বাঙালির দুর্গা বছর বছর মর্ত্যে আসেন চার ছেলেমেয়েকে সঙ্গে নিয়ে। লক্ষ্মী-গণেশ-কার্তিক-সরস্বতী। এই চার জন কি স্বয়ং দুর্গার গর্ভজাত? এ নিয়ে নানা মুনি বা নানা পুরাণের নানা মত, নানা কাহিনি।
কার্তিকের কথাই ধরা যাক। বাল্মীকির রামায়ণ বা কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসের মহাভারতে কার্তিকের যে জন্মবৃত্তান্ত, তা আমাদের প্রচলিত ধারণার সঙ্গে মেলে না।
বাল্মীকির রামায়ণে কার্তিক বা মহাতেজা কার্ত্তিকেয় অগ্নির সন্তান এবং পার্বতীর দিদি গঙ্গার গর্ভজাত। আর মহাভারতে কার্ত্তিকেয় হলেন অগ্নিদেব এবং দক্ষকন্যা স্বাহার সন্তান।
রামায়ণে কার্তিকের জন্মের প্রেক্ষাপটে অবশ্য শিব-পার্বতীর একটি নাটকীয় আখ্যান আছে। বিয়ের পর শতবর্ষ সহবাসেও শিব-পার্বতীর কোনও পুত্র হল না। দেবতাদের দুশ্চিন্তা হল, শেষ পর্যন্ত যে পুত্র জন্মাবে তাঁর তেজবীর্য সইবার মতো কেউ ত্রিলোকে থাকবে না।
দেবতাদের অনুরোধে মহাদেব স্বশরীরে তেজ ধরে রাখার অঙ্গীকার করেন। কিন্তু শতবর্ষ সম্ভোগে তাঁর স্খলিত তেজ উমার বদলে তিনি বসুন্ধরাকে ধারণ করতে দেন দেবতাদের পরামর্শেই। উমা ক্রুদ্ধ হন। বসুন্ধরাকে অভিশাপ দেন। অভিশাপ দেন দেবতাদেরও।
ক্রুদ্ধ পার্বতীকে নিয়ে মহাদেব হিমালয়ের এক শৃঙ্গে তপস্যায় মগ্ন হন। এ দিকে পার্বতীর অভিশাপে বন্ধ্যা হন দেবপত্নীরা। স্বদারে সন্তান জন্মের সম্ভাবনা রইল না দেবতাদের।
মাথায় হাত পড়ল দেবতাদের। অসুরদের সঙ্গে যুদ্ধের জন্য দেবতাদের তখন একজন শত্রুবিনাশন মহাবীর সেনাপতি জরুরি। কার গর্ভে জন্মাবে সেই সেনাপতি? ব্রহ্মার শরণাপন্ন হলেন তাঁরা।
কমলযোনি ব্রহ্মা দেবতাদের সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, উমার অভিশাপ ব্যর্থ হতে পারে না। তিনি নিদান দিলেন— অগ্নি সেই সেনাপতির জন্ম দেবেন আকাশগঙ্গা মন্দাকিনীর গর্ভে। এই গঙ্গাই গিরিরাজ হিমালয় এবং মেনকার জ্যেষ্ঠ কন্যা। অর্থাত্ পার্বতীর দিদি।
ব্রহ্মা আরও বললেন— জ্যেষ্ঠা গঙ্গা জাতককে কনিষ্ঠা উমারই পুত্র বলে মানবেন। এবং উমার চোখেও সেই ছেলে কখনও অনাদরের হবে না।
অনেক কাল আগেই দেবতাদের অনুরোধে জাহ্নবী বা গঙ্গাকে সুরলোকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন হিমালয়। ব্রহ্মার ইচ্ছায় এ বার অগ্নির সঙ্গে মিলিত হতে নারীরূপ পরিগ্রহ করলেন গঙ্গা। অগ্নি তাঁর রূপে মুগ্ধ হলেন এবং গঙ্গায় নিজের শিবতেজ নিক্ষেপ করলেন।
গঙ্গা যন্ত্রণায় কুঁকড়ে গেলেন। বললেন— হে অগ্নি, পাশুপত তেজের সঙ্গে তোমার তেজ যুক্ত হওয়ায় তা আমার পক্ষে অসহনীয় হয়ে উঠেছে। আমার চেতনা বিলুপ্ত হচ্ছে। এই তেজ আমি ধারণ করতে পারব না।
অগ্নি বললেন— দেবী, তুমি হিমালয়ের পাশে তেজ পরিত্যাগ করো। গঙ্গা তাই করলেন। তত্ক্ষণাত্ সেখানে একটি কুমারের জন্ম হল। দেবতারা এই কুমারকে স্তন্যদানের জন্য কৃত্তিকা নক্ষত্রগণকে বললেন। কৃত্তিকাদের স্তন্যপানের জন্যই এই কুমারের নাম হল কার্তিক।
এই কার্তিক গঙ্গার গর্ভ থেকে স্কন্ন (নিঃসৃত) হয়েছিলেন বলে এঁর আর এক নাম স্কন্দ। ছয় মুখবিশিষ্ট (ষড়ানন) কার্তিক বা কার্ত্তিকেয় পরে দেবতাদের সেনাপতি হয়ে দানবদের পরাজিত করেন।
এ বার বেদব্যাস রচিত মহাভারতের বনপর্বে কার্তিকের জন্মবৃত্তান্ত দেখা যাক। এক দিন প্রজাপতিকন্যা দেবসেনাকে ইন্দ্র এক দানবের হাত থেকে রক্ষা করেন। দেবসেনার প্রার্থনায় ইন্দ্র তাঁকে অজেয় পতি লাভের বর দেন। ইন্দ্র তাঁকে ব্রহ্মার কাছেও নিয়ে যান।
ব্রহ্মা বললেন— এক মহাবিক্রমশালী পুরুষ জন্মগ্রহণ করে দেবসেনার পতি হবেন। তিনি দেবতাদেরও সেনাপতি হবেন।
এক দিন অপূর্বসুন্দরী ঋষিপত্নীদের দেখে অগ্নি কামার্ত হয়ে পড়েন। কিন্তু তাঁদের পাওয়া অসম্ভব বুঝে দেহত্যাগের সঙ্কল্পে বনে চলে যান। দক্ষকন্যা স্বাহা আবার অগ্নিকে কামনা করতেন। অঙ্গিরার স্ত্রী শিবার রূপ ধরে তিনি বনে অগ্নির কাছে সঙ্গম লাভ করলেন।
মোট ছ’বার অগ্নির সঙ্গে সঙ্গম করার পর, স্বাহা অগ্নির শুক্র কৈলাস পর্বতের এক কাঞ্চনকুণ্ডে নিক্ষেপ করেন। সেই স্কন্ন বা স্খলিত শুক্র থেকে জন্মান বলে জাতকের নাম হয় স্কন্দ। তিনিই কার্তিক। পরে দেবসেনাপতি হন।
বেদব্যাস লিখিত মহাভারতের কাহিনি অনুসারে, মহিষ নামক অসুর বা দানব নিহত হয়েছিলেন কার্তিকের হাতে। শক্তি অস্ত্র নিক্ষেপ করে কার্তিক মহিষ অসুরের মুণ্ডচ্ছেদ করেন।