বছরে এক বার উমা আসেন বাপের বাড়ি। সঙ্গে চার সন্তান। হিমালয় পর্বতের কন্যা পার্বতীর আগমনে বোধন থেকে বিসর্জন মেতে ওঠে বাংলার প্রতি কোণ। কিন্তু জানেন কি, একমাত্র বাংলার মাটিতেই দেবী পূজিতা হন সপরিবারে।
দেশের বাকি অংশে তিনি পূজিতা হন একা। সেখানে লক্ষ্মী, সরস্বতী, গণেশ ও কার্তিক তাঁর সন্তানও নন। তাঁরা স্বতন্ত্র দেবদেবী। এই বাংলার মাটিতেই তাঁদের কল্পনা করা হয়েছে পার্বতীর সন্তান হিসেবে।
বৈদিক কাব্য থেকে রামায়ণ, মহাভারত হয়ে লৌকিক কাব্য বা মঙ্গলকাব্যের যাত্রাপথ সুদীর্ঘ। সেই পথেই এই বিবর্তন। কালের স্রোতে স্বতন্ত্র দেবদেবীরা হয়ে গেলেন দুর্গতিনাশিনীর সন্তান-সন্ততি। কিন্তু বেদ বা পুরাণ অনুযায়ী, চারজনের কেউ মা দুর্গার গর্ভজাত নন।
পুরাণ বিশেষজ্ঞ নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ি জানাচ্ছেন, মার্কণ্ডেয় চণ্ডী, কালিকাপুরাণ, ভাগবৎপুরাণের মত উৎসে কোথাও পার্বতীর সন্তানদের উল্লেখ নেই। বরং, লক্ষ্মী এবং সরস্বতী সম্পূর্ণ বৈদিক দেবী।
পুরাণবিদ পূর্বা সেনগুপ্ত বলছেন, বৈদিক সূত্র অনুযায়ী, লক্ষ্মী ও সরস্বতীর উৎস শ্রী শক্তি বা ‘শ্রী’ দেবী। পৌরাণিক সাহিত্য অনুযায়ী, লক্ষ্মী কোথাও নারায়ণের স্ত্রী। আবার কোথাও তিনি সমুদ্রমন্থনে ঘৃত থেকে উত্থিত।
বৈদিক লক্ষ্মীকে ‘মহালক্ষ্মী’ বলে বর্ণনা করছেন নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ি। এই মহালক্ষ্মী বা মহাশক্তি থেকেই সবকিছুর উৎপত্তি। মহাশক্তির শাখাশক্তি হিসেবে ঐশ্বর্য ও বিদ্যার প্রতীক হয়ে বিদ্যমান হলেন দুই দেবী।
জ্ঞান ও বিদ্যার পাশাপাশি সরস্বতীর সঙ্গে রয়েছে নদীর সম্পর্ক। সরস্বতী নদীর অববাহিকায় গড়ে ওঠা সভ্যতা পরে ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন অংশে। নতুন জায়গায় গিয়ে তাঁরা স্রোতবতী সরস্বতীর ধারাকে রূপ দেন জ্ঞান ও বিদ্যার প্রতীক রূপে। মত, পুরাণবিদ পূর্বা সেনগুপ্তের।
কার্ত্তিকেয় বা ষড়াননের জন্ম নিয়ে প্রচলিত একাধিক সূত্র। বাল্মীকির রামায়ণে কার্তিক বা মহাতেজ কার্ত্তিকেয় অগ্নির সন্তান এবং পার্বতীর দিদি গঙ্গার গর্ভজাত। আর মহাভারতে কার্ত্তিকেয় হলেন অগ্নিদেব এবং দক্ষকন্যা স্বহার সন্তান।
গণেশের জন্মবৃত্তান্ত নিয়ে প্রচলিত আখ্যানের মধ্যে সবথেকে জনপ্রিয় শিব পিুরণের কাহিনি। দুর্গার ইচ্ছে হল, শিবের যেমন আজ্ঞাবহ নন্দী, তেমনই তাঁরও কেউ থাকুক। একদিন স্নানের আগে হলুদবাটা দিয়ে তিনি বানালেন একটি মূর্তি। তাতে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করে জন্ম হল গণেশের।
পার্বতী তাঁকে নির্দেশ দিলেন, তাঁর ঘরে যেন কেউ প্রবেশ না করেন। সেই সময় দরজায় উপস্থিত মহাদেব। কিন্তু পার্বতীর আজ্ঞা মেনে গণেশ তাঁকে প্রবেশ করতে দেবেন না। কুপিত শিব নির্দেশ দিলেন সেই বালককে হত্যা করার | কিন্তু কেউ তাঁকে হত্যা করতে পারলেন না।
শেষে এগিয়ে এলেন শিব স্বয়ং | তাঁর রোষে কাটা পড়ল গণেশের মুণ্ড | মারা গেলেন তিনি | এই দেখে পার্বতী প্রচণ্ড রাগে সব সৃষ্টি ধ্বংস করে ফেলবেন বলে ঠিক করলেন |
স্ত্রীকে শান্ত করতে শিব ব্রহ্মাকে বললেন, তিনি যেন সামনে যে পশুর উত্তরমুখী মাথা পাবেন, সেটাই যেন নিয়ে আসেন। ব্রহ্মা হাতির মাথা নিয়ে এলে সেটি শিব স্থাপন করলেন গণেশের দেহে |
পরে তাঁকে গণাধিপতি করলেন শিব। পুরাণবিদ নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ির কথায়, গণেশ প্রকৃতপক্ষে শিব বা মহাদেবেরই একটি রূপ।
মধ্যযুগে বাংলার মঙ্গলকাব্যে চার স্বতন্ত্র দেবদেবী হয়ে গেলেন পার্বতীর সন্তান। মানুষের কল্পনায় সংসারের বাঁধনে বাঁধা পড়লেন বৈদিক দেবদেবীরা।
এই সৃষ্টির উপাখ্যান নিয়ে সৃষ্টির আদি থেকেই প্রচলিত নানা মত। কালিদাস রায়ের লেখা ‘চাঁদ সদাগর’ কবিতা-র অংশ ধার করে বলা যায়, ‘মানুষই দেবতা গড়ে, তাহারই কৃপার পরে/ করে দেবমহিমা নির্ভর’।