্তু বাংলার জল-বাতাসে দেবী সুদূর পর্বতের বাসিন্দা। তিনি হিমালয়-কন্যা এবং তাঁর বিবাহও হয়েছে কৈলাস পর্বতবাসী শিবের সঙ্গে। এ যেন দূরে বিয়ে হওয়া ঘরের মেয়েটির আখ্যান।
পার্বতী উমাকেই ‘দুর্গা’ জ্ঞানে পুজো করা হয়। পৌরাণিক কালের আগেই ‘তৈত্তিরীয় আরণ্যক’-এ ‘দুর্গা’ শব্দটির হদিশ মেলে। দেবী দুর্গতিনাশিনী, তাই ‘দুর্গা’। কিন্তু ‘মার্কণ্ডেয় পুরাণ’-এ দেবী মহিষাসুরকে বধ করে পৃথিবীকে দুর্গতিমুক্ত করেন বলেই তাঁর এমন নাম, এ কথা বলা হয়েছে।
কিন্তু এই ‘দুর্গা’-ই কি পার্বতী উমা? ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, পার্বতী উমার উপাসনা আর দেবী চণ্ডীর উপাসনা কোনও এক কালে আলাদা ছিল। কিন্তু কালক্রমে এই দুই মতৃকাকল্প মিলেমিশে এক হয়ে যায়। লক্ষণীয়, ‘চণ্ডী’-তে কোথাও দেবীকে শিবজায়া বলে বর্ণনা করা হয়নি। তা হলে কি দেবীকে শিবের ঘরণি করে তুললেন কবি কালিদাস? ভেবে দেখলে বোঝা যায়, কালিদাসও তাঁর কাব্যের রসদ আহরণ করেছিলেন প্রচলিত বিশ্বাস থেকেই। তা হলে কি জনগণমনই চাইছিল মহাশক্তিকে মহাদেবের সঙ্গে একত্র করতে? (সঙ্গের ছবিটি ইলোরা গুহাগাত্রে হর-পার্বতীর বিবাহ)
তন্ত্র মতে দেবী শিবের ঘরণি। ‘শিব’ এখানে পরমতত্ত্ব। তিনি অজ্ঞেয়। তাঁকে জানতে গেলে দেবীর মাধ্যমেই জানতে হয়। এখানেই সম্ভবত মহামায়া দুর্গা আর শিব সম্পর্কযুক্ত হন। তন্ত্র দর্শনে আবার দেবীর অসুরনিধন হল সাধকের মনের অন্ধকার দিকগুলির ধ্বংস সাধন। সেই কাজ একমাত্র দেবীই করতে পারেন।
আর একটি আশ্চর্য কাহিনি পাওয়া যায় শিখ গুরু গোবিন্দ সিংহের ‘চণ্ডী চরিত্র’ নামক রচনায়। সেখানে তিনি ‘চণ্ডী’-কে ব্যাঘ্রবাহিনী এবং উজ্জয়িনীর রাজকন্যা বলে বর্ণনা করেছেন। এ থেকে অনুমান করা যায়, ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে এক এক রকম ভাবে দেবী উপাসিতা হতেন।
এ হেন চণ্ডী বা অসুরদলনীই কিন্তু বাংলার উমা। তিনি ভোলানাথ শিবের ঘরণি। তাঁকে শ্মশানবাসীর সঙ্গে বিয়ে দিয়ে মা মেনকা খুবই দুশ্চিন্তায় থাকেন। এই চরিত্রে দেবীর উত্তরণ এক দিনে হয়নি। এর পিছনে রয়েছে আবহমান কালের বাঙালি কবিদের অবদান।
১৯ শতকে কবিয়াল কালিদাস চট্টোপাধ্যায় (কালি মির্জা নামে পরিচিত ছিলেন) তাঁর রচিত গানে পার্বতীর বাল্যলীলা বর্ণনা করেছেন। বিয়ের পর বাপের বাড়ি ফিরলে মেনকার অভিমান সেই সময়ের কাব্যে বর্ণিত হয়েছে। এখানে শারদোৎসবের মাতৃকাশক্তি আর উমা একাকার।
হুতোমের নকশায় কলকাতার বারোয়ারি পুজোর বর্ণনা পাওয়া যায়। ১৯ শতকের মধ্যেই বাংলায় যে শারদীয় দুর্গোৎসব বেশ জমাটি উৎসবের আকার নিয়েছিল, তা বোঝা যায়। ইতিপূর্বে ১৮ শতকে রামপ্রসাদের মতো কবি লিখে গিয়েছেন আসংখ্য আগমনী ও বিজয়ার গান। যে গানে দেবী একান্তই বাঙালিনী। কৈলাসে থাকেন বড় জোর। তাঁর বাহন সিংহটিও যেন বাড়ির মটকায় থাকা হুলো বেড়াল।
শশিভূষণ তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন, কী আশ্চর্য ভাবে দেবী তিলে তিলে বাঙালির ঘরের মেয়ে হয়ে গিয়েছেন। মনে রাখা দরকার দেবীর আর এক রূপ হল অন্নপূর্ণা। এখানে একই সঙ্গে কৃষি অনুষঙ্গের মাতৃকা আর বাড়ির অন্নদাত্রী যেন একাকার। সেই সঙ্গে ‘ভিখারি’ শিবকে নিয়েও ভাবতে হবে। এই শিব যেন প্রকৃত অর্থেই এক আত্মমগ্ন ব্যক্তিত্ব। তিনি যে সাধকের পরম অন্বিষ্ট, এ কথা বলতে গিয়ে কবিরা বার বার তাঁকে নামিয়ে এনেছেন ‘ভোলানাথ’-এর চেহারায়। তিনি যেন নিজেকেই চেনেন না।
১৯ শতকে মধুসূদন থেকে গিরিশচন্দ্র এক বাক্যে উমাকে বাংলার লালপেড়ে শাড়ি পরা বাঙালি মেয়ে হিসেবেই যেন দেখেছেন। দাশরথি রায় তাঁর পাঁচালিতে উমাকে ‘দ্বিভুজা বালিকা’ বলে উল্লেখ করেছেন। দশভুজা দেবীকে পুজো করা যায়, কিন্তু যে বালিকা বাবার কোলে খেলা করে, সে কী করে দশভুজা হয়!
শাস্ত্র আর পুরাণ, নৃতত্ত্ব আর সমাজবিদ্যা যা-ই বলুক না কেন, উমা শেষ পর্যন্ত বাঙালির প্রাণের ধন। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘গণেশ জননী’ থেকে যামিনী রায়ের পট তার সাক্ষী। সেই ঐতিহ্য মেনে বিকাশ ভট্টাচার্যও তাঁর ‘দুর্গা’ সিরিজে দেবীকে শহর কলকাতার নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিসরেই দেখিয়েছিলেন। তার হাতে ছিল বাজারের থলে। কিন্তু জ্বলজ্বল করছিল ত্রিনয়ন।